দীপন হত্যায় আট জঙ্গির ফাঁসির রায়
Published : Thursday, 11 February, 2021 at 12:00 AM
প্রায় ছয় বছর আগে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আট জঙ্গির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান বুধবার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
আট আসামির সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- দেওয়ার পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে রায়ে। তাদের মধ্যে জিয়াসহ দুজন পলাতক।
বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের উপর ধারাবাহিক হামলার মধ্যে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ে আক্রান্ত হন দীপন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে দীপনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। দুই আসামিকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরুর এক বছর তিন মাসের মাথায় আলোচিত এ মামলার রায় হল।
৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেণে বিচারক বলেন, লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যার অংশ হিসেবে অভিজিত রায়ের বই প্রকাশের জন্য জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়।
“আসামিদের কারো ভূমিকা ছোট-বড় করে দেখার সুযোগ নেই। যারা বই প্রকাশের দায়ে মানুষ হত্যা করতে পারে, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যায় অংশগ্রহণকারীরা বেঁচে থাকলে আনসার আল ইসলামের বিচারের বাইরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহী হবে।”
এ মামলার আট আসামি হলেন- বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুর সবুর সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে জিসান, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার ও শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের।
আসামিদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক। বাকিরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য বলে পুলিশের ভাষ্য।
আদালতে উপস্থিত দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান রায় শুনে কেঁদে ফেলেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি খুব অসুস্থ, কালকে আমার মামা মারা গেছেন। আমরা এই রায় নিয়ে সন্তুষ্ট। আজকে আমরা যে রায় পেয়েছি, এর জন্য সংশ্লিষ্ট যারা ছিলেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
অন্যদিকে আসামিপরে আইনজীবী খাইরুল ইসলাম লিটন ও এম নজরুল ইসলাম এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানান।
খাইরুল ইসলাম লিটন বলেন, “এই রায় সঠিক হয়নি। এ রায় এক তরফা। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।”
নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরা চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমরা পারলাম না। আমরা আপিল করব।”
রাষ্ট্রপে এ মামলা পরিচালনা করেন গোলাম ছারোয়ার খান জাকির।
রায়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত পর্যবেণ দিয়েছে, এ মামলার আসামিদের ল্য ছিল ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যা করে মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া এবং মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে জন নিরাপত্তা বিঘিœত করা। আর এ সব কিছুর উদ্দেশ্য হল মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ করে দেওয়া। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংস করে দেওয়া।”
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাৎ করার খবর দেয়। অভ্যুত্থানচেষ্টাকারীদের নেতা হিসেবে জানানো হয় মেজর জিয়ার নাম।
তখন সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া জিয়া পালিয়ে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামে যুক্ত হন বলে পুলিশের প থেকে বলা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে অভিজিৎ হত্যা মামলাসহ আরো বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
দীপনকে যে বছর হত্যা করা হয়েছিল, সেই ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা চলার সময় টিএসসিতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়সহ কয়েকজন ব্লগার-লেখককে হত্যা করা হয়।
এরপর ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে দীপনকে হত্যার দিন একই সময়ে লালমাটিয়ায় আরেক প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে একই কায়দায় কোপানো হয়েছিল। তবে টুটুলসহ তিনজন বেঁচে যান। জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর দুই প্রকাশনা থেকেই বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়। দুটি ঘটনাতেই জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের নাম আসে।
পুলিশের প থেকে বলা হয়, এই জঙ্গি দলের সামরিক কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা জিয়ার পরিকল্পনা এবং নির্দেশেই দীপনকে হত্যা করা হয়। ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যার পর ওই দিনই তার স্ত্রী রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন।
তিন বছর পর ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার ফজলুর রহমান। অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রপে মোট ২৬ জনকে সাী করা হয়।
২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ আদালতে আসামিদের বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপে মোট ২৩ জনের স্যাগ্রহণ, আটক আসামিদের আত্মপ সমর্থন এবং দুই পরে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২৪ জানুয়ারি বিচারক রায়ের তারিখ ঠিক করে দেন।
বুধবার রায় ঘিরে আদালতের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী পুরো এলাকায় কড়া নজরদারি চালায়।
কাশিমপুর কারাগার থেকে ছয় আসামিকে সকালেই প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় তাদের গায়ে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট।
আদালত সবার মৃত্যুদ-ের রায় দেওয়ার পর ছয় আসামিকে আবার কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
এ মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুর রহমান রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আসামিদের সবার মৃত্যুদ- হবে, এমন একটা প্রত্যাশা ছিল। এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে।”