
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক||
আজকের আড্ডার বিষয় সাম্প্রতিককালের ‘নির্বাচন’ প্রসঙ্গে। কথাটা উঠেছে বর্তমানে দেশে চলমান নির্বাচনের হালচাল দেখে-শোনে। তর্কটা তখনই জমে উঠেছে, যখন একজন বললেন-এখন নির্বাচন হয় না, মনোনয়ন হয়। তিনি বলতে চেষ্টা করলেন যে বর্তমানে যারা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বা সে দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন নামক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন, তারা নিশ্চিত নির্বাচিত হন, মনোনয়নের ফলেই প্রার্থিত পদ লাভ করে থাকেন। তাই মনোনয়ন পেতে যত বেগ পেতে হয়, মনোনয়ন পেলে পাশ করতে ততটা কষ্ট হয় না। তিনি আরও কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু একজন প্রায় উচ্চস্বরেই বলে উঠলেন-এ ক্যামন কথা। দেশে একটি ‘নির্বাচন কমিশন’ রয়েছে, সেখান থেকে নির্বাচনের সকল কর্মকা- পরিচালিত হয়, কমিশন থেকে যতক্ষণ না ফলাফল ঘোষণা করা হয়, তার আগে কেউ নিজেকে বা প্রার্থীকে নির্বাচিত হিসেবে ঘোষণা দেয়া যায় না। যদি মনোনয়নই নির্বাচিত বিবেচনা করা হয়, তবে নির্বাচন কমিশন থাকার প্রয়োজন কি? এই প্রতিষ্ঠান তো শ্বেতহস্তীর মতো দেশের জন্য বোঝা। ইত্যাদি। একজন বললেন, নির্বাচন কমিশন থাকতে হবে, সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের কথা রয়েছে, নির্বাচন কমিশনের জন্য পৃথকভাবে করণীয় কর্মধারা, ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদি স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার ব্যবস্থা রয়েছে। দেশে যেমন আইন-আদালত রয়েছে, বিচারিক বিষয় সেখানেই সমাধান হয়। একজন খুনি কাউকে খুন করে যদি বলে-আমি খুন করেছি, তখনই আদালত শাস্তি প্রক্রিয়ায় রায় দেন না। আসলে ব্যক্তিটি খুনি কীনা, খুন করতে কেউ দেখেছে কীনা, খুনি স্বীকার করলেও অনেক যাচাই-বাচাই, সাক্ষী এবং উভয় পক্ষের আইনজীবীদের সওয়াল-জবাব অর্থাৎ নানা পরিক্রমায় যখন বিচারক নিশ্চিত হন যে সে-ই খুনি, তখনই রায় ঘোষণা করা হয়। ফলে বিচারিক কাজ সমাধা করতে কয়েকবছর লেগে যায়। যেমন ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে প্রকাশ্যে বেতারের মাধ্যমে হত্যাকারীরা জানিয়ে দিয়েছিল-‘আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি।’ দেশের আপামর জনগণ, পৃথিবীর লোকসমাজ একথা শুনেছে, তারপরও ৩৪ বছর বিচারিক প্রক্রিয়ার পর আদালত নিশ্চিত হয় যে স্বঘোষিত ব্যক্তিরাই ঘাতক। তারপর রায় হয় এবং খুনিদের মৃত্যুদ- দেয়া হয় ও আংশিক কার্যকর হয়। কাজেই যেহেতু প্রতিটি দেশ পরিচালনার জন্য একটি নিজস্ব সংবিধান থাকে, কাজেই সংবিধানের নির্দেশের বাইরে চলার কোনো সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশে অনেক কমিশন রয়েছে। যাঁরা নির্ধারিত সময়ের জন্য কমিশনের সদস্য হন, তাঁদের মধ্যে একজন প্রধান এবং অন্যরা সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন। এই পদগুলো সাংবিধানিক এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ও শপথের মাধ্যমে তাঁদের দায়িত্ব পালন শুরু হয়। কমিশনের নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ সাংবিধানিকভাবেই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন এবং সংবিধানে উল্লিখিত ক্ষমতা ও কর্মধারা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই কমিশনগুলোর প্রতি দেশবাসী আস্থাভাজন হয়ে থাকেন। এই আস্থাভাজনতাকে বিতর্কহীন থাকার জন্য কমিশন গঠনের আগে নিরপেক্ষ দায়িত্ববান ব্যক্তিবর্গ দ্বারা অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) গঠন করে দেয় সরকার, দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ একেক কমিশনের জন্য কমিশনার-এর নাম প্রস্তাব করেন। তা থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সরকার প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশনের জন্য কমিশনার নিয়োগ প্রদান করেন। প্রক্রিয়াটি যতটা স্বচ্ছ ও বিতর্কহীন রাখা যায়, তা সচেতনভাবে করা হয়। কিন্তু তারপরও কথা থাকে। বিশেষত নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় অনুসন্ধান কমিটি দেশের রাজনৈতিক দলের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিবর্গকে কমিশন-সদস্য মনোনয়নের উপর জোর দেন। এমন কি বিভিন্ন দলের অভিমত ও তাদের পছন্দের ব্যক্তির নামও জানতে চান।
আড্ডায় একজন বলে উঠলেন-তাহলে নিরপেক্ষতা রইল কই? রাজনৈতিক দল যদি তাদের পছন্দের কথা বলার সুযোগ পান এবং তাদের নিজস্ব লোক কমিশনে থাকার আর্জি জানাতে পারেন, তবে কমিশন, বিশেষত নির্বাচন কমিশন নামক একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান তো সর্বসম্মতিক্রমে কোনো কাজই করতে পারে না, পারবে না। কমিশন তো গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনা, পারবে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কর্মকা- দেখে সেজন্যই দেশের ৪৭জন বিশিষ্ট নাগরিক মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন যে এ কমিশন নিরপেক্ষ নয়, তাঁদের নিয়োগ বাতিল করা হোক, এমন কি তাঁদেরকে বিচারিক আদালতের সম্মুখীন করা হোক। শুধু আবেদন করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা এখন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎপ্রার্থী।
একজন বললেন-বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। বর্তমান নির্বাচন কমিশনে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পাঁচজন কমিশনার। তাঁরা নির্বাচন সংক্রান্ত অর্পিত দায়িত্ব সর্বসম্মতিক্রমে অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ কমিশনারের মতামতের উপর ভিত্তি করেই কর্মধারা পরিচালনা করবেন-এটাই বিধিবিধান। তাঁদের মতবিরোধ বা মতানৈক্য দেশবাসী জানাটা কোনো অবস্থায়ই প্রীতিকর নয়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি-কমিশনারদের মধ্যে যে মতানৈক্য বা মতবিরোধ তা দেশবাসীকে জানান দেয়া হচ্ছে। মিডিয়ার লোকজনকে ডেকে কমিশনের গোপন বিষয়গুলো প্রচার করা হচ্ছে, নিজেদের মতানৈক্য এতটাই প্রবল ও স্বেচ্ছাচারমূলক তা নিজেদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিরোধের চিত্রটি জনগণের কাছে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। দেখা যায় নির্বাচন কমিশনেও সরকারি ও বিরোধীদলের মতো পাল্টাপাল্টি কথাবার্তা চলে। কাজেই নির্বাচন কমিশন যেন আর নিরপেক্ষ নেই। মাননীয় কমিশনারগণ নিজেরা যতই সাফাই করে কথা বলুন না কেন, জনগণ জেনে গেছে-তাঁরা সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা এবং অর্পিত দায়িত্ব পালনে দ্বিধাবিভক্ত। অথচ সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা নি¤œরূপ-
ক. এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে কোন নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ তাঁহার কার্যভার গ্রহণের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসরকাল হইবে।
খ. নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।
গ. সুপ্রীম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হইতে পারেন, সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোন নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হইবেন না।
ঘ. কোন নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।
তারপর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরিচালনার জন্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন, তফসিল ঘোষণা, নির্বাচন-উপনির্বাচন পরিচালনাসহ স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বার্থে
ঙ. নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।
তাহলে নির্বাচন বা মনোনয়ন এই বিষয়টি কেন আজ আড্ডায় আলোচনার বিষয়বস্তু হলো? আমি তো চুপচাপ বসেই ছিলাম। মনে একটু খটকা লাগল। তাই বললাম-নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বচ্ছ নিরপেক্ষ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ নিয়ে নির্বাচন কমিশন পাঁচ বছরের জন্য গঠিত হলো, আর গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এতটা জল্পনাকল্পনা, তা তো স্বাধীন দেশের জন্য শুভ লক্ষণ হতে পারে না। তাঁদের কর্মকা-ের জন্য দেশের ৪৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি কেন ক্ষেপে গেলেন? দেশের স্বার্থে, না কমিশনের গুরুত্ব বিবেচনায়? আর যাঁদের নিয়ে এতটা মাথাব্যথা, যাঁদের মতানৈক্য বা মতবিরোধের কারণে নির্বাচন কমিশন এখন প্রশ্নবিদ্ধ, আর কোনো মাননীয় কমিশনার যদি স্বচ্ছতার স্বার্থে কাজ করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হন, তাহলে তিনি তো পদত্যাগ করে প্রতিবাদটি দেশবাসীকে অবহিত করতে পারেন, এ সুযোগ তো রয়েছে। তিনি বা তাঁরা পাঁচবছরের জন্য সুযোগ-সুবিধা ভোগের লোভ ত্যাগ না করে কমিশনকে বিতকির্ত করে চলেছেন, দেশবাসী কি তাঁদের ক্ষমা করবে? মাননীয় ব্যক্তিবর্গ প্রথমে দেশের নাগরিক; দ্বিতীয়ত, বিশিষ্ট নাগরিক; তৃতীয়ত, জীবনে সুনাম অর্জন করা নাগরিক; চতুর্থত, স্বনামধন্য নাগরিক; পঞ্চমত, দেশবাসীর পক্ষে অনুসন্ধান কমিটি তাঁদের নাম প্রস্তাবনার মাধ্যমে অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য, সেই অর্থে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নাগরিক; ষষ্ঠত, যে দায়িত্বপ্রাপ্তি লাভ করেছেন, তারপর সংবিধানগত এবং আপনপ্রজ্ঞার আলোকে অবশ্যই প্রশ্নাতীত নিরপেক্ষ নাগরিক। সুতরাং তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় সম্মানিক শ্রদ্ধেয় আদর্শবান ব্যক্তি। এ সম্মান লাভ মানুষের ভাগ্যে দুর্লভ। তাঁরা প্রাত:স্মরণীয় না হলেও স্মরণীয়, বরণীয় ও আদর্শের ঠিকানা। তাঁরা যদি বিতর্কিত হয়ে যান, তবে দেশবাসী কাদের উপর নির্ভর করবে?
তর্কের একপর্যায় একজন বললেন-‘এটা তো কোনো ফুটবলের টীম নয় যে, বিদেশ থেকে খেলোয়াড় অর্থমূল্যে আনা যাবে? আমাদের বিশ্বাস যাঁরা ভঙ্গ করলেন, তাঁদের হয়ত জবাবদিহিতা করতে হবে না। কিন্তু অর্জিত স্থান থেকে যে চ্যুত হলেন, মহাবীর অভিধায় নিজেকে প্রমাণিত করার সুযোগও গ্রহণ করলেন না, পদে থেকে পাঁচবছরের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যদি দেশের অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেন, তার দায় কার? এজন্যই কি ৪৭জন বিশিষ্ট ব্যক্তির আবেদন ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎপ্রার্থী?
বর্তমানে একজন মাননীয় কমিশনার নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাঁর উষ্মা প্রকাশ করে পদত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টি একটু ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ, তিনি যদি পদত্যাগ করতে চান তবে কাদের কাছে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন? কেউ বা কোন শুভাকাক্সক্ষী কি বলবেন যে পদত্যাগ করুন অথবা করবেন না? এই পর্যায়ে এই অবস্থানে থেকে নিজের বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হওয়াই সমীচীন।
জানি না, নির্বাচন কমিশন নিয়ে আড্ডায় আলোচিত তর্ক-বিতর্ক বিষয়টি কাগজে-পত্রে লেখা ঠিক হবে কিনা। কিন্তু বিষয়টি ছিল-নির্বাচন, না মনোনয়ন। বাস্তবে তো দেখা যাচ্ছে, যারা ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেয়ে যান, তারা এতটাই বেপেরোয়া হয়ে উঠেন, তাদের ঔদ্ধত্য এতটাই প্রবলতর যে তারা নির্বাচিত হবেনই। তাকে বাধা দেয়ার শক্তি কারও নেই, নির্বাচন কমিশনেরও নেই। ভোটারগণ কেন্দ্রে না গেলেও তারা নির্বাচিত হয়ে যান। আর ভোটপ্রাপ্তির বিষয়টি কমিশন কাগজপত্রে বিধিবদ্ধ করে ঘোষণা দিয়ে দেন। আমরা তখন দেখেশুনে বিষ পান করতে বাধ্য হই। এ বিষয়টি যদি কমিশনের কোনো সদস্য মানতে না পারেন, তবে তিনি প্রতিবাদস্বরূপ পদত্যাগ করে জনতার কাতারে কেন এসে দাঁড়াতে পারেন না?
তখনই অঘোষিত সভাপতি চিৎকার করে বলে উঠলেন-বর্তমানে বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ ও বিশ্বাসহীন করার জন্য কমিশনই দায়ী। দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। উত্তরণ না ঘটলে বঙ্গবন্ধুর ভাষায়-‘স্বাধীনতা অর্থহীন।’ সকলেই আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। আড্ডাটা এভাবেই যবনিকাপাত হলো। তখন মহাকবির বাণী উচ্চারিত হলো-
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’