অপরাধে ঠেলে দিচ্ছে মাদক কারবারিরা .প্রভাবিত করতে পারে স্কুলশিক্ষার্থীদের . দ্রুত নিয়ন্ত্রণের তাগিদ অভিভাবকদের
মাসুদ আলম ।।
কুমিল্লা
টাউন হল মাঠে সন্ধ্যা নেমেছে। পশ্চিম পাশের পুরাতন কাব ভবনের সামনে
দাঁড়িয়ে ঢুলছে নেশাগ্রস্ত দুই শিশু। এই নেশার নাম ড্যান্ডি। জুতার আঠা বা
গাম দিয়ে তৈরি হয় এই মাদক। ড্যান্ডির নেশায় ঘোর শিশুদের একজন বলে, ‘আমি
ভাঙাড়ি টোকাই আর ভিা করি। যেখানে ইচ্ছা, সেখানেই থাকি। ঘরে গিয়া টাকা না
দিলে বাবা-মা ঘর থাইকা বাইর কইরা দেয়।’ আরেক শিশু বলে, ‘মনে অনেক কষ্ট।
হের কারণেই এইগুলা খাই। এইগুলা খাইলে অন্যরকম লাগে। কেউ মারলে গায়ে লাগে
না।’
আরেক দৃশ্য কুমিল্লা নগরীর পূবালী চত্বরে। একটি কুকুরের পাশেই
ঘুমিয়ে আছে ৩ জন পথশিশু। চেহারায় শিশুসুলভ কোমলতা উধাও। সারা দিন ঘোরাঘুরির
পর রাতে ড্যান্ডির নেশা। শীতের সকালে তাই ওদের চোখে রাজ্যের ঘুম। সাথের
একজনকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তারা আঠা
জাতীয় ওই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
এভাবে কুমিল্লায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের
মাঝে মাদকাসক্ত হবার প্রবণতা দিনে দিনে, বিশেষ করে করোনাকালে আশঙ্কাজনকহারে
বেড়েছে। এই শিশুরাই পরবর্তী দিনগুলোতে মাদক কেনাবেচার সাথে জড়িত হয়ে পড়ে।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা শহর এবং
জেলার বিভিন্ন বাস ও রেলস্টেশনে প্রায় পাঁচশতাধিক সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু
রয়েছে। তবে তারা ভ্রাম্যমাণ। অভাব-অনটন, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা,
অশিক্ষা-অনাচার, দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট, ভালো পরিবেশের অভাব আর ¯েœহবঞ্চিত হয়ে
এসব শিশু একসময় নেশায় জড়িয়ে গিয়ে তিলে তিলে নিঃশেষ করছে জীবন।
কুমিল্লা
শহরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ঘুরে সুবিধাবঞ্চিত ও ছিন্নমূল
শিশুদের মধ্যে অনেকের দলবেঁধে মাদকগ্রহণের অপ্রত্যাশিত চিত্র দেখা যায়।
এদের বয়স ৫ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। কুমিল্লার ধর্মসাগর পশ্চিমপাড়, জিলা
স্কুলের দণি গেট, টাউনহল মাঠ, পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড ওভারব্রিজ, জাঙ্গালীয়া
ও শাসনগাছা স্ট্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি স্থানে দেখা যায়, পথশিশুরা প্রকাশ্যে
ড্যান্ডি সেবন করছে। মানবদেহের জন্য তিকারক নেশাজাতীয় রাসায়নিক বস্তু এই
ড্যান্ডি, যা মূলত ড্যানড্রাইড অ্যাডহেসিভ বা আঠালো টলুইনসমৃদ্ধ। এই
অ্যাডহেসিভ মূলত ছোটখাটো ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি, ডিভাইস, চামড়া ও
প্লাস্টিকের পণ্য জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। ড্যান্ডি আঠা তীব্র
ঘ্রাণযুক্ত হয় এবং এর ঘ্রাণ থেকেই এক ধরনের নেশার আসক্তি হয়, যা ধীওে ধীরে
মারাত্মক তির কারণ হতে পারে।
কামাল নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান,
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে এসব মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের অনেকে আবার জড়িত
হচ্ছে ছিনতাই ও মাদক বিক্রির মতো অপরাধ কর্মকা-ে। মূলত অসাধু ব্যবসায়ী ও
মাদক কারবারি ব্যক্তিরাই স্বল্পদামে পথশিশুদের হাতে এসব নেশাজাতীয় দ্রব্য
তুলে দিচ্ছে এবং পরবর্তীতে তারাই এই শিশুদের অপরাধ কর্মকা-ে ঠেলে দিচ্ছে,
কামালের মতো আরো একাধিক সচেতন নাগরিকের এ রকমটাই ধারণা।
পথশিশুদের
নিয়মিত পাঠদান ও বিনোদন দিয়ে আসা সংগঠন ‘দুর্বার ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোক্তা
আরিফ চৌধুরী জানান, কুমিল্লায় জানামতে পাঁচ শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশু
রয়েছে। তবে তারা ভ্রাম্যমাণ। এদের মধ্যে নেশার সাথে জড়িতদের নিয়েও আমরা কাজ
করেছি। তবে করোনার কারণে দীর্ঘদিন এসব পথশিশুকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়নি,
যার কারণে নেশাগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি,
তাদেরকে নিয়ে আবারও কাজ শুরু করতে পারবো শিগগিরই।’
আরিফ চৌধুরী আরও
বলেন, ‘এসব শিশুর বিপথগামী হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণÑ তাদের জন্য
পুনর্বাসনকেন্দ্র নেই। বেঁচে থাকার অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকেও তারা
বঞ্চিত। তাছাড়া করোনাকালে শিাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিশুই আমাদের
প্রতিষ্ঠান থেকে ছিটকে পড়েছে, যার কারণে শহরের আশেপাশে পথশিশুদের অপরাধ
কর্মকা- বেশি পরিল্িযত হচ্ছে।’
সন্তানকে কুমিল্লা জিলা স্কুলে ভর্তি
করাতে আসা একজন অভিভাবক জাকারিয়া ইসলাম বলেন, ‘স্কুলের ছোট্ট শিশুদের সামনে
পথশিশুদের এভাবে প্রকাশ্যে মাদক সেবন ওদেরকেও কৌতূহলী করে তুলতে পারে, যা
তাদের চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলবে। তাই, একজন অভিভাবক হিসেবে পথশিশুদের
এভাবে প্রকাশ্যে মাদকগ্রহণ বন্ধে প্রশাসনের শুভদৃষ্টি কামনা করছি।’
কুমিল্লা
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া বলেন,
মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনে কুমিল্লায় কোনো কেন্দ্র নেই। নেশাগ্রস্ত
পথশিশুদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আমরা কিছু করতে পারছি না।
তবে, নেশাগ্রস্ত এই সব শিশুদের খুঁজে খুঁজে ঢাকায় পুনর্বাসনকেন্দ্রে
পাঠানোর চেষ্টা করবো আমরা।’
জানতে চাইলে শিা ও আইসিটি বিষয়ক অতিরিক্ত
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন কুমিল্লার কাগজকে বলেন, পথশিশুরা মাদক
সেবন করছেÑ এটা নিঃসন্দেহে নেতিবাচক দিক। তাছাড়া পথশিশুদের সঠিক তথ্য ও
সঠিক সংখ্যা না থাকাটাও সমস্যা সমাধানে একটা অন্তরায় হতে পারে। পথশিশুদের
এভাবে ড্যান্ডি সেবন বন্ধে প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।