শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ।।
একজন
ব্যক্তির ‘ব্যক্তিত্ব’ হলো তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম অনুষঙ্গ।
ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তি দুর্বলচিত্তের ও আদর্শহীন হয়ে থাকেন। প্রথমত মনে হতে
পারে ব্যক্তিটি সরল-সহজ। এরূপ মনে হলেও তাকে কোনো অবস্থায় বিশ্বাসযোগ্য
ধরা যায় না। কারণ, ব্যক্তিজীবনে নানা ধরনের অলংকার থাকে, তা কোনো বাহ্যিক
সৌন্দর্য হিসেবে ধর্তব্য নয়, তা মানসিক দৃঢ়তার উপর অঘোষিত সৌন্দর্য বা
অলংকার। এই অলংকার যার মধ্যে বর্তমান থাকে, তিনি স্বভাবগুণেই নমস্য ও
মান্য। কাজেই ‘ব্যক্তিত্ব’ হলো ব্যক্তির জ্যোতি। তা নিজেকেই আলোকিত করে না,
তার জ্যোতিতে ব্যক্তি-সমাজ-জাতি আলোকিত হয়। এরূপ ব্যক্তিরা ক্ষণজন্মা। যার
ব্যক্তিত্ব আছে, তিনি সাহসী ও দূরদর্শী। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধুর জীবনের কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই।
১. ১৭ মার্চ
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে তিনি ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ-এর
টঙ্গীপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
গোপালগঞ্জ-মাদারীপুর-কোলকাতা ও ঢাকায় পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবন থেকেই
রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুসলিম ছাত্রলীগের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে
আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
বন্ধবন্ধুর ব্যক্তিত্ব
স্ফূরণের প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে
ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে আগমন উপলক্ষে
কংগ্রেসের বাধানিষেধ সত্ত্বেও তিনি সফলভাবে তাঁদের সংবর্ধনা প্রদান
করেছিলেন।
২. আবার ১৯৪৯ সালে ৭মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ
শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশে ধর্মঘট ঘোষণা করলে
ছাত্রদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানান। এজন্য ২৬ মার্চ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রকে শাস্তি দেয়। বঙ্গবন্ধু তখন
আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র (রোল-১৬৬, এস এম হল)। তাঁকে ১৫ টাকা জরিমানা
করা হয়। ১৮ এপ্রিলের মধ্যে জরিমানা ও অভিভাবক কর্তৃক প্রত্যায়িত মুচলেকা
প্রদান না করলে ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যাবে-এরূপ ঘোষণা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু
এটাকে অন্যায্য মনে করেন এবং জরিমানা ও মুচলেকা দিতে অস্বীকার করেন। এখানেও
তাঁর ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ লক্ষ্য করা যায়।
৩. ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন
আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত
হয়। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। তারপরও তাঁকে দলের ১নং যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত করা
হয়। ক্রমান্বেেয় তিনি দলের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক
নির্বাচিত হন ১৯৫৩ সালের ৫ জুলাই তিনদিনব্যাপী (৩-৫ জুলাই) প্রথম
দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলর অধিবেশনে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালে ২১-২৩ অক্টোবর
আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিলের ২য় দিনের অধিবেশনে দলের
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি
প্রত্যাহারের প্রস্তাব পেশ করলে কাউন্সিলারদের অনুমোদনক্রমে অসাম্প্রদায়িক
রাজনৈতিক দল হিসেবে এর নতুন নামকরণ হয় ‘আওয়ামী লীগ’। সময়ের প্রেক্ষাপটে
মুসলিম প্রধান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আট বছরের মধ্যে দলের নামকরণ থেকে
‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া এবং দলকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে তার চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্যে উন্নীত করা অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর ‘ব্যক্তিত্ব’ স্ফূরণের পরাকাষ্ঠা।
৪.
এই ব্যক্তিত্বের অমোঘ শক্তিই বঙ্গবন্ধুকে সারাজীবন আপসহীন করে তুলেছিল।
যার ফলে আউয়ুব খানের সামরিক শাসনের মধ্যেই তিনি ৬-দফা পেশ করতে পেরেছিলেন
এবং পূর্ববাংলা তথা পূর্ববঙ্গকে যখন পূর্বপাকিস্তান করা হয়, তখন তিনি প্রবল
আপত্তি করেন। পাকিস্তান আমলে মন্ত্রী হয়েও দলের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে
তা ত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি। তিনি জানতেন যে, আদর্শবাদী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন
ব্যক্তির কোনো পরাজয় নেই। সেই ব্যক্তিত্বধারী স্বদেশপ্রেমিক মাথা উঁচু করে
বলতে পেরেছেন-
‘এই দেশ আমার, এই মাটি আমার, এই নদী আমার, এই দেশের
সত্যিকার মুক্তির জন্য, এই মাটির আজাদীর জন্য, এই বাতাসকে নির্মল করার
জন্য, এ নদীতে জোয়ার আনার জন্য আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে যাবে। শেখ মুজিবকে
ফাঁসি দেওয়া সম্ভব; কিন্তু এই ফাঁসির রক্তের প্রতি ফোঁটা থেকে লক্ষ মুজিব
জন্ম গ্রহণ করে সংগ্রামকে জোরদার করবে।’
‘ব্যক্তিত্ব’-শক্তির কতবড়
আত্মবিশ্বাস যে, পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে ১৯৬৯ সালে ৫ ডিসেম্বর ঘোষণা
দিলেন-‘আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশটির নাম হইবে
পূর্বপাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ’। শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ সালের
নির্বাচন, নির্বাচনে নিরংকুশ জয়লাভ, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ
এবং ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন ও বাংলাদেশের জন্মলাভ-সবই
ব্যক্তিত্ব-বিকাশের অভিযাত্রা।
৫. বঙ্গবন্ধুর ‘ব্যক্তিত্ব’ বিকাশের
একটি চমৎকৃত অধ্যায় হলো সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং কথোপকথন।
বাদশাহ ফয়সাল যখন বললেন-‘আমি শুনেছি যে বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু
সাহায্য প্রত্যাশী। আপনারা কোন ধরনের সাহায্য চান, আপনারা কী চান।’
বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিলেন-‘আমার তো মনে হয় না মিসকিনের মতো বাংলাদেশ আপনাদের
কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছে।’
বলেন-ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে
দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। সৌদি আরব আজ পর্যন্ত স্বাধীন ও
সার্বভৌম বাংলাদেশের কেন স্বীকৃতি দিচ্ছে না? যেজন্য ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে
বাংলাদেশের মুসলমান পবিত্র হজ্ব পালন করতে হয়। সৌদি বাদশাহ কিছু শর্ত দেন-
১. সৌদির স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপালিক অব বাংলাদেশ করতে হবে।
২. অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু সৌদি বাদশাহকে জানিয়ে দেন-
১.
আপনাদের দেশের নাম তো ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক সৌদি আরব না। এই মহান দেশের
নাম আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও রাজনীতিবিদ মরহুম বাদশাহ ইবনে
সউদের সম্মানে ‘কিংডম অব সৌদি আরাবিয়া’। কই আমরা কেউ তো এ নামে আপত্তি
করিনি।
২. বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ
দেশে প্রায় এক কোটির মতো অমুসলিম রয়েছে, সবাই একই সঙ্গে একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধে হয় শরিক হয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পোহায়েছে। আল্লাহ শুধু
মুসলমানদের নন, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনিই হচ্ছেন সব
কিছুর একমাত্র ¯্রষ্টা।
৩. বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয়
ব্যাপারে অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। এসবের মীমাংসা কিছুটা সময় সাপেক্ষ
ব্যাপার। তাই বিনা শর্তে ৯১ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেয়ার
প্রশ্নটি পৃথকভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না।
আলোচনার শেষ পর্বে বঙ্গবন্ধু একটি আরবি কথার উল্লেখ করে বলেছিলেন-‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার।’
এই আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্বের উচ্চতা কী দিয়ে পরিমাপ করা যায়, তা আমাদের এখনও জানা হয়নি।
৪.
যে ভারত সর্বক্ষণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন পাশে ছিলো, আশ্রয় দিয়ে, এককোটি
শরণার্থীকে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে দিয়ে, মিত্রবাহিনী হিসেবে যুদ্ধে সহায়তা
দিয়ে, সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে, আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের
স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত আদায়ের জন্য এতকিছু করেছেন, তারপরও পাকিস্তানের
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ভারতের মাটিতে
দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, যিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম
বন্ধু, তাঁকে বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘আপনার সৈন্যদের কখন ফিরিয়ে আনবেন?’
শুধু
বলব- তা একমাত্র বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বধারীর পক্ষেই এই নির্মোহ
উচ্চারণ করা সম্ভব। বিশ্বে এটি অদ্বিতীয় ঘটনা বৈ আর কি।
৫. জনাব
ভুট্টো যখন ইয়াহিয়া খান থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেণ্ট ও
প্রধান সামরিক শাসক হলেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে সরকারি
ব্যবস্থাপনায় হোটেলে স্থান করে দেন এবং ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার
জন্য সাক্ষাৎ করেন। ভুট্টো যখন বললেন, ‘শেখ মুজিব, আপনার সঙ্গে বর্তমান
পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বললেন-‘আগে বলুন, আমি
বন্দি না মুক্ত’। ভুট্টো বলতে বাধ্য হন যে, ‘আপনি সম্পূর্ণ মুক্ত এবং আপনি
যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন।’
আমরা জানি, নয় মাস পাকিস্তানি জান্তাসরকার
বঙ্গবন্ধুকে এতটাই মানসিক শাস্তি দিয়েছিল, কোনো মানুষ এ অবস্থায় সুস্থ
থাকার কথা নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের মহিমা এতটাই দৃঢ় ছিল, তিনি
মৃত্যুকেও ভয় পাননি।
৬. এমন কি ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ যখন বিপথকামী বৈইমান
সৈন্যরা ৩২নং ধানম-ি বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে
বাড়ি অনুপ্রবেশ করে তখন বঙ্গবন্ধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন বললেন-‘তোরা কি
চাস?’ বন্দুকধারীর হাত ও গলা কেঁপে উঠেছিল, পেছন থেকে জনৈক মাতাল
মোসলেউদ্দিন অতর্কিতে গুলি চালায়।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের মহিমা উল্লেখ
করতে হলে গোটা একটি বই লেখা যায়। মহিমান্বিত ব্যক্তিত্বধারী বঙ্গবন্ধুর
বিশ্বখ্যাত একজন উজ্জ্বলতম চিরকালীন নক্ষত্র হিসেবেই প্রতিভাসিত।
অসাম্প্রদায়িক
চেতনা-বিশ্বাসের প্রাণ-পুরুষ হলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন নির্ভেজাল মানবতাবাদী রাষ্ট্রনেতা। তিনি
প্রবলভাবে মানুষকে ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। নি:সন্দেহে মানবিক
গুণাবলীর এরূপ ক্ষণজন্মা মানুষের আবির্ভাব সবসময় হয় না। তাঁরা কখনও
ধর্মীয়নেতা হিসেবে, কখনও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যুগের প্রয়োজনে আবির্ভূত হন।
কিন্তু তাঁদের শেষ বিদায় দৃশ্যত নিষ্ঠুরতায় ভরা। শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয়
মুষলের আঘাতে, চৈতন্য মহাপ্রভু নিহত হন ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশক্তির ইঙ্গিতে,
যিশুখ্রিস্টকে হত্যা করা হয় ক্রোশবিদ্ধ করে। মানবতাবাদী রাজনৈতিক যুগপুরুষ
তথা মহাত্মা গান্ধী-লিয়াকত আলী খান, লুথার কিং আলেন্দে, সুকর্ণ, কেনেডি,
ইন্দিরাগান্ধী প্রমুখকে হত্যা করা হয় পাশবিক উত্তেজনায় ও মানবতাকে ধ্বংস
করার অভিপ্রায়ে।
উপর্যুক্ত যাঁদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, তাঁরা
দৃশ্যত নিহত, স্পষ্টত অনন্তকালীন বর্তমান। এর কারণ হলো-মানুষ প্রথমত জীব
অর্থাৎ পশু। পশুত্বকে পরাজিত করেই মানুষ অর্থাৎ মান+হুঁশ। পৃথিবীতে তথাকথিত
মানুষ কিন্তু অধিকাংশই পশু থেকে যায়, এখনও। তারা ভালোবাসা বুঝে না,
বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে জানে না, পারে না। এই হায়েনা অমানুষদের চিনতেন
কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি জানতেন-পশুরা তাঁকে হত্যা করতে
সদা সচেষ্ট। তাই তিনি আটজন দেহরক্ষী নিয়ে চলতেন। ড্রাইভারের পাশে দু’জন এবং
একেবারে পেছনের সিটে চারজন। আর মধ্যে যেখানে কমরেড কাস্ত্রো বসতেন, তার
দু’পাশে দু’জন। এছাড়া সামনে ও পেছনের অন্য গাড়িতে থাকত বিশেষ কমান্ডো
প্লাটুন। অথচ কিউবার জনগণ তাঁকে দ্বিতীয় ঈশ্বর বলেই জানতো, মানতো, সম্মান
করতো, শ্রদ্ধা করতো-দরকার বোধে তাঁর জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। এত
ভালোবাসা ও বিশ্বাসের পরও ফিদেল কাস্ত্রো সারাজীবন এভাবেই পাহারারত অবস্থায়
থাকতেন, চলাফেরা করতেন দেশ-বিদেশে। এই ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর
সাক্ষাৎ-চিত্রটি নি¤œরূপ-
‘গালভর্তি চাপদাড়ি, মাথায় গেরিলা টুপি আর পরনে
জলপাই রঙের আধাসামরিক পোশাক। প্রায় ছয় ফুট লম্বা ফিদেল কাস্ত্রো যখন চুরুট
হাতে গাড়ি থেকে নেমেই সহাস্য বদন বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে, তখন অমায়িক হাসি
উদ্ভাসিত হলো তাঁর মুখে। এরপর পরস্পর উষ্ণ আলিঙ্গন আর চুম্বন।’
ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘এক্সিলেন্সি, আপনাকে অত্যন্ত আপনজন মনে করেই আজ কয়েকটি কথা বলব’।
বঙ্গবন্ধু
ফিদেল কাস্ত্রোকে বাংলাদেশ ও নিজের অকৃত্রিম শুভাকাক্সক্ষী এবং বন্ধু বলেই
জানতেন। তাই বললেন-আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন। কাস্ত্রো সরাসরি বললেন-‘চিলির
প্রেসিডেণ্ট আলেন্দের মতো আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিবকেও খরচের
খাতায় রেখে দিয়েছি।’ বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছেন-‘হঠাৎ একথা বলছেন কেন?’
স্পষ্টভাবেই বললেন-‘একটি পরাজিত প্রশাসনকে আপনি বাংলাদেশে আইনসংগত করেছেন।
তারা যতই অভিজ্ঞ হোক না কেন, তারা পরাজিত শক্তি।’ অনেক কথার পর কাস্ত্রো
বললেন-‘ঈশ্বরের দোহাই, আপনার মুক্তি ছেলেদের আরো দায়িত্ব দিন, তাদের পুরো
বিশ্বাস করুন। না হলে আপনি শেষ।’ কিউবার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন- মহান
বিপ্লরের অব্যবহিত পর কমরেড চে গুয়েভারা স্বয়ং কিউবার পরাজিত প্রশাসনকে
নিশ্চিহ্ন করে একেবারে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছেন।
নিজের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন-
‘ডিক্টেটর
বাতিস্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের সময় আমরা একই বাংকার থেকে যুদ্ধ
করেছি। এ সময় খাদ্য, বিছানা-সব একসঙ্গে ভাগ করেছি। আপনি ধারণাও করতে পারবেন
না এঁরা আমাকে কত ভালোবাসে। ‘আমি চুরুট খাই’ আমার ছেলেরা প্রথমে এটা টেস্ট
করে। সিআইএর বিষক্রিয়ায় দুজন তো মরেই গেল। বাংলাদেশে আপনি কাদের বিশ্বাস
করেছেন?’
বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছিল রাশিয়া ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা,
স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধু কোনটাই আমলে নেননি। মানবিকতাবাদী উদারচেতা
আত্মবিশ্বাসী প্রেমিক বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কূটচক্রান্তের কাছে যে অপাংক্তেয়
তা তিনি জানতেন না, জানেন নাই, জানতে পারেন নাই। শুধু ২০২১ সালের ১৭ মার্চ
বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিনে ফিদেল কাস্ত্রোর ভাষায় বলতে পারি-
‘কমরেড মুজিব, আমি তোমায় ভালোবাসি-তোমায় ভালোবাসি। বাংলাদেশকে ভালোবাসি।’