ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বঙ্গবন্ধুর বিস্মৃত জাপানি বন্ধু ও ভক্তরা   
Published : Wednesday, 17 March, 2021 at 12:00 AM
বঙ্গবন্ধুর বিস্মৃত জাপানি বন্ধু ও ভক্তরা   প্রবীর বিকাশ সরকার  ।।

সন্দোহতীতভাবে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশায় তার বিদেশি বন্ধু ও ভক্তদের মধ্যে জাপানিরাই ছিলেন অধিক সংখ্যক। তাঁদের মধ্যে কতিপয় উল্লেখযোগ্য জাপানি নাগরিককে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়াসেই এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ।
 
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি জাপান এবং সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যকার উজ্জীবিত সম্পর্ক এবং উন্নয়নমূলক সম্ভাবনার ভিতকে প্রবলভাবেই প্রকম্পিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এশিয়ার নতুন শিল্পোন্নত রাষ্টসমূহ যথা দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের আগেই বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে যেত শক্তভাবেই। সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত কিছু দলিলপত্র এই ধারণার জন্ম দেয়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যা বাঙালির বহু বছরের অভীষ্ট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দুয়ার উন্মোচন করেছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জাপানের উৎপাদনমুখী সৃজনশীল শিক্ষার প্রসার ঘটত বাংলাদেশে যা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ কাক্সিক্ষত বিষয়।

বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানাতে ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সাতোও এইসাকু কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ঢাকায় পাঠান, তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক, গবেষক এবং রাজনীতির গুরু তানাকা মাসাআকি যিনি ছিলেন বিপ্লবী বিহারী বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং টোকিও ট্রাইব্যুনালখ্যাত বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের ঘনিষ্ঠ। অন্যজন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সাংসদ এবং প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকাশি। হায়াকাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম জাপানি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং জাপান সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বীকৃতি দেবার জন্য। জাপান-বাংলাদেশের শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মূলত হায়াকাওয়া তাকাশির কল্যাণেই। তিনি বাংলাদেশকে এতই ভালোবেসেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর চিতাভস্মের একাংশ ঢাকার বৌদ্ধরাজিক মন্দিরে সংরক্ষণ করা হয়েছে তার ইচ্ছানুসারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানে তার সক্রিয় ভূমিকা অবিস্মরণীয়। হায়াকাওয়ার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ না হলেও তাঁর সহযোগী তানাকা মাসাআকির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। যাঁর শিয়রের কাছে সবসময় থাকত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দনরত একটি আলোকচিত্র, এতেই বোঝা যায় শেখ মুজিব তাঁর কাছে কী রকম মানুষ ছিলেন! ১৯৭২ সালেই তিনি জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন এবং তার প্রেসিডেন্ট হন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত এই সংগঠনের ব্যাপক কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। হায়াকাওয়া ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু তিরোধানের পরও তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতার হাত প্রসারিত রেখেছিলেন। তৃতীয়জন হচ্ছেন জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনির অবসরপ্রাপ্ত লে.কর্নেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, যিনি সেনাবাহিনির হিকারি কিকান নামে একটি বিশেষ ইন্টেলিজেন্স দলের প্রধান ছিলেন এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোগী যোদ্ধা ছিলেন ঐতিহাসিক ইম্পেরিয়াল অভিযানে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁরও সাক্ষাৎ ঘটেছিল সেই সফরের সময়।    

প্রয়াত রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া তাকাশির মহীয়সী স্ত্রী হায়াকাওয়া মোতোয়ার সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে তিনি বঙ্গবন্ধু ও স্বামীর বন্ধুত্বকে কখনোই বিস্মৃত হননি। দুদেশের সম্পর্ককে জোরালো করার জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। ঢাকার সোনার গাঁও হোটেলে হায়াকাওয়ার একটি স্মৃতিফলক খোদিত আছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরপরই তিনি জাপানে জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই হত্যাকা-ের জোরালো প্রতিবাদ এবং শোকসভার আয়োজন করেছিলেন। মৃত্যু পর্যন্ত অভিন্নহৃদয়বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শোক তিনি বিস্মৃত হননি। একটি নাতিদীর্ঘ স্মৃতিকথা তিনি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর শোক সভায়।  

মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানে জনমত এবং তহবিল গঠনে যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন হায়াকাওয়া ছাড়াও তাদের  তালিকা দীর্ঘ হবে যদি সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা যায়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড.ৎসুয়োশি নারা, অধ্যাপক কাজুও আজুমা, প্রভাবশালী দৈনিক সানকেই শিম্বুন পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক তানাকা তোশিহিসা, এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত তিব্বতী ছাত্র বর্তমানে অধ্যাপক, গবেষক এবং রাজনীতিবিদ ড.পেমা গিয়ালপো প্রমুখের নাম করা যায় যাঁরা বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম বন্ধু ও ভক্ত। মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী অধিকাংশই এখন আর জীবিত নেই। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে বাংলাভাষপ্রেমী অধ্যাপক ৎসুয়োশি নারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন জাপানি ভাষা শিক্ষা অনুষদ ১৯৭৪ সালে। জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক আজুমা মৃত্যু পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বুকে ধারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুহত্যাকা- তাকে  এতই বেদনাবিদ্ধ করেছিল যে যেকোনো বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হলেই তাকে অভিযুক্ত করে বলতেন, “আপনারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী! কী অপরাধ তিনি করেছিলেন যে এরকম নৃসংশভাবে তাঁকে হত্যা করেছেন?” অধ্যাপক নারা ও অধ্যাপক আজুমা দুজনেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দোভাষী এবং এই ১৯৭৩ সালেই তাঁরা পরস্পর বঙ্গবন্ধুর আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন।   

নব্বইয়ের প্রথম দিকে একটি গ্রন্থ আমাকে ভীষণভাবে চমকে দিয়েছিল! গ্রন্থটি আমার বাসস্থানের নগর গ্রন্থাগারে খুঁজে পেয়েছিলাম। বইটির নাম ‘চি তো দোরো তো বাংগুরাদেশু: দোকুরিৎসু নো হিগেকি’ অর্থাৎ ‘রক্ত, কাদা বাংলাদেশ: স্বাধীনতার ট্রাজেডি’ লেখক ফুকিউরা তাদামাসা, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রাক্তন কর্মকর্তা, অধ্যাপক ও বিশিষ্ট পতাকা গবেষক। উক্ত গ্রন্থে লেখক মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথাই লিখেছেন। তিনি কয়েক মাস যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন রেডক্রস কর্তৃক প্রদত্ত আহত-নিহতদের সেবাশুশ্রƒষাদানকারী প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তো সহযোগিতা করেছেনই এমনকি, স্বাধীনতার উষালগ্নটিও তিনি সচক্ষে দেখার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি সৌভাগ্যবানও বটে কারণ ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি যখন বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সংবর্ধনা মঞ্চে ফুকিউরাকে আলিঙ্গন করেছিলেন। বঙ্গভবনেও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি সেখানেই দুজনে গভীর বন্ধুত্বে বাঁধা পড়েন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় তাঁকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানান। ২০১০ সালে আমি যখন তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি তিনি অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। আজও তিনি তাঁর বন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তাঁর ভাষায় “এশিয়ার সিংহহৃদয় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।” তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু স্তব্ধ করে দিয়েছিল তাকে! ২৬ শে আগস্ট তারিখে ক্যাপিটাল তোক্কিউ হোটেলে জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন এবং জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি লীগ যৌথভাবে এক শোকসভার আয়োজন করে। শোকবাণী পাঠ করেন হায়াকাওয়া তাকাশি। তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় এই হত্যাকা-ের। ফুকিউরা এই অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য ছিলেন তখন। তিনি নিজেও একাধিকবার প্রতিবাদ জানান গণমাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে বলেছিলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে আমি বাংলাদেশকে চিনেছিলাম। তার দেশপ্রেম এবং দেশগঠনের চিন্তা আমাদেরকে অভিভূত করেছিল। হায়াকাওয়া স্যারের দেশের বাড়ি ওয়াকায়ামা-প্রিফেকচারে টোকিও থেকে বহু দূরে জাহাজে চড়ে যাওয়ার সময় শেখ মুজিব দেশ ও জাতি গঠনের স্বপ্ন বার বার আমাদের বলছিলেন। ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ জাপানের সহযোগিতা চেয়েছিলেন এবং জাপান দারুণ সাড়াও দিয়েছিল।”

অনুরূপ কথা অধ্যাপক আজুমার কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছিল তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলার সময়, জাহাজে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জাপানি-বাংলা ভাষার দোভাষী। আজুমা স্যার মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমাকে একটি পেপার-কাটিং দিয়েছিলেন সেটাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর বিদ্যমান বহু বছর যতœ করে রেখেছিলেন তাঁর দরকারি দলিলপত্রের ফাইলেÑকতখানি ভালোবাসতেন তিনি তাকে! আজুমা দম্পত্তি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জন্য সবসময় চিন্তিত থাকতেন কখন আবার দুঃসংবাদ শোনেন ১৫ই আগস্টের মতো! স্যারের সঙ্গে দেখা হলেই আমার কাছে খবর জানতে চাইতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কেমন আছেন? এতেই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের দরদ কত গভীর ছিল।

প্রবীণ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ইশিকাওয়া তামোন এখনো স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে কারাবন্দি করলে জাপানে তাঁর মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছিলেন ছাত্রাবস্থায়। অথবা জাপানের সবচেয়ে বড় এনপিও ‘শাপলা নীড়’ এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গ্রাফিক ডিজাইনার ফুকুজাওয়া ইকুফুমি বঙ্গবন্ধুর একজন অকৃত্রিম ভক্ত। ১৯৭২ সালেই জাপান সরকার কতিপয় তরুণ স্বেচ্ছাসেবীকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেছিলেন। তারা গ্রামেগঞ্জে কৃষিকাজের জন্য জাপান সরকারেরই প্রদত্ত অনেকগুলো মিনি ট্রাক্টর চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন কয়েক মাস বিভিন্ন জেলায় গ্রামীণ কৃষকদেরকে। এই প্রশিক্ষকদের অন্যতম প্রধান ছিলেন ফুকুজাওয়া। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধুর দেশগড়ার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাপানে ফিরে একটি সংগঠন গঠন করেন ঐইঈ তথা হেল্প বাংলাদেশ কমিটি। যা পরবর্তীকালে ‘শাপলা নীড়’ এনজিও হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং আজও কার্যরত। তারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত পোস্টার।

জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের পুরনো মুখপত্র পাঠ করলে আশ্চর্য হতে হয় যে, কী বিপুল আগ্রহ ছিল স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে জাপানের শতাধিক প্রভাবশালী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে আর্থিক-বাণিজ্যিক উন্নয়নের জন্য যার নজির মেলা ভার
বঙ্গবন্ধুর কথা আজও জাপানের প্রবীণ রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, গবেষক ও বাংলাভাষাপ্রেমীদের মুখে শোনা যায়।

শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

    ১১:৪৮ অগ (১ যড়ঁৎ ধমড়)