খালেদ চৌধুরী ।।
“সময়ের কাছে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয়”। এটাই ক্ষণিক পৃথিবীর নিয়ম। মানুষ বাঁচতে চায়-হাজার বছর কিংবা তাঁরও অধিক। রক্ত মাংস শত বর্ষেই ক্ষয়ে যায়। কিন্তু মানুষের মাঝে হাজার বছর কেন? অনন্তকাল বেঁচে থাকা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই এক নাম যিনি বাংলাদেশের সমার্থক। প্রদীপ যেরকম আলো বিলিয়ে আলোকিত করে জনপথ। তিনি বাঙালির মস্তকে রাজটিকা দিয়েছেন। হৃদয় জাগিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ডাকেই বাঙালি হাসি মুখে বিলিয়ে দেয় প্রাণ।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে-বিশেষণের পর বিশেষণ যোগ করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিশেষণটি শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্য সংরক্ষিত। সেখানে আর কোনো অংশীদার নেই। উপমহাদেশে জাতির পিতার অভিধা মহাত্মা গান্ধী, জিন্নাহ যত সহজে পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কিন্তু লড়াই এবং সংগ্রামের ভিতর দিয়ে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। খুব সহজেই অন্য নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা অনুধাবন করা যায়। মহান নেতাদের বিলেত ফেরত ব্রিটিশ শিক্ষার সনদ থাকলেও বঙ্গবন্ধু যেন ইচ্ছে করেই সে পথে হাঁটেননি। মাটি ও মানুষ ছিল বঙ্গবন্ধুর শিক্ষালয়। মানুষের ভালোবাসাই জাতির পিতার মূল শক্তি। আমৃত্যু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।
এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালে শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান আর মাতা সায়রা খাতুন। তাকে খোকা নামেই ডাকতেন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। জাতির পিতার শত্র”রা অনেকেই জানে না-বায়েজিদ বোস্তামি (র.) সফরসঙ্গী শেখ আউয়ালের অষ্টম বংশধর ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ বাড়িতেই অর্জন করেন। শারীরিক অসুস্থাতার জন্য শিক্ষায় কয়েক বছর ব্যাঘাত হয়। ১৯৩৭ সালে পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন কাজী আব্দুল হামিদকে। যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আব্দুল হামিদ মাস্টারের কাছে প্রাথমিক রাজনীতির শিক্ষা পান। সেই বয়সেই ব্রিটিশদের এদেশে থাকার অধিকার নাই, রাজনৈতিক সচেতনতা বঙ্গবন্ধুর তৈরি হয়। ছোট বয়সেই গরিব অসহায় মানুষের সহযোগিতায় নিবেদিন প্রাণ ছিলেন খোকা। বঙ্গবন্ধুর বাবাও চাইতেন তিনি সত্যিকার অর্থে মানুষের বন্ধু হয়ে উঠুক। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলাতেই আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার রাজনৈতিক জীবন শুর” হয়। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফর করেন। সেই সময় সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কিশোর মুজিবের পরিচয়। তিনি ১৯৪২ সালে অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্্িরক পাস করার পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। তিনি বেকার হোস্টেলে থাকতেন। তখন থেকেই প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতা এবং অন্যান্য গুণাবলীতে মুগ্ধ হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। দেশভাগের সময় কলকাতায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হয়। শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই দাঙ্গা পরিস্থিতিতে মানুষের সহযোগিতা করেন। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের জন্য সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কাজ করেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানুষের সেবা করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য। পাকিস্তান ভারত পৃথক হয়ে যাবার পর ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় শক্তি ভাষা। ’৪৭ সালের পর বাঙালি তার ভাষাকে কেন্দ্র করেই ১৯৫২ সালে রক্তের বিনিময়ে ভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করে। তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের মানুষ সব সময়ই শাসককে শুধু দিয়ে গেছে। ইংরেজ পূর্ববর্তী সময়ে বাঙালির অর্থেই মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্জিখানা সমৃদ্ধ ছিল। পূর্ব বঙ্গের অর্থেই ইংরেজরা কলকাতা নগরী গড়ে তোলে। ’৪৭ পরবর্তী অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ নতুন করে বলার কিছু নেই। শেখ মুজিবকে কৈশোর থেকেই আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রতিবাদী ছিলেন। কোথাও অন্যায় হয়েছে আর শেখ মুজিবুর রহমান মুখ বুঝে সহ্য করেছেন; এরকমটা আমরা তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে কোথাও পাই না। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থাায় হোস্টেলের ছাদ সংস্কারের দাবি নিয়ে মন্ত্রীদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। চিন্তা করা যায়! বঙ্গবন্ধু ন্যায্য দাবি আদায় করেছিলেন। শেরেবাংলা তাঁর ঐচ্ছিক তহবিল থেকে বারশো টাকা হোস্টেলের নামে মঞ্জুর করেছিলেন। পরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে ডাকবাংলোয় ডেকে নিয়ে কথা বলেন। মানিকে মানিক চিনে। সোহরাওয়ার্দী সে দিন সঠিক কাজটি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন পূর্ব বাংলার কণ্ঠস্বর। সেই থেকেই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এক নতুন পথ চলা শুর” হয়। আমরা জানি, ’৪৭ উত্তর এবং ’৪৭ পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সংগ্রামে তাঁরা কত কাছের ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে মহান নেতা সোহরাওয়ার্দীর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই বুঝতে পারি রাজনৈতিক মানস গঠনে এবং রাষ্ট্র চিন্তায় সোহরাওয়ার্দীর প্রভাব কতটুকু ছিল। বঙ্গবন্ধু-হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর-জ্ঞানসমুদ্র থেকে মণি-মুক্তা সংগ্রহ করে বাংলার মাটি ও মানুষের মনস্ততত্ত্বের সঙ্গে সমন্বয় করে নিজের রাষ্ট্রদর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। যা অন্য কারও সঙ্গে মিলে না। স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ৬ দফা আন্দোলনে আমরা দেখতে পাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এর প্রভাব স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মূলে ছিল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন।
শেখ মুজিবুর রহমানের যে গল্পটি পূর্ব পশ্চিমের বৈষম্যের বির্তকটাকে জনপ্রিয় করে, “এক বাবার দুই সন্তানের মধ্যে একটি ছিল বোকা আর একটা ছিল চরম ধুরন্ধর। মৃত্যু কালে বাবা দুই সন্তানের জন্য একটি কাঁথা, একটি গাভী ও একটি খেজুর গাছ রেখে যায়। বাবার ইচ্ছে ছিল দু’ভাই সমান ভাবে এই সম্পদগুলো ভোগ করবে। বাবার মৃত্যুর পর ধুরন্ধর ভাইটি এই সীমিত সম্পদের এমনভাবে ভাগাভাগি করল যে বোকা ভাইটি পেল গাভীর মুখ, খেজুর গাছের গোড়া আর দিনের বেলা কাঁথা রাখার অধিকার। ফলশ্র”তিতে বোকা ভাইটি না পেল গাভীর বিন্দুমাত্র দুধ, না পেল খেজুরের সামান্য রস, না শীতের কাঁথার সামান্য আগুন। দিন যেতে লাগলে বোকা ভাইটি চালাক হতে লাগল, সে তার ন্যায্য হিস্যা দাবি করল এবং ব্যর্থ হয়ে প্রথমে গাভীর মুখ বেঁধে রাখল, তারপর খেজুর গাছের গোড়ায় কাঁটা বিছিয়ে দিল এবং দিনের বেলা কাথাটি ভিজিয়ে রাখতে শুর” করল। এর পর কি হোল না বলেই শেখ মুজিব বলতেন ‘দেখি কি হয়? তা না হলে আরও চালাক হতে হবে’’।
বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তি ছিল-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা। বাংলা ভাষাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্তম্ভ। ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতির ঐতিহ্য বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। মূলত ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য বাঙালি জাতিসত্তা প্রধান পরিচয়। সেই পরিচয়কে অবলম্বনই বাঙালির রাষ্ট্র চিন্তার উন্মেষ। শাসকের বির”দ্ধে অন্যায়, অত্যাচারের প্রতিবাদ। এক সাম্যবাদী শাসন ব্যবস্থা বাঙালির লক্ষ্য হয়ে ওঠে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনের অন্যতম লক্ষ্য। শুধুমাত্র ধর্মকে হাতিয়ার করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের সকল অপকর্ম বৈধ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। স্বাধীনতার পরও আমরা ধর্মের অপব্যবহার দেখি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দিতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জো”চরি, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে-আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় ব্যবস্থা করেছি।’
ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এ কথা বলার পর স্বার্থবাদীরা থেমে থাকেনি। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ^াসকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অপপ্রচারে লিপ্ত থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের রাষ্ট্র পরিচালনা সহজ ছিল না। বিশৃঙ্খলার যেন কোনো শেষ নেই। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলেও তিনি গণতন্ত্রের পথ র”দ্ধ করেননি। ১৯৭৩ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধুকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তনে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। এই বিপ্লবের প্রধান দুটি দিক ছিল-সরকার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কর্মসূচি এবং আর্থসামাজিক কর্মসূচি। গ্রাম সমবায়ের মাধ্যমে দ্রারিদ্র বিমোচনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দুর্নীতি এবং সমাজবিরোধীদের শেকড় উৎখাত করে দেশে স্থিতিশীল অবস্থা নিয়ে আসাই ছিল দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য। এ ব্যবস্থা সাময়িক সময়ের জন্য ছিল। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত অবস্থায় সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এছাড়া জাতির সামনে বিকল্প কোনো পন্থা নেই... বর্তমান প্রচলিত গণতন্ত্রের নামে নৈরাজ্য ফ্রি স্টাইল অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। শোষকের স্বার্থে ব্যবহৃত এই গণতন্ত্রে ও শাসনব্যবস্থা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধুর বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে গভীর দীক্ষা দেখা যায়। পরশ্রীকাতরতা আর বিশ^াসঘাতকতা বাঙালির রক্তে রয়েছে। পরের উন্নতি বাঙালি সহ্য করতে পারে না। এরা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করে। বাংলাদেশের মতো উর্বর জমি পৃথিবীতে কম আছে। নিজের দোষেই এরা শোষিত। এরা যতদিন না নিজেকে চিনবে। এর আগে মুক্তি আসবে না। নিমোর্হভাবে কত গভীর কথাই না বলেছেন। কারাগারে বসে বহুবছর আগে দেখা তাজমহলের রূপ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘...সূর্য অস্ত গেল, সোনালি রং আকাশ থেকে ছুটে আসছে। মনে হল, তাজের যেন আর একটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব দেখতে!’ রাজনৈতিক রসকসআবেগহীন বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর ভিতরের মানুষটা কতই না সরস ছিল।
আনিসুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর তিনটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন-সৎ সাহস, অন্যায়ের বির”দ্ধে প্রতিবাদের স্পৃহা আর জনসেবার আকাক্সক্ষা। খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, “আগস্ট মাস ও বাঙালির মহরম” নিবন্ধে লিখেছেন, অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্বর আরব জাতিকে যিনি আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। হানাহানি, শত্র”তা, খুনাখুনির পরিবর্তে যিনি ভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নারী এবং দাসকে যিনি মানুষের মর্যাদা দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের পর যিনি সকল শত্র”কে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। যিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় রক্ত সম্পর্কের কাউকে অভিষিক্ত করেননি। যিনি জোর করে কোনো অমুসলমানকে ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত করেননি। যিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করেছেন-রহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-কে বিনা দোষে কারবালার প্রান্তরে এজিদের নির্দেশে সিমার নির্মমভাবে ছুরি চালিয়ে ধর থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে। ১৫ আগস্ট যেন আরেক কারবালা। পাকিস্তানি হায়েনারাও যাকে হত্যা করতে সাহস করেনি। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল-সহ পরিবারের ২৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে সিমারের দল হত্যা করে। পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে যখন মৃত্যুদ-ের আদেশ শোনানো হয়, তখন তিনি মাথা উঁচু করে, অকম্পিত স্বাভাবিক কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। মানুষ একবারই মৃত্যুবরণ করে। আমাকে মেরে ফেলতে পার; কিন্তু আমার লাশটি বাংলায় দাফন করো।”
তাঁর হৃদয় এক ফোঁটা সমুদ্র ছিল না। বিশাল আকাশের মতো হৃদয় ছিল বলেই-বঙ্গবন্ধু এ মাটির সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-বেদনা বুক পেতে ধারণ করতে পেরেছেন। হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে এরকম আপসহীন সংগ্রামী নেতা বাংলার মাটিতে আর জন্মগ্রহণ করেনি। তাই তো তিনি বাঙালি জাতির পিতা। ‘তাঁর জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কেটেছে কারাগারে। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে ৭ দিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। তিনি ১৯৩৮ সালে প্রথম কারাগারে যান। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি ৫ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন কারাভোগ করে মুক্তি পান ২৮ জুন। ওই দফায় তিনি ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্র”য়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়। সে সময়ে বঙ্গবন্ধু ২০৬ দিন কারাভোগ করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর বঙ্গবন্ধু ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন। এ সময় টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন তাঁকে কারাগারে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। এরপর ’৬৪ ও ’৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন। ছয় দফা দেওয়ার পর বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র”য়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ দফায় কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন।’ প্রায় ১৩ বছর বঙ্গবন্ধু কারাভোগ করেন।
ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার “বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদি ছিলেন শেখ মুজিব” নিবন্ধে লিখেছেন, শেখ সাহেবকে হত্যার বিষয়ে ভারতের গোয়ান্দা সংস্থাা ‘র’ ঢাকার কর্তাব্যক্তিদের পূর্বাবাস দিয়েছিল। কিন্তু কেন যে তারা ব্যবস্থা নেয়নি! হয়তো খুনিদের সহযোগিরা এ তথ্য গোপন করেছে। ভুট্টোর এক সাক্ষাৎকারের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমাদের সম্পদ পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের আছে মাছ, পাট, গ্যাস, ফলফলাদি ও আবাদি জমিসহ এক বিশাল জনবল। আমরা অচিরেই স্বাবলম্বী হতে যাচ্ছি। কিন্তু পাকিস্তানের জীবনযাত্রার যা ব্যয়, তা অব্যাহত থাকলে দেউলিয়া হতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু যে কত দূরদর্শী ছিলেন। তাঁর সেই বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজেই বলছেন তারা কত পিছিয়ে বাংলাদেশ থেকে। ইউটিউবে সার্চ দিলে পাওয়া যায় ইমরান খানের সেই বক্তৃতা। আজ পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। সামাজিক উন্নয়নের কিছু সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।
সোনার মানুষকে নিয়েই সোনার বাংলা। কিন্তু চিবুকের তিলের কাছেও মানুষ বিষম অপরিচিত। ক্ষমতাবান মানুষ হিমালয় পর্বতের মতো একা। যদি জিজ্ঞেস করি বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে তাঁর পরিবার কি পেয়েছে? পিতার জন্মদিনে ১৫-আগস্টের কথা আর স্মরণ করতে চাই না। ব্যক্তির জন্য ৫০ বছর উল্লেখ করার মতো বছর কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য খুবই কম। তবে বাংলাদেশ যে তার হারানো স্বরূপে ফিরছে-সে কথা আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না। কাজ করলে ভুল ভ্রান্তি হয়। তার জন্য আত্মসমালোচনা আবশ্যক। রাষ্ট্রের ভুল করার সুযোগ নেই। আমাদেরকে স্মরণ আছে ১৫ আগস্টের পর ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে পথ এখনো পিচ্ছিল। মনে রাখতে হবে, ‘কল্যাণের পথে থাকলে কেউ আমাদেরকে দাবাইয়া রাখতে পারবে না।’ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এই হোক আমাদের প্রত্যয়।
বঙ্গবন্ধু; এক মহাকাব্যের মহানায়ক
জয়াশিস বণিক ।।
বাংলাদেশের জন্মের পর সবচেয়ে কলঙ্কময় দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়’। হিমালয়ের মতই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মহান মানুষটি বাংলাকে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায় এবং নিজের শেষ রক্ত বিন্দুটিও বাংলাকে দান করেছেন অকৃপণ উদারতায়। ১০০ বছর পূর্বে ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ বাংলার জন্য স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা হাতে গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন এই কালোত্তীর্ণ মহপুরুষ। তৎকালীন কৃষক বুদ্ধিজীবী পিতার শৌর্য-বীর্যের তেজোদীপ্ত শক্তি যেন শিশুকাল থেকেই তার শরীরে ও মনে গেঁথে দিয়েছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র; যা পরবর্তীকালে রূপ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধু নামের মহীরুহে।
বর্ণময় জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠেই কেটেছে এই মহান মানুষটির। সরল জীবনযাপন করা বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ সালের ১৭ই মার্চ কারাগারের রোজনামচায় লিখেছিলেন, ‘আজ আমার ৪৭ তম জন্মবার্ষিকী। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্ম বার্ষিকী পালন করছে। বোধহয় আমি জেলে বন্দী আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্ম দিবস, দেখে হাসলা।’ এমন অকৃত্রিম জীবন বাস্তবতা কেবল বঙ্গবন্ধুর মতো মহান মানুষের জীবনের সম্ভব।
৭ই মার্চ ১৯৭১-এ রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ যেমনি করে বাঙালি জাতিকে দিয়েছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র তেমনি আবার ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যা ছিল জাতির জন্য দিক-নির্দেশনা। সেদিন তিনি বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আমার আদেশ,আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না-পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না-পায়; যারা আমার যুবকশ্রেণি আছে তারা চাকরি না-পায় বা কাজ না-পায়’। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এই বাংলাকে তিনি উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে দাঁড় করাতে চেয়েছেন, তবে ভিা করে নয় নিজেদের যোগ্যতা সাহসিকতা ও পরিশ্রমের দ্বারা। নিজের স্বাধীন দেশে কারও হস্তপে কখনোই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না তিনি। বাংলাদেশ বাংলাদেশের নিজস্ব নীতিতে চলবে- এই কথাটি বারবার উচ্চারণ করেছেন সুদৃঢ় কন্ঠে।
একটি সদ্য স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এত সাহসিকতার পরিচয় আর কোন রাষ্ট্রপ্রধান দিতে পেরেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি এক বক্তব্যে বলেছেন, “ আমার দেশ স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক, কারো এমন শক্তি নাই যে, আমি যতণ বেঁচে আছি ততণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তপে করতে পারে।” বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বিশ্ব দরবারে তিনি সব সময় মাথা উঁচু করে কথা বলেছেন। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপে আন্দোলনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন; “বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্তঃ এক পে শোষক, আরেক পে শোষিত। আমি শোষিতের প।ে”
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই মহান মানুষটি চড়াই উতরাই পার হওয়া যেই বর্ণময় জীবন তা যেন এক অমর মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের অনন্য মহানায়ক তিনি নিজেই। যিনি মাথানত করতে শেখেননি, আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে জানেন নি। নিজের দেশমাতৃকা ও দেশের মানুষের জন্য সর্বদাই প্রাণপণ যুদ্ধ করে গেছেন। এই মহানায়ক জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দান করেছেন মহাকাব্যিকভাবে।
এই মহামানবের জন্মবার্ষিকীতে তার প্রাপ্য শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করা সত্যিই দুঃসাধ্য কাজ। বাঙালির পে কোন কিছুর বিনিময়ে এই মহানায়কের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। তাই সবশেষে বলতে ইচ্ছে করে-
“তুমি ফিরে এসো পিতা, ফিরে এসো
রাজপথ কেঁপে উঠুক আবার
আবার গর্জে উঠুক তোমার সন্তানেরা
শুধু একটি বার ফিরে এসো পিতা
একটিবার সুযোগ দাও
তোমার ঋণ শুধিবার।
ফিরে এসো পিতা, ফিরে এসো।’’