ইতিহাসের এক কলঙ্কময় দিন আজ ২৫ মার্চ। ১৯৭১
সালের এই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরু হয়েছিল। রাতের আঁধারে
ট্যাংক-কামান-মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর।
পরাজয়ের আগে পর্যন্ত ৯ মাস ধরেই চালিয়েছিল বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। নারী,
শিশুসহ প্রাণ গিয়েছিল ৩০ লাখ বাঙালির। চার লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল।
গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত
বেশিসংখ্যক মানুষ হত্যার ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই। ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে
সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে এই দিনটি ‘বাঙালি গণহত্যা স্মরণ দিবস’
হিসেবে জাতীয়ভাবে পালন করা হবে। সেই হিসাবে এবার তৃতীয়বারের মতো পালিত
হচ্ছে গণহত্যা দিবস। এই দিনে জাতি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করবে সেই
পূর্বসূরিদের, যাঁরা একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চরম নিষ্ঠুরতার শিকার
হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা
খান ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ তাঁর
সেই পোড়ামাটি নীতি ধরেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সারা দেশে বাঙালি নিধনে
নেমেছিল। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটির
নেতাকর্মীরা, গড়ে তুলেছিল রাজাকার, আলবদরসহ বিভিন্ন বাহিনী। ধর্ষণ,
অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই, যা তারা করেনি। ১৬
ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পরবর্তীকালে দায়ী
সেনাদের বিচার করা হবে এই শর্তে তাদের পাকিস্তানের কাছে ফেরত দেওয়া হলেও
তারা কথা রাখেনি। উল্টো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। সেই
ষড়যন্ত্রের পথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা
করা হয়। বাংলাদেশের শাসনমতা চলে যায় পাকিস্তানপন্থীদের হাতে। থেমে যায়
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর রাজাকার, আলবদরের বিচারকাজও। প্রায় দুই দশক পর
স্বাধীনতার পরে শক্তি মতায় এলে শুরু হয় সেই দোসরদের বিচারকাজ; তাতেও
পাকিস্তান বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেদিনের দোসর,
তাদের দল ও অনুসারীরা আজও এ দেশে সক্রিয় আছে, রাজনীতি করছে। তারা শহীদের
সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে। অথচ শুধু বাংলাদেশের নয়, বহু
আন্তর্জাতিক দলিল ও তথ্য-প্রমাণে এই সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে। এমনকি ১৯৮১ সালে
প্রণীত জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রেও এমন উল্লেখ
রয়েছে। উল্লেখ আছে অনেক ঐতিহাসিক গ্রন্থেও। আমাদের নিজস্ব গবেষণার তথ্য তো
আছেই। এর পরও যারা এসব বলে, তাদের স্বরূপ চিনতে কারো কোনো দ্বিধা থাকার কথা
নয়। গণহত্যার বিচার কখনো তামাদি হয় না। ৩০ লাখ বাঙালি হত্যার বিচার
নিশ্চিত করতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে
আমাদের আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে যে ১৯৭১ সালে
গণহত্যা হয়েছিল, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। তা না হলে
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ব্যর্থতাকে অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করবে।