অজয় দাশগুপ্ত ।।
স্বাধীনতার
সুবর্ণ জয়ন্তী ২৬ মার্চ, ২০২১। উন্নত বিশ্বের সারিতে স্থান করে নেওয়ার
দৃঢ়সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে, এই মার্চ মাসে স্বাধীনতার
জন্য সশস্ত্র যোদ্ধা হয়েছি। ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিক থেকে
বের হয়ে রাজপথে স্বাধীনতার স্লোগান দিই। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ‘অস্ত্র হিসেবে
একটি গাছের ডাল নিয়ে’ বর্তমান সোনারগাঁও হোটেলের কাছে পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনীর ট্যাঙ্ক-মেশিনগান-কামানের মুখোমুখি হই। আমি ছিলাম হাজার হাজার
আওয়ামী নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গঠিত
মুক্তিযোদ্ধার দলে। কেউ লাঠি হাতে, কেউ দা কিংবা বটি হাতে। সবচেয়ে ভাল
অস্ত্র ছিল একজনের– শাবল। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচ- আক্রমণে আমরা টিকতে
পারিনি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আমরা প্রশিণ পাই, হাতে আসে রাইফেল,
স্টেনগান, গ্রেনেড এমনকি লাইট-মেশিনগান। বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারও শেখানো
হয়। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে কত দ্রুতই না সংগঠিত করেছিলেন আমাদের নির্বাচিত
নেতৃত্ব।
মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে বর্ষা-গ্রীষ্মে ভূমিশয্যা, শীতে ধানের
খড়ে শয্যা, এক থালায় চার-পাঁচ জন কেবল সবজি বা ডাল দিয়ে রুটি বা ভাত খাওয়া
কিংবা না খেয়ে থাকা– এর মধ্যেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী
আলবদর-রাজাকারদের বিরুদ্ধে গেরিলা অভিযান পরিচালনা বা সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ
হওয়া– স্বপ্ন ও সাহসের সেই দিনগুলি কী করে ভুলি?
একাত্তরের রণাঙ্গনের
যোদ্ধারা একে একে বিদায় নিচ্ছেন। কয়েক বছরের মধ্যে আমরা সবাই হয়ে যাব
ইতিহাস। বই বা সংবাদপত্রের পাতা ঘেটে জানতে হবে আমাদের কথা। তখন কেউ হয়ত
বলবে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের তারা হয়ে জ্বল জ্বল করছি, ফুটছি
নানা রংয়ের ফুল হয়ে। কেউ বলবে আমরা মিশে আছি বাংলার সবুজ প্রান্তর আর
ধুলিকণার সাথে। কেউ বা বলবে অসংখ্য নদ-নদী আর বঙ্গোপসাগরের ঊর্মিমালা এ
দেশের শ্রেষ্ঠ সময়ের সন্তানদের স্মরণ করেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় আছড়ে পড়ছে
কূলে কূলে।
মানুষের পুনর্জন্ম হয় কীনা, জানা নেই। যদি হয়, ফের একাত্তরের গৌরবের সময়টা ফিরে পেতে চাই।
বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। এ
জন্য দুই দশকের বেশি ঘুরেছেন পথে-প্রান্তরে। শোষণ-বঞ্চণার চিত্র তুলে
ধরেছেন, সম্ভাবনার কথা বলেছেন। স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের
কর্মকর্তারা যখন বাংলাদেশকে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হিসেবে উপহাস
করেছেন, তখন বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছেন এভাবে এক সময় বাংলা সম্পদশালী ছিল।
শোষণ-লুটপাটের কারণে আমরা সর্বস্বান্ত। ফের আমরা ঘুরে দাঁড়াব।
স্বাধীনতার
সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে আমরা যে স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে উন্নয়নশীল
দেশের সারিতে স্থান করে নিতে পেরেছি, সেটা তো ঘুরে দাঁড়ানোই। সামনে ল্য
উন্নত বিশ্বের সারিতে স্থান করে নেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল থাকলে এ
ল্য হাসিল হবেই। এখন ভাবতে কষ্ট হয়– বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসের প্রায়
২৮ বছর মতায় ছিল এমন শক্তি, যারা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি– ধর্মনিরপেতা,
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও
অগ্রগতিতে যারা খুশি হয় না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ভুল সিদ্ধান্তে
তারা খুশি হয়, কিন্তু নিজেদের অর্থে এ গৌরবের প্রকল্প নির্মিত হওয়ায় গায়ে
জ্বালা ধরে। তারা মতায় যখন নেই, তখনও নানাভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার
চেষ্টা করে। কয়েক বছর আগে তাদের হিংস্র চেহারা আমরা দেখেছি পেট্রোল বোমায়
গোটা বাংলাদেশ জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী নেমে পড়েছিল ১৯৭১
সালের আলবদর-রাজাকার বাহিনীর মতো ভয়ঙ্কর মিশন নিয়ে– বাংলাদেশকে রুখতেই হবে।
তারা
সফল হয়নি। তবে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। সমৃদ্ধ-গর্বিত দেশ মুক্তিযুদ্ধের এ ল্য
অর্জন করতে হলে আমাদের এ অপশক্তিকে মোকাবিলা করতেই হবে। আর এ েেত্র বড়
প্রেরণাও ১৯৭১। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্া চিরতরে
দমন করার জন্য নিষ্ঠুর গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছিল, যার সূচনা ২৫ মার্চ মধ্য
রাতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময়েই বাংলাদেশের
স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এটা আকস্মিক ছিল না। এ জন্য তিনি দেশবাসীকে প্রস্তুত
করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কলিকাতা থেকে ঢাকা আসেন
তিনি। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানি
শাসকরা বাঙালিকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে দমিয়ে রাখতে চাইছে,
এমনকি বাংলায় কথা বলতে দিতেও রাজী নয়– এটা তিনি বুঝতে পারেন। প্রতিবাদী
আন্দোলনেও সামিল হয়ে যান। গড়ে তোলেন প্রতিবাদ সংগঠিত করার হাতিয়ার–
ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করায়
তাকে বহিষ্কার করা হয়। পাঠানো হয় কারাগারে। কিন্তু তিনি দমে যাননি। পরের
দুটি দশক জেল-জুলুমের মধ্যেই বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে মানুষকে সংগঠিত
করেন।
এর মধ্যেই সঙ্গোপনে চলে স্বাধীনতার প্রস্তুতি। ছায়ানটের সভাপতি,
খ্যাতিমান রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সনজীদা খাতুন আমাকে বলেছেন, ১৯৫৬ সালে
ঢাকার এক অনুষ্ঠানে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি দল এসেছিল। এ উপলে আয়োজিত
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি
তোমায় ভালবাসিৃ’ গাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের
বুঝিয়ে দিতে হবে সোনার বাংলা আমাদের অন্তরে।
নেতৃত্বের সামনে ল্য যখন
স্থির থাকে, কর্মকৌশল-কর্মপন্থা নিয়েও ভাবতে হয়। আর এটা ছিল বলেই ১৯৭১
সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ
অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয়ে
যায় বাংলাদেশ-এ। স্বল্প সময়ের মধ্যে শহর-বন্দর-গ্রাম প্রতিবাদমুখর হয়। ৭
মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যখন বলেন– গোটা দৃশ্যপট ছিল সামনে।
স্বাধীনতার সংগ্রাম শান্তিপূর্ণ স্তর থেকে সশস্ত্র পর্যায়ে উন্নীত হতে
চলেছে। এ কারণে তিনি যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করায় প্রস্তুত
হতে বলেন। বাঙালি তখনও মারণাস্ত্র হাতে তোলেনি। সামরিক প্রশিণও নেই খুব
বেশি মানুষের। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়সংকল্প সবাই। বিশেষভাবে ছাত্র ও
তরুণ সমাজ সংঘবদ্ধ হয়েছে। ২ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
ঐতিহাসিক বটতলায় ‘জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন করেছে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে
বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। আমার সোনার
বাংলাৃ ঘোষিত হয়েছে জাতীয় সংগীত হিসেবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক
তিনিই। এমন প্রোপটে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পেরেছেন– সাত কোটি মানুষকে
দাবায়ে রাখতে পারবা না। তিনি গ্রেফতার হতে পারেন, এমনকি তাকে হত্যাও করা
হতে পারে– এ শঙ্কা ছিল। এ কারণে প্রিয় বাংলাদেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়েছেন–
‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি– রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দেবে।’
২৫
মার্চ নিষ্ঠুর গণহত্যা শুরু এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পরও আমাদের
নেতৃত্ব করণীয় নির্ধারণে বিন্দুমাত্র সমস্যায় পড়েনি। মাত্র দুই সপ্তাহের
মধ্যে গঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, যারা শপথ নেন ১৭ এপ্রিল–
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় সংগীত ও জাতীয়
পতাকা আগেই নির্ধারিত ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা বা সনদ পাঠ করা হয়। স্বাধীনতার
জন্য সংগ্রাম করেছে যারা, তাদের মধ্যে এমন সনদ ক’টি দেশের আছে?
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পিত হয় কর্নেল ওসমানীর ওপর।
বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্ব নেন তরুণ সামরিক অফিসাররা, যারা পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে।
১০ এপ্রিল
সরকার গঠনের জন্য ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যরা
একত্রিত হতে পাড়ি দিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখল করা বধ্যভূমি।
জীবনের ঝুঁকি ছিল প্রত্যেকের। কিন্তু পরোয়া করেননি। ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করা
প্রায় এক কোটি শরণার্থীর থাকা-খাওয়া-চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় তারা ভারত
সরকারকে সহায়তা করেছেন। শপথ গ্রহণের এক মাস ৭ দিনের মধ্যে চালু করেছেন
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র– যার শিল্পী-কলাকুশলীরা সকলেই বাংলাদেশে
নাগরিক। তরুণ বয়সের শিল্পীরা বধ্যভূমি পাড়ি দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার
কেন্দ্রে পৌঁছেছেন। খ্যাতিমান শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় আমাকে বলেছেন,
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি পৌঁছেছেন যেদিন– বেতার ভবনে উপস্থিত
সবাই ছুটে এসেছিলেন ‘আইছে রে, আসল শিল্পী আইছে’ চিৎকার করে। এ বেতার
কেন্দ্রে খবর, নাটক, গান, কথিকা, যন্ত্র সংগীত একটি বেতার কেন্দ্রে যে সব
অনুষ্ঠান থাকার কথা– সবই ছিল। সর্বোপরি ছিল এম আর আকতার মুকুলের
‘চরমপত্র’। পাকিস্তানের ‘রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা ও চট্টগ্রামকে’ বিপুল
ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
সরকার গঠন হতে না
হতেই বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার প্রতিনিধি দল পাঠায় আবদুস
সামাদ আজাদকে নেতা ও ডা. সারওয়ার আলীকে সদস্য করে। কয়েকদিনের মধ্যেই লন্ডনে
বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি সমন্বয় কমিটি, যারা
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালিদের সংগঠিত করে বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধের প।ে বাংলাদেশ সরকার অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে পাঠায়
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে। পরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে বাংলাদেশ-এর
পে বক্তব্য রাখার জন্য প্রতিনিধিদল যায়।
বাংলাদেশকে হানাদার বাহিনীর কবল
থেকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিণ ও অস্ত্রসজ্জিত করে
বাংলাদেশ সরকার। একইসঙ্গে চলে বাংলাদেশের পে বিশ্বব্যাপী জনমত সংগ্রহ এবং
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পে প্রচার। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন
হবে, কোন কোন কাজ অগ্রাধিকার পাবে, সম্পদের জোগান আসবে কোত্থেকে– এ সব নিয়ে
কাজ শুরু করে পরিকল্পনা সেল। বাংলাদেশের শিল্পীরা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে
ঘুরে ঘুরে গান, নাটক ও কৌতুক পরিবেশন করে।
সব কিছু পরিচালিত হয়
এমনভাবে, যেন আগে থেকেই ঠিক করা। ডাক টিকিট প্রকাশিত হয় (ফার্স্ট ডে কভারের
কথাও ভোলেননি নেতৃত্ব), বাংলাদেশের মুদ্রার নাম ইংরেজি ও বাংলায় ‘টাকা’
হবে– সেটাও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই চূড়ান্ত হয়। রণাঙ্গনে যখন লাখ লাখ তরুণ
লড়ছে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বাংলাদেশের পে
জনমত ও অর্থ সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। খেলা শুরুর আগে খেলোয়াড়রা
বাংলাদেশের লাল-সবুজ-সোনালী রংয়ের পতাকা তুলে সালাম জানিয়েছেন, শপথ
নিয়েছেন। আর মাঠে সমবেত জনতা খেলা দেখার চেয়েও বেশি উৎসাহী বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদানে। এই দলের সব খেলোয়াড় ছিল
বাংলাদেশের, হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদর বাহিনী বধ্যভূমি অতিক্রম করে
তারা যোগ দিয়েছিলেন ফুটবল দলে।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করে। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বাংলাদেশ
সরকার ঢাকায় স্বাভাবিক কাজ শুরু করে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের ধারণা ছিল
বাংলাদেশ স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ছিল
পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে। তারাই ছিল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু
স্বাধীনতার আকাঙ্া যে তীব্র ছিল বাঙালিদের মধ্যে! প্রয়োজনের সবকিছু বুঝে
নিতে তাদের সময় লাগেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে
দ্রুততার সঙ্গে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি মুক্ত
স্বদেশে ফিরে এসে এ প্রক্রিয়াকে দিতে পারেন নতুন গতি। সবকিছু ছিল যে তাঁর
নখদর্পণে। আর কী অপার বিস্ময়ের ঘটনা– পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে
ঢাকা ফেরার পথে দিল্লিতে স্বল্প সময় অবস্থানকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুহৃদ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় চূড়ান্ত
করে ফেলেন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্যদের ফিরে যাওয়ার
সময়সূচি। বাংলাদেশ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হওয়ার তিন মাসেরও কম
সময়ের মধ্যে মিত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্য ফিরে যায় নিজ দেশ ভারতে।
স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশ তার প্রস্তুতি কতটা সেরে রেখেছিল, এ ঘটনাও তার বড় প্রমাণ।