
শঙ্খ ঘোষের কবিতার আকাশ
মো. আরিফুল হাসান
শঙ্খের
বুকে সাধারণত সমুদ্রের সুর থাকে। তবুও সপ্তসমুদ্র কখনো কখনো কারো সৃষ্টির
কাছে নগন্য হয়ে পড়ে, কারো কারো সৃষ্টিজগৎ হয়ে পড়ে আকাশের মতো অবারিত। শঙ্খ
ঘোষ সাহিত্যের সকল শাখায় দৃপ্তপদভারে বিচরণ করলেও কবিতার নিজস্বতা ও বহুত্ব
বিস্তৃত আলোচনার দারি রাখে। অবিরাম লিখে গেছেন ঝর্ণার মতো। ফুলে ফুলে,
পুষ্পে-পরাগে তার সে অমর কাব্যজগৎ পাঠককে বাস্তব এবং অতিবাস্তব এক
কল্পলোকের সন্ধান এনে দেয়। পাঠ করতে করতে মনে হয়, জীবন ও যাপনচিত্রের
অবিরাম ভাঙাগড়া তার কলমে কি অকপট ধরা দিয়েছে! যেনো সন্ধ্যাকাশজুড়ে রাশিরাশি
মুক্তোনক্ষত্র জ্বলজ্বল করে উঠে শব্দ-ক্যানভাসে। শঙ্খের সেই কবিতাআকাশ
নিয়ে আলোচনায় তার কাব্যিকবোধের, নান্দনিক চেতনার বৈচিত্রবিন্যাস তুলে ধরা
সত্যিই দুরূহ।
মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধূলোর মতো ছোটে
যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে,
বলা হয় না কিছু-
আকাশ যেনো নামতে থাকে নিচুর থেকে নিচু
মুখ ঢেকে দেয় মুখ ঢেকে দেয়, বলা হয় না কিছু।
‘অন্যরাত’
কবিতার মতো বলতে হয় যে, শঙ্খ, সে যে আঙ্গিকেই আলোচিত হোক, তার যেনো কিছুই
বলা হয় না। এতো যে বিস্তৃতি, এতো যে গভীরতা আর এতো বেশি যে তা পরিমানে,
তাতে বলা যায় শঙ্খের কবিতার শঙ্খ নিজেই উপমা। বাংলা সাহিত্যে তার মতো এতো
বিপুল কর্মবীর প্রাসঙ্গিককালে সত্যিই বিরল। তিনি কবিতার মালা গেঁথে
রেখেছেন, তিনি ছন্দের বাগান গড়ে দিয়েছেন, তিনি ধ্বনির ঝিকিমিকি নক্ষত্র
আকাশ এঁকে দিয়েছেন সাহিত্যপ্রেমিদের জন্য।
‘বিপুলা পৃথিবী’ কবিতায়
কবি এক চিত্রকল্প বর্ণনার মাঝে সমাজের মধ্যমস্তরের অসুখকে চিহ্নিত করেছেন।
আরাধ্য মানবজন্মের হেতু নির্ণয়ে বীক্ষাদর্শন চোখে খুঁটিয়ে দেখেছেন জীবনের
পূর্ণতা অপূর্ণতাগুলো। উচ্চাসন কিংবা অন্ধকারের বাইরে এক জটিল যন্ত্রণাজগৎ
তিনি নির্মাণ করেছেন চমৎকার মেটাফোরে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, কোথাও ঠাঁই হলো
না মধ্যবর্তী যাপনকাহনের। এ কথা কহতব্য নয়, এ যন্ত্রণা প্রকাশ করার নয়ত।
আর এই রাত্রি দুলছে নিঃশব্দ বাদুরের মতো তাকে ঘিরে। চোখে পড়ে তারই
নিরন্ত কালোয় অন্ধ অরণ্যের মূঢ় গর্জন, ‘তাকে ঢেকে দাও’ ‘তাকে ঢেকে দাও’
রব করতে করতে ছিটকে বেড়োলো এধার থেকে ওধার, খসে পড়া নক্ষত্র বেজে
রইল বুকের মাঝখানে, ‘তাকে চোখ দাও’ ‘তাকে চোখ দাও’ বলতে বলতে
সীমাহীন ভয়ে তার চোখ ঢাকল দু-হাতে।
এই
চোখ ঢেকে বসে থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার থাকে না। তাই ‘সত্তা’ কবিতায়
দেখি-- ‘তুমি থেকো, তুমি সবার দৃশ্যগোচর থেকো--/ নইলে আমি এ যে কিছুই বুঝতে
পারি না।/ স্মরণ বিস্মরণÑ তার উর্ধ্বে প্রত্যেকে/ দেখবে, তুমি মানবী না,
স্বপ্নপরী না।’
না, স্বপ্ন কোনো কবিতা নয়। কবিতা জীবনের অভিঘাত।
জীবন ভেঙে যে চূর্ণগুলো, সেগুলোই কবিতার দার্শনিক ভাষ্য। কবি শঙ্খ ঘোষ
জীবনাভিজ্ঞার কষ্টিপাথরে আদত স্বর্ণ তুলে রেখেছেন কবিতার পাঠকদের জন্য।
পাঠকেরা তাই তার কবিতা পড়ে যেমনতর মুগ্ধ হয়, তেমনি আবার দুরু দুরু বুকে
কাঁপে জীবনের কাাঁটার ঘাতবানী শুনে। দেখা যায় সমকাল কীভাবে ক্রুর হয়ে আছে
তৃতীয় বিশ্বের অভাব আর বৈপরিত্বের মধ্যে। তাইতো তিনি জীবনের বাইরে এক
অলৌকিক মায়ার জগৎ তৈরি করেছেন পাঠকের অবকাশের জন্য।
এই যে ভালো ধুলোয় ধুলোয় ছড়িয়ে আছে দুয়ারহারা পথ,
এই যে ¯েœহের সুরে আলোয় বাতাস আমার ঘর দিল রে দিল-
আকাশ দুটি কাঁকন বাঁধে, বলে, আমার সন্ধ্যা আমার ভোর
সোনায় বাঁধা-- ভুলে যা তুই ভুলে যা তোর মৃত্যু-মনোরথ।
সেই কথা এই গাছ বলেছে, সেই কথা এই জলের বুকে ছিল,
সেই কথা এই তৃণের ঠোঁটে-- ভুলে যা তুই, দুঃখরে ভোল তোর,
ধূলোতে তুই লগ্ন হলে আনন্দে এই শূন্য খোলে জট!
মাটিমগ্ন
ধ্যানের পঙক্তি এভাবে শুনতে পাই কবি শঙ্খ ঘোষের “বলো তারে ‘শান্তি শান্তি”
কবিতায়। কবিতার অতল অন্দরে এভাবেই কবি শুনতে পেয়েছেন রিনিকঝিনিক, এভাবেই
তুলে এনেছেন খলখল হাসি, আর এবাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন নিঝুম জীবনের রোদন-দাহ।
পথে
পথে সোনা ছড়াতে ছড়াতে কবি হাঁটেন। দু’হাত উজার করে বিলিয়ে দেন আপন
সর্বস্ব। তবুও চাতক মনে তৃষ্ণা জমে থাকে। এক নান্দনিক অপূর্ণতা তাই কবিকে
ধাবিত করে পরবর্তী সৃষ্টির দিকে। আর এটি যেকোনো মহান কবিরই বৈশিষ্ট। শঙ্খ
ঘোষের লেখায়ও তেমনি এক অবিদিত হাহাকার খেলা করে। অন্তস্থিত এক দীর্ঘশ্বাস
মাইলের পর মাইল বিস্তৃত হতে থাকে। কিন্তু মুছে যায় পথের নিশানা!
পথের বিলাস যায় পথে পথে বিলাতে বিলাতে-
উদবৃত্ত থাকে না কিছু-- এ বড় আশ্চর্যের লাগে সখী।
যত ছন্দ বাজে, যত তৃপ্তি দেখা স্ফটিকে নীলাতে
তাতে খুঁজে দেখো, প্রশ্ন করে দেখো, ‘আছে কি আছে কি’-
থাকে না সে কিছুতেই, মেলে না যা কিছুতে মেলে না,
ঘরে যাকে পেতে চাও সে পালায় পথে পথে ঘুরে।
স্ফটিকে নীলায় যাকে পাও, প্রাণভরণের দেনা
তাতেও মেটে না তাই ছুটে চলি আরো আরো দূরে।
এভাবেই
পথ থেকে নতুন পথের সৃষ্টি হয় কবি শঙ্খ ঘোষের ‘পথ’ কবিতায়। তিনি
অন্তর্জগতকে বাস্তবের সংজ্ঞায় এক চমৎকার দ্বিধাদ্বন্দ্বের, সত্যমিথ্যার
আত্ম ও বস্তুজীবনের গূঢ়ার্থ নির্মাণ করেছেন। আর এই অতৃপ্তি থেকেই তৈরি
হয়েছে ঢেউয়ের পর ঢেউ, আছড়ে পড়েছে তা বাংলাসাহিত্যের চিরায়ত হৃদয়তটে।
‘আরও
একটু মাতাল করে দাও।/ নইলে এই বিশ্বসংসার/ সহজে ও যে সইতে পারবে না!/..../
এখনও যে ও যুবক আছে প্রভু!/ এবার তবে প্রৌঢ় করে দাও-/ নাইলে এই
বিশ্বসংসার/ সহজে ওকে বইতে পারবে না।’ Ñ‘মাতাল’ কবিতায় কবি এমন করে মানুষের
ভেররের দুর্দমনীয় শক্তিকে ঈঙ্গিত করেছেন। দেখিয়েছেন, তারুণ্যের স্পর্ধার
কাছে বিশ্বসংসার নতজানু হয়। তাকে বইবার সাধ্য থাকে না ভুগোলের পরিমিত
পাতায়। তাইতো কবি প্রৌঢ়ত্বকে আহ্বান করেছেন বিক্ষুব্ধ শ্লেষে।
আজকাল বনে কোনো মানুষ থাকে না
কলকাতায় থাকে।
আমার মেয়েকে ওরা চুরি করে নিয়েছিল
জবার পোষাকে!
কিন্তু আমি দোষ দেবো কাকে?
কবি
‘বাস্তু’ কবিতায় ক্ষয়িষ্ণু সময়ের দুবৃত্তায়িত রূপরেখা করুণ অসহায় কণ্ঠে
বর্ণনা করেন। নিজের ঘরের কাছে দেখতে পেয়েছেন বন ছেড়ে আসা বন্যতা, কিন্তু
কবি এর জন্য কাকে দায়ী করবেন, যখন সমাজের পাদদেশ থেকে শিখরের সর্বত্র জুড়ে
পচন? আমরা দেখতে পাই কবি অসহায় প্রেমিকের মুখটিকেও স্কেচ করেন
বিধ্বস্তসার্বভৌমত্ব রূপে।
একবার তাকাবে না? নিজের মুখের দিকে চোখ ভরে?
মাঝে মাঝে ফিরে দেখা ভালো নয়?
তুমি হাত ধুতে পারো এত গঙ্গাজল জানে কোন্ দেশ!
মাঝে মাঝে ধুয়ে নেওয়া ভালো নয়?
তাই আমি আমার দক্ষিণ হাত
রেখেছি নিজের বুকে,
তুমি এসো, মাথা পাতো, যেনো কত ঘর ঘুরে এলে
এখন লহরী নয়
যত চুপ তত দূর দুয়ারে দুয়ার খুলে যায়
দুযারে দুয়ার খুলে যায়
এই এক শুদ্ধতর
হাজারদুয়ারি ভালোবাসা।
কবি
শঙ্খঘোষ প্রসঙ্গে এভাবেই বিস্তারের ‘হাজারদুয়ারি’ খোলে যায়। তাকে বর্ণনা
করে শেষ করা যায় না। ভাষা ও ভাবের অসংখ্য পথ তৈরি হয় তার শক্তিশালী পঙক্তির
জাদুতে। তার কবিতার কাছে মগ্ন হয়ে থাকতে হয় পাঠককে। পরিমিতবোধ তার কবিতার
বড়গুণ, তবুও তার যে কবিতার বিশাল আকাশ, তা অবগাহনে আরও বেশি বিস্তৃত হয়ে
উঠে পাঠক হৃদয়।
রচনাকাল : ২৩ এপ্রিল ২০২১
লেখক : মো. আরিফুল হাসান
পোষা জীব
হালিম আব্দুল্লাহ
পোষার জন্য একটা সাপ কিনেছি
বেশ রঙিলা সাপ
কুলাপনা চক্কর
হিসহিস শব্দ
বরফ শীতল গা।
বুকে নিলে গলায় জড়িয়ে ধরে
ছোবল দেয়
আহা কী বিষ!
সুখে অঙ্গ টনটন করে।
সাপের একটা নামও দিই
আঙ্গুর
আঙ্গুরের মদ জগতশ্রেষ্ঠ, তাই।
দুধ-কলা খেতে দিলাম
খায় না
পোষা জীব, উপোস তো রাখা যায় না!
কলিজা খেতে দিই
চুকচুক খায়
চোখ খেতে দিই
গপাগপ খায়
রক্ত খেতে দিই
ঢকঢক খায়
হাত খায়, পা খায়, গোটা শরীর গিলে খায়।
আহা পোষা জীব, না খাইয়ে থাকতে পারি!
বিভ্রান্ত অথবা বিব্রত
খলিলুর রাহমান শুভ্র
সুখগুলো অবিকল তোমার মতো
চেতনানাশক বেদনা জাগানিয়া
অবিশ্বাস্য চড়া মূল্যে নেই মরীচিকা।
শোচনীয় পরাজয় মেনে হাসে, অতিসরলীকরণ বিপ্লব।
জলে কুমিরের সাথে খেলতে নামে নাদুসনুদুস প্রেম।
অখ- সুখের প্রতিশ্রুতির নোট ভাঙিয়ে
বুনোকুসুম থেঁতলে দেয় নাগরচরণ।
যেটুকু তোমাকে পাই সংকেতে সংলাপে
রক্তে ফেনা তুলে মহামারী। মৃত্যু চর্বিশূন্য
দেহে নাচে মুষলধারায়।
নিঃশ্বাস দ্রুত হলে ট্যাবুতে জেগে ওঠে
শুদ্ধতম নির্বাণ। মদ্যপ হুলিয়া।
সুখগুলো অবিকল তোমার মতো
চেতনানাশক বেদনা জাগানিয়া
আবেদীন মাওলা
া
তোর আঙ্গুলে লম্বা সুতা
সেলাই করিস পিতার জামা
মায়ের শাড়ি বোনের কোর্তা
ভাইয়ের টুপি দাদির কাপড়
বুবু আমার বুবু অমর
তৃতীবিশ্ব সেলাই খামার
তঙ্কা আসে তঙ্কা কাহার ?
বেদান মুখে কুবের কারুন
বলে বুবু নাকি সেলায় দারুন
বুবু আমার সেলাই করো
সভ্য ক্ষতো শতো শতো
চতুর করুন ( া ) স্যালুট করে
উল্টো পথে যায় কি চলে (?)
তোর জ্বর হয়েছে কে বলেছে
কোন শালা কয় অসু¯’ তুই
বিশ্বজোড়ে ফুটে আছিস
ভুঁইচাঁপা আর দোপাটি জুঁই
গর্ব আমার দর্প আমার
আমার বোন দর্জি সবার
তোর ঘামে শ্রমে ভালো আছে
তবু বেদানমুখো লুকিয়ে হাসে
বোনরে আমার বোনরে আমার
আছি আমরা ছাপান্ন হাজার
স্যালুট বুবু স্যালুট তোকে
দিলাম স্যালুট মাথা ঝুঁকে
পেটের আগুন
আজফার আজিজ
এইসব আধ?্যাত্মিক পথ, মত, চর্চা
খুব পানসে আর একঘেয়ে লাগে,
যখন লক্ষ মানুষের একমাত্র চিন্তা
পেটের জ্বালা মেটানো।
সাধুজন সহজে বুঝে না পেটের আগুনও
নরক আর তাতে পুড়ছেও প?্রচুর।
ওরা কিয়ামত কতদূর তা নিয়ে তর্ক করে,
অথচ চারপাশে সর্বদা ঘটমান কিয়ামত
দেখতে পায় না। আশ্চর্য বইকি।
শব্দব্যোম
(শব্দকলাকার শঙ্খ ঘোষ স্মরণে)
অর্ধেন্দু শর্মা
মৃতমুখের সাথে
কেন জড়িয়ে যায় কর্মমুখ
দেখেছি দুর্যোধনের
দেখেছি অর্জুনের
দেখেছি বঙ্গবন্ধুর
দেখেছি শঙ্খ ঘোষকেও
আমাদের কষ্টগুলো নষ্ট হয় না
ধুকে ধুকে মুখ ঢেকে জ্বলে
পুরাণ পৃষ্ঠায় ঝুলে থাকে ঠিক
কাউকে হারিয়ে হেঁটে যাই বিরাতে বিভোলে
কাউকে হারিয়ে নিদ্রাশূন্য হই বিতল অন্ধকারে
পাঞ্চজন্য শঙ্খ তিনি নন
সমুদ্রমন্থনে জন্ম যে শঙ্খ
সে আজ অপার সমুদ্রেই চলে গেছে
নিরবে উন্মিলিত চোখে
অথচ
কানের কুহকে
বুকের অন্তরব্রজে
দৃষ্টির সীমানায়
ধ্বনিত হবে তাঁর শব্দব্যোম