ড. আতিউর রহমান ||
স্বাস্থ্য
খাতকে সবার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল চলতি অর্থবছরের বাজেট।
তবে জীবিকা সংরণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং
অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি নানা কৌশলও স্থান করে
নিয়েছিল চলতি বাজেটে। গত বছর এই সময়ে করোনার ধাক্কায় অনানুষ্ঠানিক খাতসহ
আনুষ্ঠানিক খাতেরও অনেক উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমন অবস্থায় আদৌ একটি
বাজেট দেওয়া সম্ভব হবে কি না সে ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু গেল
বছরের এপ্রিল মাসেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত জিডিপির ৪.৪ শতাংশের
মতো অর্থনৈতিক প্রণোদনা কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার কারণে বাজেট প্রণেতাদের
অনেকটাই সুবিধা হয়। প্রণোদনা কর্মসূচিকেই প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা হিসেবে
গ্রহণ করে তাঁরা ওই সংকটকালেও একটি গ্রহণযোগ্য বাজেট তৈরি করতে পেরেছিলেন।
পাশাপাশি চলমান বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ
রেখেই তাঁরা মোটামুটিভাবে একটি সমন্বিত বাজেট দিতে পেরেছিলেন।
ওই
বাজেটের সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো দিক ছিল করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের
জন্য প্রচলিত বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ।
সেই বরাদ্দ থেকেই টিকা কেনার খরচসহ সারা দেশের স্বাস্থ্য খাতের ঘাটতি
পূরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। টিকার জন্য আগাম অর্থও ভারতের সিরাম
ইনস্টিটিউটকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারতে করোনা সংকট এমন ব্যাপক রূপ
ধারণ করেছে যে এখন ওই টিকা পাওয়া নিয়ে খানিকটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বাস্তবতার নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকেও টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিচ্ছে
সরকার। শিগগিরই চীন থেকে টিকা আসবে। শোনা যাচ্ছে আগামী মাসেই রাশিয়া থেকে
৪০ লাখ ডোজ টিকা আসার কথা। পাশের দেশ ভারতে করোনা পরিস্থিতির অবনতির
প্রোপটে ওই দেশ থেকে ২০ লাখ টিকা আসার বিষয়টি বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে
পড়ে গেছে। সরকার দ্রুতই রাশিয়া ও চীন থেকে টিকা সংগ্রহের যে উদ্যোগ নিয়েছে
তা সুবিবেচনাপ্রসূত। সময়মতো যেন ওই টিকা আসে তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক তৎপরতা এবং সংগ্রহ ব্যবস্থার উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
মাস দুয়েকের মধ্যে হয়তো অন্যান্য টিকাও সহজলভ্য হবে। এই আপৎকালে কালবিলম্ব
না করে কম উপদ্রুত উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পাঠানো টিকা ফিরিয়ে এনে ঢাকা,
নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের মতো করোনার হটস্পটগুলোতে টিকা কর্মসূচি
চালু রাখা উচিত। টিকা বাবদ বাজেটে অর্থ আছে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির অর্থ
সহযোগিতাও পাওয়া গেছে। তাই টিকার অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষ
দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তবে এই মহামারি একটি বিশ্বসংকট। কাজেই
বিশ্বসম্প্রদায়ও আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে বলে আশা রাখি। আমাদের মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ইউএনএসকাপের সম্মেলনে সে আহ্বানই জানিয়েছেন। তাঁর
আহ্বানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই টিকা উৎপাদনে প্রচলিত ইন্টেলেকচুয়াল
প্রপার্টি রাইটস-সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা যেন দ্রুততম
সময়ের মধ্যে তুলে নিয়ে যাদের সাধ্য আছে তাদের টিকা উৎপাদনের সুযোগ দেয়।
আমাদের
দেখা উচিত স্বাস্থ্য খাতের পুনর্নিমাণে অন্য যেসব উদ্যোগ এই বাজেটকালেই
সম্পূর্ণ করার কথা ছিল সেসবের কী হয়েছে। সব জেলায় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ
ইউনিট খোলার যে নির্দেশনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন
পরিস্থিতি কেমন? সব জেলায় কি আইসিইউ ইউনিট গড়ে উঠেছে? সেখানে কি কেন্দ্রীয়
অক্সিজেন বিতরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? যদি হয়েই থাকে, তাহলে
এখনো কেন এত করোনা রোগী ঢাকামুখী? করোনা সামলাতে গিয়ে হাসপাতালগুলো
অন্যান্য চিকিৎসার দিকে মনোযোগ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এসব বাস্তবতা স্বীকার
করেই বর্তমান করোনা-সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। চলতি বাজেট থেকেই করোনা
চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও সহায়ক কর্মীদের পর্যাপ্ত
প্রণোদনা দেওয়ার কথা ছিল। দেখার বিষয় সেসব তাঁরা পাচ্ছেন কি না। এ জন্য
বাড়তি খরচ হলে সংশোধিত বাজেট থেকে নিশ্চয়ই মেটানো সম্ভব।
আগামী কয়েক বছর
ধরেই আমাদের করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেতে হবে। এক বছর ধরে স্বাস্থ্য
ব্যবস্থায় যেসব ঘাটতি ল করা গেছে সেসব কী করে পূরণ করা যায়, মধ্য ও দীর্ঘ
মেয়াদে আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার
কী করে করা সম্ভব এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি উপযুক্তমানের স্বাস্থ্য বীমা
কাঠামো কী করে গড়ে তোলা সম্ভব—এসব কিছুই আগামী বাজেটে আলোচিত হবে এবং সে
জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ মিলবে বলে আশা করছি। আগামী দিনের স্বাস্থ্য খাতের
বাজেট ‘গতানুগতিক’ হলে চলবে না। আমরা ল করেছি দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্য
বাজেট মোট বাজেটের ৫ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বাজেটকে আগামী
অর্থবছরেই অন্তত ৭ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়া উচিত। পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে এই
হার আরো বাড়িয়ে অন্তত ১০ শতাংশে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যেহেতু
স্বাস্থ্যই জীবন, তাই এ খাতের বাজেটটিই হতে হবে আসন্ন জাতীয় বাজেটের হৃপি-।
তবে
স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোতেই সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না; ল রাখতে
হবে ওই বাড়তি বরাদ্দ যেন ঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করা হয়। সাধারণত স্বাস্থ্য
বাজেটের মাত্র এক-চতুর্থাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যের পেছনে যায়। অথচ স্বাস্থ্য
সেবাপ্রার্থীদের বৃহত্তম অংশটিই কিন্তু প্রাথমিক সেবা চায়। কাজেই এই
অনুপাত যত দ্রুত সম্ভব এক-তৃতীয়াংশে উন্নীত করা চাই। আমাদের রোগাক্রান্ত
মানুষদের মধ্যে ১২ শতাংশ কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে
না। মহানগরগুলোতে এ অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ (২৩ শতাংশ)। যদি ওষুধ ও চিকিৎসা
সরঞ্জামাদিতে সরকারি বিনিয়োগ আরো বাড়ানো যায়, তাহলে এ অবস্থার উন্নতি
সম্ভব। অথচ মোট স্বাস্থ্য বাজেটের এক-পঞ্চমাংশেরও কম এ বাবদ বরাদ্দ হয়।
কাজেই বর্ধিত বাজেটে এদিকটিতে নজর দেওয়া যায়। মোটকথা স্বাস্থ্যে বরাদ্দ
বাড়ানোর সময় যথাযথ অগ্রাধিকার স্থির করা চাই।
প্রশ্ন উঠতে পারে এই বাড়তি
অর্থায়ন আসবে কোত্থেকে? প্রচলিত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে বাড়তি
অর্থায়ন ছাড়াও আমরা ‘বক্সের বাইরে’ চিন্তা করে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ নিশ্চয়ই
করতে পারি। যেমন তামাকবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক
গবেষকরা হিসাব করে দেখিয়েছেন যে তামাকপণ্যের ওপর যথাযথভাবে করারোপ করা গেলে
একদিকে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে ধূমপান থেকে বিরত করা যাবে (ফলে স্বাস্থ্য
ব্যয় কমবে), অন্যদিকে এর ফলে তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্বও আসবে।
একইভাবে তামাকপণ্য থেকে যে ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আহরণ করা হয়,
সেটা সরাসরি স্বাস্থ্য খাতে পৌঁছানো গেলেও তা পুরো স্বাস্থ্যসেবার মান
বাড়াতে সহায়ক হবে।
তবে শুধু স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাড়িয়ে মানুষকে
বাঁচানো সম্ভব নয়। এই প্রাণঘাতী করোনা আমাদের অর্থনীতির প্রায় সব েেত্রই
আঘাত হেনেছে। আর সে কারণেই কর্মহীনতার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। এদের
সবাইকে সামাজিক সুরা বেষ্টনীর মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি। আমাদের সামাজিক সুরা
কর্মসূচিগুলো আগের চেয়ে অনেকটাই পরিবর্তন করা গেলেও এখনো তা নিñিদ্র ও
স্মার্ট করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় একটি ভালো তথ্যভা-ার গড়ে
তোলার চেষ্টা করছে। তারাও স্বীকার করছে যে স্মার্ট সামাজিক সুরা কাঠামোটি
এমনভাবে দাঁড় করাতে হবে, যেখানে সরকারি ও অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশীদারি
গড়ে ওঠে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁরা দুর্যোগকালীন স্ট্যান্ডিং অর্ডার
সংশোধন করেছেন। জানি না কভিড-১৯ অভিজ্ঞতার আলোকে ওই স্ট্যান্ডিং অর্ডারে
স্বাস্থ্য খাতকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে কি না; যদি হয়ে থাকে তাহলে
ভালো। আর না হয়ে থাকলে চলমান স্বাস্থ্য দুর্যোগের পর ফের দুর্যোগ এলে
প্রশাসন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, অসরকারি ও ব্যক্তি খাত এবং সংশ্লিষ্ট
স্থানীয় সরকার ও সামাজিক উদ্যোগগুলোকে কী করে সুসমন্বিতভাবে সক্রিয় ও
দায়বদ্ধ করা যায় সে বিষয়গুলো যুক্ত করা নিশ্চয়ই সম্ভব।
কভিড অভিজ্ঞতার
আলোকেই সরকার অনলাইনে ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’সহ অনেক ব্যবসাবান্ধব উদ্যোগ
নিয়েছে। বিডা ও অন্য রেগুলেটরি সংস্থাগুলো এসব নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ
অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপও (বেজা) একই ধারায় কাজ করছে। প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা
এরই মধ্যে ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিসে’র সেবা ভালোভাবেই পেতে শুরু করেছেন। বিডা
জানিয়েছে, ৩৫টি প্রধান রেগুলেটরি সেবা একই অনলাইন মঞ্চ থেকে তারা এখন দিতে
পারছে। শুনেছি ‘ব্যাংক্রাপসি আইন’ সংশোধনের উদ্যোগ সরকার নিতে যাচ্ছে। এটা
তাড়াতাড়ি করা গেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। ২০১৮ সালের কাস্টম আইনের
প্রবিধান এরই মধ্যে চালু করা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক ঝুঁকিনির্ভর কাস্টম
পদ্ধতির অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপ। এর ফলে
বন্দরে মালামাল খালাসে গতি বাড়বে।
চলতি অর্থবছরে ঝুঁকিপূর্ণ
অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের প্রশিণ দিয়ে তাদের দতা বাড়ানো এবং জীবিকা
পুনরুদ্ধারে ুদ্রঋণ কর্মসূচির প্রবর্তন করা হয়েছে। পিকেএসএফ এই কর্মসূচি
বাস্তবায়ন করছে। এটি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তবে যে পরিমাণ মানুষ এখন কর্মহীনতার চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন সেই তুলনায়
এই কর্মসূচি নিতান্তই সামান্য। এ ছাড়া প্রণোদনা কর্মসূচির অধীনে
ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার
যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল তার বাস্তবায়নের হার খুবই মন্থর। এখনো প্রায়
এক-চতুর্থাংশ ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ এই কভিডকালে অসংখ্য তরুণ ও নারী
উদ্যোক্তা ঘরে বসে ডিজিটাল ব্যবসা করছেন। পাড়ায় পাড়ায় ছোটখাটো দোকানদার এই
সংকটকালেও আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা রেখেছে। এসব উদ্যোক্তার দরকার চলতি
মূলধনের। ট্রেড লাইসেন্স, টিন নম্বর, বাণিজ্যিক ঠিকানা এমন নানা কাগজ চেয়ে
এদের ঋণপ্রাপ্তি থেকে দূরে রাখা হয়। রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো একটু উদারমনা
হলে সহজেই এদের ঋণ বাজারে আনা সম্ভব।
উল্লেখ্য, সিটি ব্যাংক ও বিকাশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেে এদের নিয়ে একটি পাইলট পরিচালনা করেছিল।
মোবাইল আর্থিক সেবায় ও ব্যাংকিং চ্যানেলে তাদের লেনদেন অবলোকন করে
আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ব্যবহার করে ১০ হাজার টাকার মতো স্বল্প ঋণ অল্প
সময়ের জন্য চালু করেছিল। এই পাইলটকে সফল বলতে হয়, কারণ প্রদত্ত ঋণের ৯৯.৭
শতাংশই ফিরে এসেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন
পেলেই এই ঋণ কর্মসূচির আওতা বাড়ানো সম্ভব। এমন করে ‘আউট অব বক্স’ চিন্তা
করে করেই আমাদের এগোতে হবে। শুনেছি বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকার
আরেকটি নয়া ুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ কর্মসূচি উদ্ভাবন করেছে। আশা করছি খুব দ্রুতই
তারা এ কাজটি সম্পন্ন করতে সম হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা
কর্মসূচিতে ডিজিটাল ড্যাস বোর্ড মনিটরিং ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। ক্রেডিট
গ্যারান্টি স্কিমও তারা চালু করেছে। ব্যাংক রেট ও কৃষিঋণের সুদের হার
কমিয়েছে। আশার কথা, শিগগিরই সব মোবাইল আর্থিক সেবা ইন্টার-অপারেবল হতে
যাচ্ছে। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের সংস্কার চলছে।
একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অঙ্কের ই-কমার্স ও অন্যান্য সেবাও মোবাইল
আর্থিক সেবার সঙ্গে যুক্ত করা হবে। কভিড-উত্তর অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক
পুনরুদ্ধারে মোবাইল আর্থিক সেবা আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে
আমার বিশ্বাস। ডিজিটাল অর্থায়নের অবকাঠামো বিদ্যমান থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক
অনেক কিছুই করতে পারছে। এখন খেয়াল রাখতে হবে এসব আধুনিক ডিজিটাল অবকাঠামোর
মেইনটেন্যান্স, রিপ্লেসমেন্ট ও সংস্কারের দিকে। কারণ মোবাইল আর্থিক সেবাসহ
ডিজিটাল আর্থিক সেবার পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে পুরনো ডিজিটাল আর্থিক
অবকাঠামো এই চাপ বেশিদিন সইতে পারবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপ
নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে সচেতন আছে।
তবে মানুষের কর্মহীনতার যে পরিস্থিতি তা
কিন্তু শুধু ঋণ ও আর্থিক সেবা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। রাজস্ব নীতিকে এ
েেত্র সমান সক্রিয় হতে হবে। এ েেত্র উল্লেখ্য যে এখনো আমাদের করযোগ্য অনেক
নাগরিকই কর জালের বাইরে রয়েছেন। নিশ্চয়ই ডিজিটাল প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের
মাধ্যমে এনবিআর তাঁদের কাছ থেকে কর আহরণের চেষ্টা করবে। তবে এর পাশাপাশি
নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে জাতীয় প্রচারাভিযান চালাতে হবে, যাতে
নাগরিকরা বুঝতে পারেন তাঁরা যথাযথভাবে কর দিলে তা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
প্রক্রিয়ায় সরকারকে তথা দেশকে সহায়তা করবে। নয়া নয়া খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহ
ছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয়কে সামাজিক সুরা কর্মসূচিতে বরাদ্দ ব্যাপক হারে
বাড়াতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়া কৃষক ও
অনানুষ্ঠানিক খাতের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য ঈদের আগেই বিশেষ অনুদান
নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী হয়েছে। তবে এর পরিমাণ ও ব্যাপ্তি বাড়ানোর সুযোগ
রয়েছে। প্রয়োজনে সরকারি ঋণ বাড়ে বাড়ুক। তবে কর্মহীন মানুষ যদি আরেকটু বেশি
অর্থ পেতেন, তাহলে তা থেকে বাঁচিয়ে টুকটাক কিছু করে খাবার উদ্যোগও নিতে
পারতেন, বিশেষ করে বৃষ্টিহীনতার ফলে গরম হাওয়ায় বোরো ফসলের যে তি হয়ে
যাচ্ছে তা পুষিয়ে নেওয়ার যে উদ্যোগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষি মন্ত্রণালয়ের
মাধ্যমে নিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তবে এর গতি ও আকার দুই-ই বাড়ানোর প্রয়োজন
রয়েছে। ধান কাটার মেশিনে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে তা যেন আগামী বাজেটেও
অব্যাহত থাকে। শুধু আমদানীকৃত কৃষিযন্ত্র নয়, এর পাশাপাশি বগুড়ার লাইট
ইঞ্জিনিয়ারিং কাস্টারে দেশীয় যন্ত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছোটখাটো
উদ্যোক্তাদের জন্যও এ ধরনের প্রণোদনা দেওয়া দরকার। একই সঙ্গে চালের বাজারদর
স্থিতিশীল রাখার জন্য উপযুক্ত দামে ধান-চাল সংগ্রহ নীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন
অপরিহার্য। খাদ্যের মজুদ ঠিকঠাক রাখতে খাদ্য আমদানিও চালিয়ে যেতে হবে।
এসবের পাশাপাশি শিাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হওয়ার ফলে যে তি হয়েছে তা
পুষিয়ে নিতে এবং কভিড-উত্তর বিশ্বের উপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তুলতে শিা ও
প্রশিণে বিনিয়োগকেও যথাযথ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আমাদের কৃষি, প্রবাস আয় ও
রপ্তানি খাতই এই সংকটকালে বাঁচিয়ে রেখেছে। আগামী বাজেটে এই তিন খাতের
জন্যই বাড়তি প্রণোদনা আশা করছি। সারা বিশ্বের ৫০০ নামকরা অর্থনীতিবিদের ওপর
জরিপ চালিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স বলেছে, চলতি বছরেই বিশ্ব অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ধারেকাছে চলে যাবে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
তবে প্রবৃদ্ধি নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার দরকার নেই। উন্নত দেশে টিকা
প্রদান, বাইডেন প্রশাসনের অবকাঠামো উন্নয়ন বাজেট বৃদ্ধি এবং অন্যান্য
ইউরোপীয় দেশে প্রণোদনা অব্যাহত থাকায় তাদের মানুষের আয়-রোজগার বাড়বে। ফলে
বিদেশে আমাদের রপ্তানি চাহিদাও বাড়বে। সে জন্য আরএমজিসহ রপ্তানিমুখী শিল্প
ইউনিটগুলো চালু রাখার সিদ্ধান্তটি খুবই সুদূরপ্রসারী ছিল। আশা করছি, সরকার ও
কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এ খাতের দিকে ইতিবাচক সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে।
পাশাপাশি মেগাপ্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্তটিও সুবিবেচনাপ্রসূত
ছিল। সারা দেশের পূর্তকর্মই এভাবে চালিয়ে যেতে হবে। কেইনসীয় অর্থনীতির
ভাবনার আলোকে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মতো শহরের রাস্তাঘাট,
ড্রেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, মেরামত করা, গ্রামের স্কুল, কলেজ, হাট,
রাস্তাঘাট সংস্কার করার মতো যাবতীয় পূর্তকর্ম পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যেতে
হবে। কর্মসৃজনই মূল ল্য। চিকিৎসাসেবা দিয়ে জীবন বাঁচানো এবং কর্মহীনকে কাজ
দিয়ে এই করোনাকালে বাঁচিয়ে রাখাই হতে হবে আসন্ন বাজেটের মূল কাজ। মানুষ
বাঁচানোর দায় একা শুধু সরকারের নয়। করপোরেট ও বিত্তবানদেরও সামাজিক দায়িত্ব
নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এক টাকায় ইফতার দিচ্ছে। এমন
উদ্যোগ আরো দেখতে চাই। তা সম্ভব, যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা
(২৬ এপ্রিল ২০২১, বিআরপিডি সার্কুলার নং ০৯) অনুসারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো
সিএসআর সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।