‘ভাডি বাংলার খাডি কতা’হিমাদ্রিশেখর সরকার ||
ওয়াফডি,
আইতনা, দুগুইল্লা, গম্মাদা, গাইল-ছাহাইড, নিয়ামুইদ্যা, ফনলা-তশকা,
ফিলুইয়া, বুইন্যাইদ, আইত্যা-গুইত্যা, নাডাগুডা-উপর্যুক্ত শব্দগুলো
বাংলাদেশের একটা বিশেষ অঞ্চলের প্রচলিত-অপ্রচলিত লোকভাষার অন্তর্গত। এই
ভাষার অঞ্চলকে বলে ‘ভাটিবাংলা’। এই ‘ভাটিবাংলা’ বলতে আমরা বুঝি বৃহত্তর
সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা জেলা। এই অঞ্চলকে ‘ভাটিবাংলা’ বলার কারণ এখানে
অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় আছে। বছরের অর্ধেক সময় এখানে বর্ষার
পানি থাকে। এই ‘ভাটিবাংলা’র নিজস্ব লোকভাষা ও লোকসাহিত্য নিয়ে দীর্ঘদিন
থেকে গবেষণা করছেন ভাটি বাংলারই এক কৃতী লোক-গবেষক মহিবুর রহিম। কুমিল্লা,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ এসব অঞ্চলে প্রচলিত লোকভাষা ও
লোকসাহিত্য নিয়েই তার কাজ। এই লোকভাষা ও লোকসাহিত্যের উপাদান তিনি ২০০৪
খ্রিস্টাব্দ থেকে সংগ্রহ করছেন এবং ২০১৯-এর অক্টোবরে এসে তা বই আকারে
প্রকাশ করলেন। বইটির নাম ‘ভাটি বাংলার লোকভাষা ও লোকসাহিত্য’। লেখক মহিবুর
রহিম পেশাগত জীবনে কলেজে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। নেশা লেখালেখি ও
গবেষণা।
আমাদের সমাজ-সভ্যতা-ঐতিহ্যের নির্যাস হচ্ছে লোকসাহিত্য। একে
অস্বীকার করলে নিজেদের জন্মকেই অস্বীকার করতে হয়। তথাকথিত ভদ্রলোকদের কাছে
লোকসাহিত্য মানে নিরক্ষর-গরীব মানুষের সাহিত্য। অজ্ঞতা থেকে তারা এই ধরণের
ধারণা পোষণ করেন। তারা জানেন না যে এটি আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ। আমরা আজ
যতই শহুরে হই না কেন আমাদের শিকড় কিন্তু হাওড়-বাওড়-জল-জঙ্গলে। একথা আজ আমরা
নির্বোধের মত অস্বীকার করলেও আমাদের অতীত ইতিহাস কিন্তু তা অস্বীকার করে
না। আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়েও এর প্রমাণ মিলবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য
আমাদের, সময়ের বিবর্তন, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি তথা পূঁজিবাদী সংস্কৃতির
আগ্রাসনে আমাদের লোকভাষা ও লোকসাহিত্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ইতোমধ্যে এর
অনেক উপাদান হারিয়ে ফেলেছি আমরা। আমাদের লোকপ্রবাদ বা নজির, লোকসঙ্গীত,
লোকছড়া, মেয়েলি গীত ইত্যাদির বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করে গবেষক মহিবুর রহিম
তার বইয়ে উপস্থাপন করেছেন। যা আমাদের বিশাল লোকভান্ডারের একটা ক্ষুদ্র অংশ
মাত্র। তিনি অনেক লোকজ শব্দের পরিচিতি দিয়েছেন যার কিয়দংশ আমরা এই লেখার
শুরুতে উদ্ধার করেছি। ভাটি অঞ্চলের নজির বা প্রবাদকে তিনি সাজিয়েছেন অ, আ,
ক, খ অর্থাৎ অভিধানের আদলে। যেমন ‘অকালে না নোয়াইলে বাঁশ/ পাকলে করে ঠাস্
ঠাস্।’ / ‘আ করি না কাওয়ার ডরে/ হগল কাওয়া বেইড়া ধরে/’। ‘এক টেহার পুটকি না
পাছ টেহার লুডা/’। এই রকম অনেক নজির বা প্রবাদ-এর মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের
দৈনন্দিন জীবনের অনেক জীবন-জিজ্ঞাসা। জীবন-যাপনের অনেক অভিজ্ঞতা, সমস্যা ও
সম্ভাবনার উত্তর এসব নজিরে খুঁজে পাওয়া যায়। এসব কিছুই আমাদের যাপিত-জীবনের
অঙ্গ। লোকজীবন মানে শুধু গ্রামীণজীবন নয় । শহুরে জীবনও এর বাইরে নয়।
লোকভাষা
সংগ্রহের পাশাপাশি মহিবুর রহিম আমাদের লোকসঙ্গীতের অনেক নমুনা সংগ্রহ
করেছেন এবং ভাটি অঞ্চলের অনেক গীতিকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেছেন।
সেইসব গীতিকবিরা বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লায় জন্মগ্রহণকারী। যাদের
মধ্যে আছেন মনোমোহন দত্ত, সৈয়দ আবদুল বারী, আবদুল ওয়াহেদ, গিরীন চক্রবর্তী,
বাউল জারু মিয়া, দুলামিয়া মাস্টার, অমর পাল, শৈলেন চক্রবর্তী, উকিল
মুন্সী, শেখ ভানু, শচীন দেববর্মণ, রহমান মিয়া, মোহনলাল দাস, অমিয়ভূষণ
চক্রবর্তী (ঠাকুর), শামছেল হক চিশতি প্রমুখ। সংগ্রহের তালিকায় ভাটি অঞ্চলের
মেয়েলী গীত যেমন আছে তেমনি আছে অদ্বৈত মল্লবর্মণ সংগৃহীত গান। আছে
জারিগান, সারি গান বা হাইর গান ( নাও দৌড়ানির গান) ও ভাটিয়ালি গান। আরো আছে
মারফতি, মুর্শিদি ও বাউল গান। এসবকিছুই আমাদের ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। যার
কিছু কিছু নমুনা গবেষক রহিম তার বইয়ে স্থান করে দিয়েছেন। যে ঐতিহ্যের
সূতিকাগার কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নরসিংদীসহ এর
পাশ্ববর্তী অঞ্চল।
আমাদের আলোচ্য ঐতিহ্যের উপাদানগুলো সংগ্রহে লেখক ভাটি
অঞ্চলের বহু গ্রাম ঘুরেছেন। কয়েকটির নাম উল্লেখ করছি। চিনাইর, বাসুদেব,
ভাতশালা, ফুলচং, চান্দপুর, জগৎসার, মাছিহাতা, সুলতানপুর, লালপুর, বাইমমৌজা,
কেদেরখলা এবং লেখকের নিজ গ্রাম নিক্লির (কিশোরগঞ্জ) ছাতিরচর গ্রাম। এই
কাজটি করার একটি পূর্ব-প্রস্তুতিও ছিল লেখকের। তিনি বাংলা একাডেমির ‘লোকজ
সংস্কৃতির বিকাশ কর্মসূচি’র আওতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকসংস্কৃতি সংগ্রহে কাজ
করেছেন (যৌথ)। যা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। লোকসাহিত্য
গবেষণার জন্য মহিবুর রহিম ‘প্রজ্ঞা’ শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পদক এবং
স্মৃতি ’৫২ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
জনাব রহিম তার ‘ভাটি বাংলার লোকভাষা
ও লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে আমাদের ভাটি অঞ্চলের এমন দুজন লোকশিল্পীকে হাজির
করেছেন যারা আন্তর্জাতিকমানের। ভাটিবাংলার গানকে যারা বিশ্বদরবারে পৌঁছে
দিয়েছেন। একজন নজরুল-সখা গীতিকার-সুরকার ও শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী
(১৯১৬-৬৫) আরেকজন লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তী অমর পাল(১৯২২-২০১৯)। দুজনেই
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতীসন্তান। জন্ম তাদের এই মাটিতেই। বিপুল জনপ্রিয় ‘আল্লা
মেঘ দে পানি দে’ প্রচলিত লোকসঙ্গীত হলেও এর চার লাইন বাদে বাকী অংশ গিরীন
চক্রবর্তীর রচনা। তার যে গান আজ কিংবদন্তী, গত ৭০ বছর যাবৎ গাওয়া হচ্ছে,
‘কিশোরগঞ্জে মাসির বাড়ি/ মামার বাড়ি চাতলপাড়/ বাপের বাড়ি বাউনবাইড়া/ নিজের
বাড়ি নাই আমার/’- এই গানের পুরো বাণী জনাব রহিমের বইয়ে পাওয়া যাবে। অমর পাল
থেকে শুরু করে অনেক লোকশিল্পীর পরিচিতি এই বইয়ে আছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক
রাজার দেশে’ সিনেমায় যে গান গেয়ে অমর পাল বিখ্যাত হয়েছেন সে গানটিও এখানে
পাওয়া যাবে।
‘ভাটি বাংলার লোকভাষা ও লোকসাহিত্য’ বইটির ছাপা, প্রচ্ছদ,
বাঁধাই উন্নতমানের। বইটি প্রকাশ করে জেলাপ্রশাসন, কুমিল্লা একটি রাষ্ট্রীয়
দায়িত্ব পালন করেছেন বলে মনে করি। বইটির ভূমিকা লিখেছেন সম্মানীয় বিভাগীয়
কমিশনার, চট্টগ্রাম জনাব মো. আবদুর মান্নান । যিনি নিজেও একজন মননশীল
লেখক। আর বইটির প্রকাশক হিসেবে যার নাম আছে তিনি সম্মানীয় জেলা প্রশাসক,
কুমিল্লা, জনাব মো. আবুল ফজল মীর। এটা সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবীদের জন্য খুবই
আনন্দের সংবাদ। তবে বইটিতে গবেষক মহিবুর রহিম-এর যে ত্রুটিটি চোখে পড়েছে তা
হলো লোকভাষায় তিনি প্রমিত বাংলা ঢুকিয়েছেন। যেটা আদৌ কাম্য নয়। পরবর্তী
সংস্করণে তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাববেন আশা করি। লোকভাষা হবে লোকের মুখের ভাষা,
বইয়ের ভাষা নয়। আর ৩২০ পৃষ্ঠার বইয়ের দাম ৮০০ টাকা খুব বেশি মনে হয়েছে
সাধারণ পাঠকদের জন্য। এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষ বই কিনে পড়ে না। বইটি
যেহেতু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয়েছে এর মূল্য ৫০০ টাকার মধ্যে রাখা
যেতো।
‘ভাটি বাংলার লোকভাষা ও লোকসাহিত্য’
মহিবুর রহিম
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ- এ এস জিহাদ।
প্রকাশনায়-জেলা প্রশাসন, কুমিল্লা।
প্রকাশকাল-অক্টোবর, ২০১৯।
পরিবেশক-পাঠক সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা।
মূল্য-৮০০ টাকা, পৃষ্ঠা ৩২০।
...................................................................................................................
হিমাদ্রিশেখর সরকার ঃ প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ছোটগল্পকার।
নতুন পাঞ্জাবি ও একটি পোড়া শহর
মানিকরতন শর্মা ||
হঠাৎ
ঘুম ভেঙে গেল নিগমের। রাতের আরো দুপ্রহর বাকি। ফোন কলে ভাঙাঘুম আর জোড়া
লাগল না তার। অসময়ে ফোন করা নীতি বর্জিত কাজ। কিন্তু কখনো কখনো নীতিসিদ্ধও
হয়। নীতি বর্জিত ফোন কলের কারণেই একরাত রাগে ফোন বন্ধ করে ঘুমায় নিগম। আর
সেদিনই বড় অঘটন ঘটে যায় তার জীবনে। সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে অন করতে একটু
দেরি হয় তার। যখন অন করে তখনই চূড়ান্ত অঘটনের সংবাদটি তার কানে আসে। ওপার
থেকে বলছেÑ তোমাকে সারা রাত কতবার যে ফোন করেছি, একবারও পাই নি। এখন এসে তো
তুমি আর দেখতে পারবে না। কারণ বেলা বারোটায় শবদেহ নেওয়া হবে শ্মশানে।
এখানে আসতে আসতে তোমার প্রায় তিন ঘণ্টা লেগে যাবে।
হতভম্ব, বিমূঢ় কথা
বলতে পারছে না নিগম। কান্নায় বার বার কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে। কখন কিভাবে এই
প্রশ্নের উত্তর পেতে পেতে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেকে ধিক্কার
দিচ্ছে কেন ফোনটা বন্ধ করে ছিল সে। এতো দিন বন্ধ করেনি। আজ হঠাৎ বন্ধ
করাতেই এমন। নিজেকে সামলে নিয়ে মনে মনে ভাবে আর যত নীতি বর্জিত ফোন আসুক না
কেন কখনোই ফোন বন্ধ করবে না সে। প্রিয় মানুষের মৃত্যুসংবাদ ও শবদেহ
শেষবারের মত দেখা আর হলো না।
যা হোক আজকের ফোনটি ছিল নিতান্তই নীতিহীনের
কাজ। প্রচ- রেগে ফোনটা রেখে ঘুমোতে চেষ্টা করে নিগম। কিন্তু কিছুতেই চোখ
জোড়া লাগছে না। শেষমেষ ওঠে বাথরুমে যায়। চোখেমুখে জল দিয়ে আসে।
বারিধারার
এক বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে নিগম। ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তার। কারো দিকে
তাকানোর সময় নেই। একবার নয় শত সহ¯্রবার যাকে দেখেছে তাকে ছাড়া আর কারো পানে
তাকানোর যুক্তি দেখে না সে। মনের কোণে সেই মুখই স্থান নিয়েছে। একটি আসনে
একজনই বসতে পারে সুতরাং সেস্থানে আর কাউকে বসানোর প্রশ্নই ওঠে না। নিগমের
ভাবনাগুলো এইভাবেই বিশ্লেষিত হতে থাকে। টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস রয়েছে তার।
এটাই লালন করে যাচ্ছে সে। ছদ্মনামে লেখার কারণে কাছের জন ও প্রতিবেশীরাও
কেউ বুঝতে পারে না।
ঢাকা শহরে কাজের ফাঁকে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয় তার।
কিন্তু চোখদ্বয় বাজপাখির মত খোঁজতে থাকে একটি অতিচেনা মুখ। হঠাৎ কোথাও নি
দেখা যায়! কিন্তু না। মনের ভেতরের চোখ দিয়ে সেই মুখ আজো দেখে যায় নিগম।
যান্ত্রিক
হট্টোগোলের ও লেজুরভিত্তিক সাহিত্যিকদের এই শহরে মন ওঠে যায় তার। হঠাৎ
সুযোগ পেয়ে চলে যায় সমুদ্রের এক দ্বীপে। মনে মনে ইচ্ছেও ছিল জীবনটাকে একটু
নতুন করে দেখার। চমৎকার একটি দ্বীপ। বিশাল সমুদ্রের মাঝে এ যেন নতুন
স্বদেশ। কাছেই নিঝুম দ্বীপ। নোয়াখালির ঘাট থেকে সি-ট্রাকে ওঠে। ছোট ছোট
দ্বীপের মাঝ দিয়ে ছুটছে সি-ট্রাক। উত্তাল মেঘনা। সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলেছে
মাছ ধরাসব নৌকা। জেলেরা জাল ভাঁজ করতে করতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে গভীর
সমুদ্রে। উঁচুনিচু ঢেউয়ের শব্দ যেন কোরাস গাইছে। গাঙ চিল আর শাদাবকের ঝাঁক
ঢেউয়ের সাথে সাথে উড়ছে। এমন দৃশ্য এই প্রথম দেখছে নিগম। এখানে মেঘনা নদী
যেন সমুদ্র। বিশাল। প্রায় দেড় ঘণ্টার চলার পর দেখা মিলে সমুদ্রের বুকে ভেসে
ওঠা দ্বীপের মুখ। ভাসতে থাকা সি-ট্রাকে বসে বাদামের খোসা ছাড়তে ছাড়তে
ভাবতে থাকে নিগম। জীবন কী সমুদ্র, নাকি অন্যকিছু।
অফিসের লোকেরা ঘাটে
আগেই অপেক্ষা করছিল। তাদের সাথে ওছখালি যায় নিগম। এইটি দ্বীপের
কেন্দ্রস্থল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাজার। এখানেই তার অফিসকাম কোয়ার্টার। ধীরে
ধীরে দ্বীপবাসীর সাথে প্রগাঢ় সখ্যতা গড়ে ওঠে। অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ
মানুষগুলো অতি আপন করে নেয় নিগমকে। নতুন পরিবেশ। এক ভিন্নতর সংস্কৃতিতে
ভালোই লাগছে তার। এখানকার মানুষগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিকভাষায় কথা বলে।
কেউ নোয়াখালি কেউবা ভোলা কেউবা চিটাগাংএর ভাষায় কথা বলে।
বিপত্তিটা
ঘটে অন্য জায়গায়। স্থানীয় এক কলিগের বন্ধুর বোন। কোয়াটারের কাছেই ওদের
বাড়ি। নিগমের সৌজন্যবোধের আচরণকে স্বপ্নডানায় চড়ে বসে বর্ণা। বর্ণার রঙ ধরা
মনে একদিন বাস্তবতার স্তবক দেয় নিগম। বয়স না হোক ধর্মের সেই সমস্যা। এই
একটি মাত্র সমস্যার কারণেই অশথের ছায়ায় সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল অদৃষ্টাকে।
কারণ উগ্রসমাজ ব্যবস্থা। ঘটনা ঘটলেই হয়তো দাঙ্গাও বেধে যেতে পারত। বুকের
মাঝে পাথরচাপা দিয়েছিল সেদিন নিগম। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক তা সে চায়
না। মনে মনে ভাবে আমার কপালে কেন এমনটা হয়। বছর ঘুরতেই চলে আসে নিগম। মায়ের
বাধ্য ছেলের মত সংসার জীবনে জড়ায় সে।
সময়ের অলিগলি দিয়ে কখন যে বছরগুলো
ঘুরতে থাকে বুঝতেই পারে না। সরল ভাবনা মুক্তচিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি
সর্বোপরি চমৎকার রুচিবোধের কারণে স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত হয় সে। উনিশ বছরের
গ্রামের মেয়ে যে এতোটা প্রগ্রেসিভ হতে পারে তার ধারনাই ছিল না। আসলে
প্রকৃতির কারণেই মেয়েরা পুরুষের চেয়ে এগিয়ে থাকে। বয়সটা এখানে গৌন।
মধ্যবয়সে
এসে একদিন হঠাৎ ফেইসবুকে ফ্রে- রিকিয়েস্ট আসে। আইডিতে পাশাপাশি দুটো সময়ের
ব্যবধানের ছবি দেওয়া। দেখে চমকে যায় নিগম। এতো কাল পর। বুকের মাঝে সেই
ঘুমন্ত মুখ আচমকা জেগে ওঠে। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। সে জানে এখন সে
শিল্পপতির ঘরনী।
কেমন আছ
ভালো। আপনি কেমন আছেন। দীর্ঘ বত্রিশ বৎসর পর দেখা। কত যে পরিবর্তন; সময়ই সকল গল্পের উত্তর দিয়ে দেয়। ভালো থাকবেন।
আছেন মানে, তুমি কি আমাকে চিনতে পারনি
তোমাকে চিনব না এটা কি করে হয়। ভুল করেও ভুলা যায় না যেমন। অনেক দিন পর তো। ভাবলাম প্রথমে তুমি বললে আবার কিভাব তাই...।
তারপর
আঠারই আগস্ট। সন্ধ্যা ছয়টা উনচল্লিশ মিনিটে কল করে সে। প্রায় তেত্রিশ
মিনিট কথা হয়। সেই কণ্ঠস্বর। আবার স্মৃতির কানে মাদকতার সুর বেজে ওঠে।
নিগমের পাশেই স্ত্রী। কাপড় ভাঁজ করতে করতে মৃন্ময়ী যে কথায় দৃষ্টি দিচ্ছে
তা বুঝতে পারে সে। বিয়ের পরপরই একদিন জীবনের ব্যর্থ গল্পগুলোর কথা খুলে বলে
নিগম। ফাঁকি দিতে চায় নি তাকে। যে জীবন অধরা থাকে, তাকে মনে পোষণ করা যায়
কিন্তু জোড়া লাগানো যায় না।
কথা শেষে মৃন্ময়ী এক গাল হেসে বলছেÑ কে তোমার অদৃষ্টা।
তুমি বুঝলে কিভাবে?
তোমাদের কথোপকথনেই ধরে নিয়েছি
কি শেষ পর্যন্ত খোঁজ পেলে!
কথাটায়
কোথায় যেন একটু ঈর্ষার স্বর রয়েছে বলে মনে হয় নিগমের। কিন্তু বুঝতে দেয় না
সে। হাতের নাগালে যেন চাঁদ খোঁজে পেল সে। এবার প্রায় নিয়মিতই
ম্যাচেঞ্জারে কখনো ফোনে কথা এগিয়ে যায়। দুটো ছেলে আমেরিকায় পড়াশোনা করছে।
শিল্পপতি হলেও স্বামী বেচারা বহুভাষাবিদ। পড়–য়া মানুষ। ঘরে একটা লাইব্রেরি
আছে।
সেই পুরনো সখ্যতা। মধ্যবয়সের ফ্রেমে চমৎকার মানিয়ে নেয় অদৃষ্টা।
তোমাকে নিয়ে এবার প্রেমের কবিতা লিখব।
আজাইরা কথা
এতোটাকাল তোমাকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখিনি। আসছে অমর একুশে বের হবে সেটি। কি নাম দিয়েছি জান।
বাহ্ এরই মাঝে নামও ঠিক করে ফেলেছ!
জি, ‘প্রেমে পড়া চোখ ঘুমোতে পারে না’
এটাই আমার প্রথম ও শেষ প্রেমের কবিতা বই।
এখন কী সে সময় আছে। সূর্য তো ডুবে যাচ্ছে।
প্রেমের কোনো সূর্য নেই। ডুবার তো কথা নয়। তোমার ষাট কিংবা সত্তোর হলেই কি!
অফিস ব্যস্ততার কারণে একমাস কথা হয় নি নিগমের।
একদিন অচিরেই বাড়িতে আসব। তখন তোমার সঙ্গে দেখা করব। ম্যাচেঞ্জারে লিখে জানায় অদৃষ্টা।
কবে
আসছে সোমবার। বড় ভাবির শরীর খারাপ। ঐদিন সন্ধ্যায় আবার চলে আসব ঢাকায়। থাকব না।
ঠিক আছে
গোপনে
এক সপ্তাহের মধ্যে একটা নতুন পাঞ্জাবি বানিয়ে আনে নিগমের জন্য। দেখা হবে
সোমবার। রোববার দুপুরে অফিস থেকে ফেরার পর বিকালে পাঞ্জাবিটা নিগমের হাতে
দিয়ে মৃন্ময়ী বলে, পর তো দেখি।
নিগম কিছু বোঝার আগেই পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেয় মৃন্ময়ী। কেমন হয়েছে বল!
বেশ সুন্দর তো। হঠাৎ পাঞ্জাবি কেন?
বা রে বত্রিশ বছর পর আবার দেখা হবে। নতুন কাপড় পরে যাবে মোশয়। রুচিবোধের একটা ব্যাপার আছে না।
তুমি না একটা পাগল। আমার তো জানা নেই স্বামীর পুরোনো প্রেমিকার সাথে দেখা করার জন্য স্ত্রী পাঞ্জাবি উপহার দেয়।
শোন, তোমার আইনের ভাষার মতো সবকিছুতেই নজির খোঁজ না।
কিছুক্ষণ পরেই নিগমকে ফোন দেয় তার এক কলিগ।
শহরে
নাকি হাজার হাজার মৌলবাদি ছাত্ররা ভাঙচুর ও আগুন জ্বালাচ্ছে। ভয়ংকর তা-বে
একে একে আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, ভূমি অফিস, টাউনক্লাব, পৌরসভা,
ইন্ডাস্ট্রিয়েল স্কুল, শিল্পকলা একাডেমি, সর্বোপরি রেলস্টেশনসহ প্রায়
পঁিচশ-ত্রিশটি প্রতিষ্ঠানে আগুন জ্বালিয়েছে তারা। শহর পুড়ে ছাই। আগুন
জ্বলছে শুধু। ফায়ার সার্ভিসের অফিস কার্যত অবরুদ্ধ করে রেখেছে তারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা দেখা যায় নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর আগুনে
পুড়ছে শিরোনামে ঘোষিকা জানাচ্ছে। চ্যানেলের খবরে দাউ দাউ করে আগুনে পোড়া
শহর দেখাচ্ছে। তখনো নিগমের শরীরে পরা ছিল নীলাকাশের পাঞ্জাবি। মৃন্ময়ীর
সামনে সেই পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে ভাবছে আগুনের লেলিহান এইভাবেই বুঝি প্রেম ও
সংস্কৃতিকে পুড়িয়ে দেয়।
লেখক: কবি, গল্পকার, কথাসাহিত্যিক, গবেষক, পেশাজীবী