ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
ঝুঁকির কাছে ফেরা
Published : Sunday, 9 May, 2021 at 12:00 AM
ঝুঁকির কাছে ফেরাতুষার আবদুল্লাহ ||
ছোটবেলায় পড়া হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পের অলঙ্করণের কথা মনে পড়ছে। বাঁশির সুর শুনে জানালা দরজা, ঘুলঘুলি দিয়ে ইঁদুর পথে লাফিয়ে পড়ছে। বাঁশিওয়ালার পিছু তাদের নিতেই হবে। জ্ঞানে-অজ্ঞানে ছুটছে তারা। যেমন, এখন ছুটছি আমরা। বাসা থেকে অফিস আসার পথটি অসাধারণ। পথে উঁচু-নিচু উভয় তলার মানুষের বসতি এবং তাঁদের বিপনী-বিতান চোখে পড়ে। আসতে আসতে উভয় েেত্রই দেখলাম মানুষ ইঁদুরের মতোই লাফিয়ে পথে নামছে। দোকানে দোকানে মানুষের জায়গা হচ্ছে না। ফুটপাতের রিকশা ভ্যান ঘিরে যেমন মানুষ, তেমনি অভিজাত বিপনী-বিতানেও। লকডাউনের ভেতরে যানজটের দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা কম বেশি সবার হয়েছে। শুধু প্রধান সড়ক নয় গাড়ির ভিড় অলি-গলিতেও। তারপর সরকার লকডাউনের সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে দিল। ঈদের ছুটি তিনদিনের বেশি হবে না। কর্মকর্তা কর্মচারিদের নিজ নিজ কর্ম এলাকায় থাকতে হবে। কিন্তু সেই কথা শুনলো কে? ফেরিঘাটে ফেরি বন্ধ করতে বাধ্য হলো কর্তৃপ। রাতের আঁধারে বাস চলাচল বন্ধ হয়নি। দিনে-দুপুরেও মানুষ বিভিন্ন পরিবহনে কৌশলে ঢাকা ছাড়ছে। আবার ঢাকার দিকেও ছুটে আসছে এক শ্রেণির মানুষ। বন্ধ হয়নি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত। সরকার লকডাউন দিয়ে করোনা আক্রান্তের হার কমিয়ে এনেছে। মৃতের সংখ্যাও কমতির দিকে। কিন্তু এই ঈদ উৎসবকে ঘিরে যে বাঁধনহারা ছুটোছুটি, সেখানে করোনার বিস্তারের ঝুঁকি রয়ে যাচ্ছে। ভারতের করোনার ভয়াবহতা বিস্তৃত হয়েছে নেপালে। শঙ্কার কারণ আছে বাংলাদেশেও। কিন্তু আমরা সমাজের কোনও শ্রেণিই করোনার আতঙ্ককে পাত্তা দিচ্ছি না। যে পরিবারে করোনো হয়েছে, বিশেষ করে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন যারা। তারাই শুধু আতঙ্কগ্রস্থ। বাকিরা উৎসব হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে বিচলিত।
দৌড় ঝাঁপের এই কা- জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নেও ঘটছে। দোকান খুলে দেওয়ার পর থেকেই দেখা গেছে, জীবন-যাপনের প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানের চেয়ে বিলাসী পণ্যের দোকানেই ভিড় ছিল বেশি। এমন পরিস্থিতি এক মাসে দাঁড়ায়নি যে পোশাক ফুরিয়ে গেছে কোনও পরিবারের। কিন্তু পোশাকের দোকানে, ইলেকট্রনিক্স বা সৌখিন পণ্যের দোকানে বিপনী বিতান খুলে দেওয়া মাত্র মানুষ ভিড় করেছে। ঈদ যতো এগিয়ে এসেছে ভিড়ের মাত্রা সব জায়গাতেই বেড়ে গেছে। এই ভিড় যে শুধু সরকারি বারণ দিয়ে আটকানো যাবে এমন নয়। কারণ দেশের কোনও পেশা বা বাণিজ্যিক সেক্টরের অবকাঠামো এমনভাবে তৈরি হয়নি যে, সকল পেশা বা দিনমজুর, ভাসমান শ্রেণির মানুষের তথ্য-উপাত্ত সরকারের কাছে আছে। সরকারের কাছে তো নয়ই, কোনও শ্রমিক সংগঠনের কাছেও নেই। দোকান মালিকদের তথ্য থাকতে পারে দোকান মালিক সমিতির কাছে। কিন্তু লাখ লাখ দোকান কর্মচারির তথ্য তাদের কাছে নেই। ভাসমান হকারদের তথ্য নেই। আরো কত বিচিত্র পেশার মানুষ আছে, তাদের সম্পর্কে কোথাও কোনও তথ্য সংরতি নেই। ফলে সরকারের সামর্থ থাকলেই তাদের কাছে কোনও অনুদান পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। বেসরকারি উদ্যোগের পওে সম্ভব হবে না। এই মানুষগুলো শহরে বা রুজির জায়গায় থাকলে, তাদের জীবন যাত্রার যে খরচ তার জোগান না থাকলে, তাকে গ্রামে ফিরতে হচ্ছে। সেখানে পরিবারের সঙ্গে কোনোভাবে হয়তো বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে নেওয়ার সুযোগ থাকে। স্থানীয় ভাবে তার আর্থিক সহায়তা পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়ে যায়। ফলে শুধু যে ঈদ উৎসবেই মানুষ ঘরমুখো হয়েছে তেমন নয়। জীবন বাঁচাতেও শহর ছাড়তে চাইছেন অনেকে। হয়তো সরকার আগে থেকে ফেরী বন্ধ রাখলে, মহাসড়কে টহল কঠোর করলে, জনস্রোত কমানো যেতো। নিরুপায় মানুষ রুজির শহরেই রয়ে যেতো।
কিন্তু মানুষের এই তাগিদ, অসহায়ত্বকে আমরা লকডাউন পরিকল্পনায় আনিনি। মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার পর খোলা হয়েছে ব্যসায়ীদের চাপে, গণপরিবহন চালুও হয়েছে শ্রমিক-মালিকদের চাপে। বন্ধ ও খোলা কোন সমন্বিত চিন্তার মধ্য দিয়ে হয়নি। ভাবা হয়নি, সত্যিই কি রাজধানীর সামর্থ আছে, সকলকে ধরে রাখার, এমন কর্মহীন সময়ে? যদি না থাকে তাহলে তাদের সমন্বিত চিন্তা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে শহর ছাড়ার বিষয়টি ভাবা যেত। বিপনী বিতান খোলার সিদ্ধান্ত না নিলে অনেকে আপাতত শহরে ফিরে আসতোও না। বলা যেত শহর ছেড়ে চলে গেছে এমন কর্মচারি না ডেকে, অল্প আয়োজনে বিপনী বিতান খোলার। জীবিকার প্রয়োজন আছে। অর্থনীতির চাকা সচলও রাখতে হবে। কিন্তু জীবিকা জীবনের জন্যই। জীবন বিপন্ন হলে জীবিকার অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সুতরাং এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে বারবার অসফল হচ্ছি বলেই, করোনা বা আতঙ্গের ঢেউ আমাদের বিধ্বস্ত করছে। করোনাকাল দীর্ঘ হবে। তাই সময় আছে , এখনও  জীবন-জীবিকার সরল গণিত মিলিয়ে নেওয়ার। শুধু ভ্যাকসিনে করোনাকাল পাড়ি দেওয়া যাবে না। পরিকল্পনা মতো পা ফেলতে হবে সামনে।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী