শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
ষষ্ঠ পর্ব
নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় পাঁচবারে এগারো মাস অবস্থান করেছিলেন। সে সময়ে তিনি অসাধারণ কবিতা ও গান রচনা করেছিলেন। এসময় মরহুম মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস ‘আমি যাযাবর কবি’ শীর্ষক বই-এ কুমিল্লায় রচিত কবিতা ও গানের একটি তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। এটা ছিল তাঁর একক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। তার বাইরে আরও কোনো রচনা আছে কীনা তা আমাদের জানা নেই, তবে অনুসন্ধান করা যেতে পারে। জনাব আবদুল কুদ্দুস যে কবিতা-গানের কথা উল্লেখ করেছেন, তার প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করে শ্রেণিবিন্যাসও করেছেন। যেমন-
কুমিল্লায় অবস্থানকালীন নজরুল ইসলামের রচনাসমূহকে নি¤œরূপভাবে ভাগ করা যেতে পারেঃ
প্রথম ঃ নার্গিসকে নিয়ে রচনাসমূহঃ
ছায়ানট, দোলনচাঁপা, পূবের হাওয়া ও চক্রবাক কাব্যগ্রন্থে নার্গিস প্রসঙ্গ সুস্পষ্টভাবে রয়েছে।
ছায়ানট গ্রন্থে-
১. পাপড়ি খোলা দৌলতপুর কুমিল্লা বৈশাখ ১৩২৮
২. হার-মানা হার ” ” ” ”
৩. অনাদৃতা- ” ” ” ”
৪. অবেলা- ” ” ” ”
৫. বিদায় বেলায় ” ” ” ”
৬. মানস-বধূ ” ” ” ”
৭. হারামণি ” ” জ্যৈষ্ঠ ”
৮. বেদনা অভিমান ” ” ” ”
৯. বিধূরা পথিক ” ” ” ”
১০. পরশ-পূজা কুমিল্লা ” আষাঢ় ”
১১. নিশীথ-প্রীতম ” ” অগ্রহায়ণ ”
এম, এ কুদ্দুস ১৩৮৮ সনে ‘নজরুল একাডেমী পত্রিকায়’ দৌলতপুরে লেখা আলী আকবর খানের বাড়ি এবং নার্গিসের ঢাকাস্থ বাসা থেকে দশটি গান উদ্ধার করে প্রকাশ করেছেন, এছাড়া দৌলতপুরে ১৩২৮ সনে ‘লাল সালাম’, ‘মুকুলের উদ্বোধন’ কবিতা লিখেন।
‘ছায়ানটের’ চারটি গানঃ
১। অকরুণ প্রিয়া ঃ কলকাতা শ্রাবণ ১৩২৮ কুমিল্লা
২। শেষের গান ঃ ” ” ”
৩। বেদনামণি ঃ ” ভাদ্র ”
৪। লক্ষèীছাড়া ঃ ” ” ”
নার্গিসকে কেন্দ্র করেই লিখিত।
‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের অন্ততঃ সাতটি কবিতা নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছে।
১। বেলাশেষে ২। পথহারা ৩। পূবের হাওয়া ৪। অবেলার ডাক ৫। অভিশাপ ৬। আশান্বিতা এবং ৭। পিছুডাকা।
‘পূবের হাওয়া’ গ্রন্থে নার্গিস বিষয়ক কবিতা পাঁচটি ঃ ১। স্মরণে ২। বেদনা-মানিক ৩। সোহাগ ৪। শরাবন তহুরা এবং ৫। বিরহ বিধূরা।
‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থে নার্গিস বিষয়ক কবিতা তেরটি ঃ ১। ওগো চক্রবাকী ২। তোমারে পড়িছে মনে ৩। বাদল রাতের পাখী ৪। স্তব্ধ রাত ৫। মিলন মোহনায় ৬। তুমি মোরে ভুলিয়াছ ৭। হিংসাতুর ৮। সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে ৯। শীতের সিন্ধু ১০। আড়াল ১১। নদী পারের মেয়ে ১২। অপরাধ শুধু মনে থাক এবং ১৩। চক্রবাক।
দ্বিতীয় ঃ দুলী (দোলন) তথা প্রমীলা বিষয়ক কবিতা ঃ
‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের এগারটি কবিতা দুলীকে উপলক্ষ্য করে রচিত। একটা অচরিতার্থ প্রেমের কাব্য ‘দোলনচাঁপা’। ৪ঠা আষাঢ় ১৩২৮ সনে নজরুল দৌলতপুর থেকে কুমিল্লায় চলে আসেন। কুমিল্লায় তখন তিনি মোট সতেরো দিন অতিবাহিত করেন এবং তখনই নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় তাঁর জীবন। পীড়িত নজরুলের শয্যাপাশে অনুক্ষণ অবস্থান করেন দুলী। নতুন করে প্রেমরসে সিক্ত হলো কবির মন। এরই ফলে বার বার নজরুল ছুটে এলেন কুমিল্লায়। শেষ মিলনে বিক্ষুদ্ধ ও অশান্ত প্রেম শান্ত হলো। তাই তাঁর রচনায় দুলী সম্পর্কে উচ্ছ্বাস নেই।
‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের ১। দোদুল দুল ২। ব্যথা গরব ৩। উপেক্ষিত ৪। সমর্পণ ৫। চপল সাথী ৬। পূজারিণী ৭। মুখরা ৮। সাধের ভিখারিণী ৯। কবি রাণী ১০। আশা এবং ১১। শেষ প্রার্থনা- এ গানটি সংকলিত হয়েছে।
‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থে ‘দুলী’ বিষয়ক কবিতা ছয়টি ঃ ১। মনের মানুষ ২। বিজয়িনী ৩। প্রিয়ার রূপ ৪। চিরচেনা ৫। শায়ক বেঁধা পাখী এবং ৬। যুদ্ধবাদল।
এছাড়া ‘ছায়ানটের’ ‘চিরন্তনী প্রিয়াঃ কলিকাতাঃ ভাদ্র ১৩২৮ এবং ‘আলতা স্মৃতি’ঃ বহরমপুর জেলঃ অগ্রহায়ণ ১৩৩১ এ দুটি কবিতা দুলীকে কেন্দ্র করেই রচিত।
‘পূবের হাওয়া’ কাব্যগ্রন্থে মোট পাঁচটি কবিতা দুলীকে নিয়ে রচিত। বিবাহ পূর্বরাগ বিরাগের, প্রণয় খেলার, আশা নিরাশার চিত্র ফুটে উঠেছে এ কবিতাগুলোতে। এগুলো হলোঃ ১। ফুলকুঁড়ি ২। প্রণয় নিবেদন ৩। মানিনী ৪। আশা এবং ৫। গৃহহারা।
তৃতীয় ঃ কুমিল্লায় রচিত দেশাত্মবোধক গান রচিত হয়েছে সাতটিঃ
১. প্রলয়োল্লাস ২. জাগরণী ৩. বন্দী-বন্দনা ৪. বন্দনা গান ৫. মরণ-বরণ ৬. পাগল পথিক এবং ৭. হেমপ্রভা।
চতুর্থ ঃ কুমিল্লায় নজরুল শিশু বিষয়ক কবিতা রচনা করেন পাঁচটি। পরে ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থে এগুলো স্থান পেয়েছে ঃ ১. মা ২. খোকার বুদ্ধি ৩. খোকার গপ্প ৪. খুকী ও কাঠবিড়ালি এবং ৫. চিঠি।
পঞ্চম ঃ কুমিল্লায় কবি নজরুল প্রকৃতিকে দেখছেন এক মনোময় দৃষ্টিতে। গোমতীর তীরে বসে প্রকৃতিকে অবলোকন করেছেন দিনের পর দিন। তাই তিনি লিখলেন-১. নীলপরী ২. পউষ ৩. সবুজ শোভায় ঢেউ খেলে যায় এবং ৪. লাল ন’টের ক্ষেতে।
ষষ্ঠ ঃ নজরুল কুমিল্লায় বসে ২৩শে জুন ১৯২১ সালে বিকেল বেলা আলী আকবর খানকে একখানা চিঠি লিখেন এবং ১৯৩৭ সালে ১লা জুলাই নার্গিসের চিঠির জবাব হিসেবে ষোল বছর পর কলকাতা থেকে একখানা চিঠি লিখেন। এমন কি নজরুলের বিখ্যাত গানটিও শৈলজানন্দের অনুরোধে নার্গিসকে স্মরণ করে লিখিত হয়।
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তা’রে।
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।
আমি গান গাহি আপনার দুখে,
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সমুখে
আলেয়ার মত ডাকিওনা আর
নিশীথ অন্ধকারে।
দয়া কর, মোরে দয়া কর, আর
আমারে লইয়া খেলো না নিঠুর খেলা,
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না সেই
শুভ লগনের বেলা।
আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি,
তব চোখে কেন সজল মিনতি,
আমি কি ভুলেও কোনদিন এসে’
দাঁড়িয়েছি তব দ্বারে।
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।’
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, দৌলতপুরে দু’মাস কাটানোর পর আঘাতপ্রাপ্ত ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত নজরুল সেনপরিবারে সতেরো দিন কাটায়ে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে কোলকাতা চলে যান। এবং এ বৎসরই নভেম্বরে এসে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কুমিল্লা ঘুরে এসে কোলকাতায় বসে লিখলেন জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি ‘বিদ্রোহী’। মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন-
‘আমাদের ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়ীটি ছিল চারখানা ঘরের একটি পুরো দোতলা বাড়ী।.... পুরো বাড়ীটি ভাড়া নিয়েছিলেন ত্রিপুরা জেলার পশ্চিমগাঁর নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর নাতিরা (দৌহিত্ররা)। ... তখন নজরুল আর আমি নীচের তলায় পূর্ব দিকের অর্থাৎ বাড়ীর নীচেকার দক্ষিণ পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিলেন। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। .... ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।’
(কাজী নজরুল ইসলাম ঃ স্মৃতিকথা, পৃঃ ১৮৯)
এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখার পটভূমিকা যে কুমিল্লা এবং কুমিল্লায় অবস্থানকালে ঘটনাপ্রবাহ যা কবি-চিত্তকে সৃষ্টির উন্মাদনায় অসম্ভবভাবে জাড়িত করেছিল এটা আজ সকলেরই জানা। এই একটি অসাধারণ কবিতা রচনা-যে কবিতা কবিকে বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীতে অসম্ভব জনপ্রিয়তা ও ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছে।
আমার বার বার মনে হয়েছে, কুমিল্লা ও দৌলতপুরে নজরুল ইসলাম যে কবিতা বা গান লিখেছেন, তার প্রতিটির প্রেক্ষাপট এবং প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি রচনার পরিচিতি যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে সমকালীন কুমিল্লার একটি নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠবে। কুমিল্লার সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক যে ঐতিহ্যধারা বহুকাল পূর্ব থেকে চলমান এবং ঋদ্ধ জনপথ হিসেবে উপমহাদেশে কুমিল্লার গৌরবদীপ্ত পরিচিতি, হিন্দু-মুসলমানের যে ভ্রাতৃত্ববোধে সমৃদ্ধ, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। ১৯২১-২৪ সালে নজরুলের কুমিল্লায় আগমন এবং তাঁকে নিয়ে কুমিল্লাবাসীর যে উচ্ছ্বাস-আবেগ তা কতটা উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব যাপিত হয়ে আসছে, তাও অহংকার নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে।
পরিশেষে বলতে চাই, যেভাবেই হোক, যেকোনো অনুকূল সময়ে কুমিল্লাবাসী অবশ্যই নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় শতবর্ষ আগে আগমন উপলক্ষে অনুষ্ঠানটি করবে। এই অনুষ্ঠান উদযাপনের মধ্যে এক সুদূরপ্রসারী অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও ঐতিহ্য রয়েছে। জয়হোক নজরুলের শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় আগমন।
[সপ্তম পর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]