রেজানুর রহমান ।।
এই দেশে স্বাধীন, নিরপে সাংবাদিকতার দিন কি শেষ হয়ে গেলো? রোজিনা ইসলাম এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত, নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গোপন নথি চুরির অভিযোগ তোলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে এবং নির্দয় প্রক্রিয়ায় সচিবালয়ের একটি কে ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে রাতের অন্ধকারে থানায় সোপর্দ করা হয় তাকে। দিনের আলো ফুটতেই শত শত পুলিশ পাহারায় তাকে নেওয়া হয় আদালতে। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে।
রোজিনা ইসলাম গতকাল ছিল মুক্ত স্বাধীন। আজ তাকে দেখা গেলো পুলিশের ভ্যানে। লোহার গ্রিলের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অসহায়, নিশ্চুপ বেদনাকাতর আমাদেরই সহকর্মী রোজিনা। তার অপরাধ কি এতই মারাত্মক যে দেশি-বিদেশি অসংখ্য সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংগঠন বিবৃতি দেওয়ার পরও তাকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো? রোজিনা কি কারও আক্রোশের শিকার হলো?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোজিনাকে নিগৃহীত ও নির্যাতন করার একাধিক ভিডিও কিপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন নারী কর্মকর্তা কর্তৃক রোজিনার ওপর নির্যাতন করার ঔদ্ধত্য স্পষ্ট। তিনি বারবার রোজিনার গলা টিপে ধরছেন। একজন সাংবাদিকের ওপর তার কেন এত আক্রোশ? ফেসবুকেই দেখলাম নানাজনে এই সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তারা অভিযোগ করে বলছেন তার নাকি কানাডায় ৩টি, পূর্ব লন্ডনে ১টি, ঢাকায় ৪টি বাড়ি, গাজীপুরে ২২ বিঘা জড়ি আছে। এছাড়া নামে বেনামে নাকি আছে ৮০ কোটি টাকার এফডিআর (যদিও এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ কেউ হাজির করেননি)। এটা কীভাবে সম্ভব? এসব তথ্য যদি সত্য হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এসব কি তিনি বৈধ উপায়ে অর্জন করেছেন? নাকি ‘চোরের মা’র বড় গলা’। অবৈধ অর্থ সম্পদের উৎসমূলই কি তাকে অত্যাচারী করে তুলেছে। সাংবাদিক রোজিনার সঙ্গে কী তার ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল? রোজিনা কি তার অবৈধভাবে চাষ করা পাকা ধানে মই দিয়েছেন?
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত রোজিনা ইসলামের সম্প্রতি কিছু রিপোর্টের শিরোনাম তুলে ধরছি। ‘এখন এক কোটি দেবো, পরে আরও পাবেন। ৩৫০ কোটি টাকার জরুরি কেনাকাটায় অনিয়ম। পড়ে আছে জীবন রাকারী সামগ্রী, কিটের ঘাটতি নিয়ে দুই রকমের তথ্য, উৎপাদনের নয়, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি গোপনীয়তার...’ রোজিনার এই যে রিপোর্টগুলো কোনটা দেশের স্বার্থবিরোধী? বরং দেশের স্বার্থকেই জনসমে তুলে ধরেছেন রোজিনা। এজন্যই কি রোজিনার ওপর এত আক্রোশ? আবারও একই প্রশ্ন করতে চাই, সাংবাদিক রোজিনা যদি অন্যায় করে থাকেন তাহলে তার জন্য আইন আদালত আছে। শুরুতেই সেদিকে না গিয়ে কেন রোজিনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত করা হলো?
ঘটনার একপর্যায়ে অনেক নাটকীয়তার পর রোজিনাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-সচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী শাহবাগ থানায় রোজিনার বিরুদ্ধে একটি ডায়েরি করেছেন। সাংবাদিক হিসেবে রোজিনার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে রোজিনাকে চেনেন না, তার পরিচয় জানেন না, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ শাহবাগ থানায় করা অভিযোগপত্রে রোজিনাকে একজন সাধারণ নারী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অভিযোগপত্রের শুরুটা এরকম– সম্মানপূর্বক নিবেদন এই যে, অদ্য ১৭.০৫.২০২১ তারিখ সোমবার বিকেল ০২.৫৫ ঘটিকায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের একান্ত সচিব এর দপ্তরে রোজিনা ইসলাম নামীয় একজন নারী প্রবেশ করে...।
প্রশ্ন হলো, রোজিনা কি শুধুই একজন সাধারণ নারী? তার বড় পরিচয় তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ সৎ সাংবাদিক। থানায় দায়েরকৃত অভিযোগনামায় কেন তার আসল পরিচয় উল্লেখ করা হলো না? এটা সাংবাদিকতার মতো মহান পেশার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা! সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট সব সংগঠনের উচিত এ ব্যাপারে আরও বেশি সোচ্চার হওয়া। অবশ্য ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের প্রায় প্রতিটি সংগঠন রোজিনার ওপর নির্যাতনের ঘটনায় ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলছেন অনেকে। রোজিনাকে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত করার ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এই মুহূর্তে যথার্থ প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। ‘আকালমান্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি হে’। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার বোধ করি প্রয়োজন নেই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।