অধ্যাপক ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ ।।
৩১
মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানে প্রতিবছর এই
দিনটি তামাকমুক্ত দিবস হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়
হলো “ঈড়সসরঃ ঃড় ছঁরঃ” অর্থাৎ ”ধূমপান ছাড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হউন”।
ধূমপানের
নানারকম প্রানঘাতি ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশী জানি যেমন,
ধূমপান যক্ষা, হাঁপানী, ক্যান্সারসহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ, হার্ট অ্যাটাক,
মুখের ক্যান্সার, নারী-পুরুষ উভয়েরই প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস এবং মস্তিষ্কে
নানারকম রাসায়নিক ও জৈবরসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়। ধূমপানের কারণে প্রতি বছর ১৭
লক্ষ মানুষ হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে, ১৬ লক্ষ মানুষ অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি
রোগে, ১৩ লক্ষ মানুষ শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ক্যান্সারে এবং ১০ লক্ষ মানুষ
স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করে । দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান করা শতকরা ৫০ ভাগ মানুষই
সরাসরি ধূমপানের কারণে মৃত্যুবরণ করে এবং এই সকল মানুষেরা অধূমপায়ীদের
তুলনায় ১০ বছর কম বাঁচে।
এতো কিছু জানার পরও বিশে^ প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ
সিগারেট ও তামাকের নেশায় আসক্ত। ধূমপানের কারণে বছরে ৮ মিলিয়ন মানুষের
মৃত্যু হয়। তবে বিশ্বব্যাপী চলমান কোভিঢ-১৯ মহামারী শুরুর পর যখন জানা গেল
যে, অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীরা কোভিড-১৯ এ অক্রান্ত হলে বেশী করে
মারাত্মক শারিরীক অবস্থার সম্মূখীন হচ্ছে এরপরই বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ
মানুষ ধূমপান ছাড়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করে। তবে সিগারেট
ছাড়ার বিষয়টি অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। প্রথমত ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন সামাজিক ও
অর্থনৈতিক চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে বিকল্প হিসাবে মানুষ সিগারেটসহ
নানারকম নেশায় সাময়িক স্বস্তি খুঁজতে চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ত ধূমপান একটি
নেশা। যেকোন নেশাই ছেড়ে দেয়া কঠিন। আর এমনি বাস্তবতায় বিশে^র ১৩০ কোটি
ধূমপায়ীকে ধূমপান ছাড়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করাই এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত
দিবসের মূল লক্ষ্য।
তবে নতুন গবেষনায় দেখা গেছে অভ্যাসগত দিক বিবেচনায়
অল্পবয়সীদের মধ্যে ধূমপানের প্রকোপ বাড়ছে। সম্প্রতি ল্যানসেটে প্রকাশিত
গবেষণা রিপোর্টে গবেষকরা প্রতিটি দেশের সরকারকে যুব সমাজের মধ্যে সিগারেটের
আসক্তি কমানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, দেখা গেছে
শতকরা ৮৯ ভাগ নতুন ধূমপায়ীর বয়স ২৫ বছরের নীচে এবং এরচেয়ে বেশী বয়সীদের
মধ্যে নতুন করে ধূমপান শুরুর সম্ভাবনা কম। গবেষণায় প্রতিয়মান হয়েছে যে,
অল্পবয়সীরাই মূলত ধূমপানের নেশায় আসক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। রিপোর্টে
আশংকা করা হয়েছে যে, যদি অল্প বয়সীদের মধ্যে নতুন করে ধূমপানে আসক্ত হওয়ার
প্রবনতা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে না আনা যায় তাহলে ধূমপানের এই মহামারী বছরের পর
বছর ধরে চলতেই থাকবে।
যদিও বিগত তিন দশকে ধূমপানের প্রকোপ কমে এসেছে
তথাপি পৃথিবীর প্রায় ২০টি দেশে ছেলেদের মধ্যে এবং ১২টি দেশে মেয়েদের মধ্যে
ধূমপানের প্রবনতা বেড়েছে। এছাড়া মাত্র ১০ টি দেশেই রয়েছে বিশে^র মোট
স্মোকার বা ধূমপায়ীর দুই তৃতীয়াংশ। এই দেশগুলি হলো চীন, ভারত,
ইন্দেনেশিয়া, আমেরিকা, রাশিয়া, বাংলাদেশ, জাপান, তুরস্ক, ভিয়েতনাম এবং
ফিলিপাইন। চীনে প্রতি তিন জনে একজন তামাক সেবনকারী অর্থাৎ প্রায় ৩৪ কোটি ১০
লক্ষ মানুষ। আর এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছয় নম্বরে।
গবেষনায়
দেখা গেছে, বিশে^র প্রায় অর্ধেক দেশেই অল্প বয়সীদের ধূমপান বন্ধে তেমন কোন
অগ্রগতি নেই। দেখা গেছে, মানূষ গড়ে ১৯ বছরের মধ্যেই ধূূমপান শুরু করে। যদি
২৫ বছর পর্যন্ত কাউকে ধুমপান থেকে বিরত রাখা যায় তবে তাদের পরবর্তীতে
ধূমপানে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
গবেষকরা বলছে যে, ধূমপান বন্ধে সবাইকে
দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে এবং সিগারেট বা তামাকের পাশাপাশি সুগন্ধযুক্ত
নতুন ধরণের সিগারেট এবং ই-সিগারেট বন্ধেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। সেইসাথে
এগুলোর প্রচার-প্রচারনা, বিজ্ঞাপন ও বিপনন বন্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে।
অধ্যাপক ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ ।।
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন কুমিল্লা