ড. মনসুর আলম খান ||
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে দেশের ৫০তম বাজেট। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করেছেন ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন উপস্থাপিত ওই বাজেটের অঙ্ক ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দাঁড়িয়ে তিনি এটাকে আখ্যা দিয়েছিলেন 'উন্নয়ন এবং পুনর্র্নিমাণ ও পুনর্বাসন বাজেট' হিসেবে। আর এবার ঘোষিত বাজেটের শিরোনাম 'জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ'।
দুই বাজেটের মধ্যে অর্ধশতকের ব্যবধান থাকলেও লক্ষ্য অভিন্ন- বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা। আশা করা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মহামারিতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বাজেট ঘোষণা নিয়ে যেভাবে আলোচনা হয়, এর প্রণয়ন প্রক্রিয়া ততটা সহজ নয়। এর কাঠামো ও আইনি ভিত্তিও বহুমাত্রিক। এই নিবন্ধে সেদিকে আলোকপাত করতে চাই।
যেমন 'বাজেট' শব্দের উৎপত্তি নিয়েই রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। সাবেক অর্থ সচিব আকবর আলি খান 'বাংলাদেশে বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি' বইয়ে তিনি লিখেছেন- মধ্যযুগের ইংরেজি 'বুজেট' থেকে এর উৎপত্তি। বুজেট অর্থ মানিব্যাগ বা টাকার থলি। ১৭২৫ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত রবার্ট ওয়ালপুল ছিলেন যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী এবং কার্যত প্রথম প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সারাবছরই কর কমানো বা কর বাতিলের দাবি পেতেন। এসব তিনি একটি 'বুজেটে' বা মানিব্যাগে ভরে রাখতেন। অর্থবছরের শেষদিকে যখন বাজেট তৈরির কাজ শুরু হতো, তখন তিনি কাগজগুলোর ভিত্তিতেই বাজেট প্রণয়ন করতেন। সেই থেকে 'টাকার থলি বা বাজেট' হয়ে গেছে সরকারের বার্ষিক হিসাব-নিকাশের প্রতিশব্দ।
জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের আইনি ভিত্তি বাংলাদেশের সংবিধান হলেও সেখানে 'বাজেট' শব্দটিই নেই। আছে 'বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি'। সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- 'প্রত্যেক অর্থ-বৎসর সম্পর্কে উক্ত বৎসরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি (এই ভাগে 'বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি' নামে অভিহিত) সংসদে উপস্থাপিত হইবে।' এই বিবৃতিই আসলে 'বাজেট'। সংবিধানের পঞ্চম ভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের আওতায় ৮১ থেকে ৯৩ নম্বর অনুচ্ছেদে সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনার ভিত্তি বর্ণিত আছে। তাছাড়া ১৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- 'অর্থ-বৎসর' অর্থ জুলাই মাসের প্রথম দিবসে যে বৎসরের আরম্ভ।
সংসদে বাজেট উপস্থাপনের রীতি বর্ণিত আছে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি'তে। এই বিধির ষোড়শ অধ্যায়ে 'আর্থিক বিষয়াবলী সংক্রান্ত কার্যপদ্ধতি' শিরোনামে বাজেট, মঞ্জুরি-দাবি, নির্দিষ্টকরণ বিল, সম্পূরক ও অতিরিক্ত মঞ্জুরি এবং ঋণের ওপর ভোট, ছাঁটাই প্রস্তাব, প্রস্তাবের ওপর আলোচনা, আলোচনার জন্য স্পিকার বরাদ্দকৃত সময় ইত্যাদির বিশদ বর্ণনা আছে। ১১১(১) বিধিতে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিকে 'বাজেট' বলে উল্লেখ হয়েছে। ১১১(২) বিধিতে বলা হয়েছে, 'এই ব্যাপারে সংবিধানের বিধান সাপেক্ষে অর্থ-মন্ত্রী যেরূপ উপযোগী মনে করেন, সেই আকারে বাজেট সংসদে পেশ করিবেন।'
২০০৯ সালের আগে সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ছিল না। নিয়ন্ত্রিত হতো রাষ্ট্রপতি প্রণীত বিধির মাধ্যমে। সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদের বিধান সাপেক্ষে প্রণীত হয় 'সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯'। বর্তমানে এই আইন এবং সচিবালয় নির্দেশমালা-২০১৪, রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬, জেনারেল ফিন্যান্সিয়াল রুলস ইত্যাদির বিধান মোতাবেক পরিচালিত হয়ে থাকে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা। অর্থ বিভাগে প্রণীত প্রস্তাবিত বাজেট সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক 'রাষ্ট্রপতির সুপারিশ' নিয়ে 'সংসদে উত্থাপন করা' হয়। উত্থাপিত বাজেট নিয়ে সংসদীয় তর্ক হয়, হয় বিতর্ক।
বাজেটের তিনটি অংশ থাকে। প্রথম ভাগে থাকে আয়ের হিসাব। সরকারের আয়ের আবার তিনটি উৎস- জনগণের প্রদেয় কর (এনবিআর ও অন্যান্য সংস্থার আদায়); কর বহির্ভূত আয় (ফি, লভ্যাংশ, অর্থদ-, জরিমানা ইত্যাদি); বৈদেশিক অনুদান।
বাজেটের দ্বিতীয় ভাগে থাকে সরকারের সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব। সম্ভাব্য ব্যয় চারটি ভিন্ন খাতে বিভক্ত করা হয়- পরিচালন ব্যয়; খাদ্য হিসাবে ক্রয়; ঋণ ও অগ্রিম বাবদ পরিশোধ; উন্নয়ন ব্যয়। বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দরকার আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব। 'বাংলাদেশে বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি' বইয়ে বলা হয়েছে- 'আমরা যেমন দেখি, 'যদি সঠিক আয়ের হিসাবে বাজেটের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, তাহলে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হবে'।
বাজেটের তৃতীয় ভাগে থাকে সম্ভাব্য ঋণের পরিমাণ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে বাজেটকে বলা হয় 'ঘাটতি বাজেট'। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সব বাজেটই ছিল 'ঘাটতি বাজেট'। এবারও ব্যতিক্রম নয়। ঘাটতি বাজেটের অর্থসংস্থান হয় দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করে। 'ঘাটতি বাজেট' নেতিবাচক শুনালেও এটা বরং উন্নয়ন সহায়ক। আইএমএফের তথ্যমতে, কাতার, লুক্সেমবার্গ, উজবেকিস্তান ইত্যাদি পেট্রো-ডলারে সমৃদ্ধ হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাদে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই 'ঘাটতি বাজেট' দেওয়া হয়।
দেশে দেশে বাজেট উপস্থাপনের নানা ঐতিহ্য রয়েছে। যেমন কানাডায় ১৯৫০ সাল থেকে তাদের অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশের আগের দিন নতুন জুতা কেনেন। সেই নতুন জুতা পায়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী সংসদে যান, বাজেট পেশ করেন। কানাডার ইতিহাসে প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এ বছর জুতা কিনেছেন মোড়ের দোকান থেকে। করোনা আক্রান্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনার প্রতীক হিসেবে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বাজেটের প্রতীক হলো 'ব্রিফকেস'। আর এই ব্রিফকেসটি কেনা হয় অর্থ বিভাগের সেবা শাখার মাধ্যমে।
এবারের বাজেটে যথার্থ প্রতিফলিত হয়েছে 'সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ'। বাংলাদেশের এই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে। তার সুদৃঢ় নেতৃত্বেই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট।
লেখক: জেলা প্রশাসক, মেহেরপুর