শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
নবম পর্ব
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রভিভা ও ব্যক্তিত্ব। তিনি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রেরণা যুগিয়েছেন, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এনেছিলেন নতুন জোয়ার। তাঁর রচনায় সমকালে যুগমানসই প্রতিবিম্বিত। সৈনিক কবি নজরুলের হাতের লেখনি অত্যাচারী ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হয়ে দাঁড়াল ক্ষুরধার তরবারি। নজরুল প্রমাণ করলেন কলম অসির চেয়েও শক্তিশালী।
ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী সরকার নজরুল ইসলামের কণ্ঠ স্তব্ধ বা রোধ করার চেষ্টা করেছে বার বার। তাঁর পেছনে লাগিয়েছে গোয়ান্দা। বাজেয়াপ্ত করেছে একটার পর একটা লেখা-গদ্য-পদ্য বই দু’ই। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি ব্রিটিশ শাসক। কবিকে শেষ পর্যন্ত কারাগারেও নিক্ষেপ করেছে। তাঁর উপর অত্যাচার-উৎপীড়ন করেছে, কিন্তু শান্ত করতে পারেনি। কবি কারাগার থেকেই ঘোষণা দিয়েছেন-
কারার ঐ লোহ-কপাট
ভেঙ্গে ফেল, কররে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল-পূজোর পাষাণ-বেদী।
সুভাষচন্দ্র বসু বললেন-
‘কারাগারে আমরা অনেকেই যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছেন, তার প্রভাব তাঁর লেখার অনেক স্থলেই পাওয়া যায়। এতেই বোঝা যায় যে, তিনি একটি জ্যান্তমানুষ।’ (নজরুল-স্মৃতি)
কাজী নজরুল ইসলামের যত লেখা ও বই ব্রিটিশ শাসক বাজেয়াপ্ত করেছে, বাংলা সাহিত্যে আর কারও এত লেখা বা বই নিষিদ্ধ করেনি। তাতেই প্রমাণ হয়, নজরুল ব্রিটিশ শাসককে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁকে হয়রানি ও স্তব্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। একজন কবিকে তাঁর লেখার জন্য রাজদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করিয়ে একবছরের জন্য কারাবাস দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। তাতেই বোঝা যায় যে, যতই ইংরেজ জাতিকে সভ্য বলা হয় না কেন, সা¤্রাজ্যবাদী মানসিকতায় এ জাতি কতটা দেউলিয়া ছিল। সেজন্যই নজরুল বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন-
‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি রাজ কারাগারে বন্দী ও রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে-রাজার মুকুট, আর ধারে ধূমকেতুর শিখা, একজন রাজা, হাতে রাজদ-; আর একজন সত্য, হাতে ন্যায়দ-।’
বলেছেন-
‘রাজার পক্ষে-রাজার নিযুক্ত রাজবেতনভোগী
রাজ-কর্মচারী।
আমার পক্ষে-সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি-অনন্তকাল ধরে সত্য-জাগ্রত ভগবান।...
রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনে রুদ্র। রাজার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য স্বার্থ; আমার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ।’
দৃঢ়তার সাথে বললেন-
‘আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই, কেননা ভগবান আমার সাথে আছেন।’
তা একজন সত্য সুন্দর সেবকের চিরন্তন শাশ্বত বাণী। তারপরও ব্রিটিশ শাসক নজরুলকে, একজন কবিকে সম্মান জানাতে পারেনি, তাঁকে স্তব্ধ করার জন্য শাস্তি প্রদান করেছে। এতে স্পষ্টত শাসক ব্রিটিশ হেরে গেছে।
নজরুল ইসলামের এই কারাবাসের সাথে কুমিল্লাও জড়িয়ে আছে। কবি কুমিল্লা থেকে গিয়ে ১৯২২ সালের ১১ অগাস্ট ধূমকেতু প্রকাশ করেন। সম্পাদকীয়তে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয় ‘ধূমকেতু’ অসাম্প্রদায়িক পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণী পাঠালেন-
‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধার বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
রবীন্দ্রনাথ ‘কড়ি ও কোমল’ গ্রন্থে লিখলেন-
আনন্দময়ীর আগমনে
আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে,
হের ওই, ধনীর দুয়ারে
দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে।
নজরুল ইসলাম এই পদটিকে ব্যবহার করলেন রাজনৈতিক পটভূমিকায়; ফলে তা হলো নতুন তাৎপর্যবহ। কবি ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি লিখলেন-১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৯ আশ্বিন (১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের) ১মবর্ষের ১২শ সংখ্যা অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত হয়। লিখলেন-
‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’
এই কবিতার জন্য ভারতীয় দ-বিধি আইনের ১২৪এ ধারা অনুসারে ‘ধূমকেতু’ সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম ও তার মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফজালুল হক-এর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি হয়। তারিখটা ১৯২২ সালের ৮ নভেম্বর।
এই গ্রেপ্তারি পরওয়ানার পর নজরুল ইসলাম প্রথমে বিহারের সমস্তপুর চলে যান। সেখানে গিরিবালাদেবী তখন তাঁর মেয়ে দুলীকে নিয়ে সমস্তিপুরে ভাইদের কাছে ছিলেন, নজরুল তাঁদের নিয়ে কুমিল্লায় আসেন, কুমিল্লায় এসে তিনি বিরজাসুন্দরীদেবীকে ‘ধূমকেতু’র স্বত্ব লিখে দেন। নজরুল কুমিল্লায় ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর ঝাউতলা দিয়ে বিকেলে ঘুরতে বের হয়েছিলেন, তখনই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ১৯২৩ সালে ১৭ জানুয়ারি সুইনহো মামলার রায় দেন। রাজদ্রোহের অভিযোগে কবিকে দোষী সাব্যস্ত করে এক বছর সশ্রম কারাদ- দেন।
আজ কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের শতবর্ষ আগে আগমন উপলক্ষে অবশ্যই এই বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্য বিবেচনায় গ্রেপ্তারের স্থানটিকে চিহ্নিত করে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের পাশে সংক্ষিপ্ত গ্রেপ্তারের প্রাসঙ্গিক বক্তব্য লিখে একটি স্থায়ী ফেস্টুন স্থাপন করা যায়। লেখক-গবেষক ও সংস্কৃতিসেবীদের কাছে উক্ত স্থানটি একঅর্থে তীর্থভূমি হিসেবে বিবেচ্য।
[দশমপর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]