সংস্কৃতির
সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। জারি, সারি, পুঁথিপাঠ, কবিগান, কিচ্ছা—এসব তো
নেই বললেই চলে। গ্রামাঞ্চলের হাটে, মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে বহু ধরনের
গানের প্রচলন ছিল। যাত্রা, সার্কাসের মতো পেশাভিত্তিক আয়োজন ছিল। বাউল
সম্প্রদায়ের অবাধ বিচরণ ছিল। পাড়া-মহল্লায়ও ছিল নানা ধরনের আয়োজন। চিরায়ত
বাংলার সেই রূপ এখন নেই বললেই চলে; এমনকি বাংলা চলচ্চিত্রের সেই
গৌরবোজ্জ্বল দিনও নেই। তার পরও প্রাণের টানে, সংস্কৃতির আকর্ষণে অনেকেই
নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত হোক, আর
অনিয়মিত হোক, আয়োজন করা হতো নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের। এর মধ্যে ছিল
সংগীত, আবৃত্তি, মঞ্চনাটক, পথনাটক, যাত্রা, নৃত্যানুষ্ঠান, কনসার্ট
ইত্যাদি। করোনা মহামারির কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেগুলো বন্ধ হয়ে
আছে। এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িত, বিশেষ করে নির্ভরশীল শিল্পী ও কলাকুশলীরা চরম
দুরবস্থায় আছেন। অনেকেই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, মহামারি আরো
দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক শূন্যতা আরো প্রকট হয়ে উঠবে।
শিার
মতোই জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক শূন্যতা থাকলে সেখানে
দেশ-বিদেশের অপসংস্কৃতি-কুসংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মানবিকতা লোপ পায়।
মানুষের মধ্যে অনৈতিকতা, অপরাধচর্চা বেড়ে যায়। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ জেঁকে
বসে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের তেমনই ইঙ্গিত দেয়। শোষণমুক্ত,
সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের মানুষ
স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশ
স্বাধীন হয়েছিল, সেই দেশ আজ উল্টোপথে চলতে শুরু করেছে। এর অন্যতম কারণ এই
সাংস্কৃতিক শূন্যতা। এই শূন্যতা কাটাতে যাঁরা নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছেন,
যাঁরা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের সাংস্কৃতিক পরিম-লকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা
করছেন, তাঁরা নমস্য। কিন্তু করোনা মহামারি তাঁদের সামনে এক বিশাল বাধা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য দেশে যেভাবে তাদের সাংস্কৃতিক জগেক টিকিয়ে রাখার
চেষ্টা করা হচ্ছে, আমাদেরও সেভাবেই এগোতে হবে। সংকট আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে
না।
কিছু কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকা- ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তার
মধ্যে আছে আলোচনা, সংগীত, আবৃত্তির মতো কর্মকা-। কিন্তু যেসব আয়োজনে অনেকের
অংশগ্রহণ রয়েছে, ব্যাপক আয়োজনের প্রয়োজন হয়, সেসব সাংস্কৃতিক কর্মকা- বন্ধ
রয়েছে। এর মধ্যে আছে মঞ্চনাটক, পথনাটক, যাত্রা, নৃত্যানুষ্ঠান, কনসার্ট
ইত্যাদি। দীর্ঘদিন ধরে এসব কর্মকা- বন্ধ থাকায় এগুলোর ওপর নির্ভরশীল
শিল্পীরা যেমন সংকটে পড়েছেন, তেমনি সংকটে পড়েছে এসব সংগঠনও। অনেক শিল্পী
জীবিকার প্রয়োজনে অন্যান্য পেশায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে আর তাঁরা এই
পেশায় ফিরবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ জাগছে।
রাষ্ট্রের জন্য এমন
সাংস্কৃতিক শূন্যতা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি
উপলব্ধি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্পকলা একাডেমিকে এ
েেত্র আরো সক্রিয় হতে হবে।