শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
দশম পর্ব
কাজী
নজরুল ইসলাম জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে। মুক্তি লাভ
করেই কুমিল্লা চলে আসেন এবং ডিসেম্বর মাসেই গিরিবালাদেবী ও আশালতা (দুলী)কে
নিয়ে কলকাতা চলে যান। তাতেই বোঝা যায় যে নজরুলের জেলে যাবার আগেই আশালতার
সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। একথা গিরিবালাদেবী জানতেন।
জানতেন বলেই তাঁর আন্তরিক ও ঐকান্তিক ইচ্ছায়, মনের অসাধারণ দৃঢ়তার কারণে
নজরুল-দুলীর জীবন-বন্ধন এক সুষ্ঠু পরিণতিতে পৌঁছে।
‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’ গ্রন্থে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখলেন-
‘তেজস্বিনী গিরিবালা স্থির করলেন মেয়ে যখন নজরুলকে বরণ করে নিয়েছে তখন তাকে নজরুলের হাতে সমর্পণ করবেন।
কতটুকু
বা মেয়ে, (বিয়ের সময় দুলীর বয়স ছিল ১৬)। কিশোর-সরসীতে ¯œান সেরে যৌবনের
ঘাটের প্রথম সিঁড়িতে শুধু পা দিয়েছে। তবু বরণ করে নেবার পর আর প্রত্যাবর্তন
নেই। দৃঢ়তায় বদ্ধমুষ্টি গিরিবালা ‘প্রমীলার বিধবা মা, প্রমীলার বৈধী
অভিভাবিকা’ কিন্তু সামাজিক পরিবেশ কি এতই সহজ, এতই সদয়? চারদিক থেকে
প্রাতিকূল্যের তরঙ্গ উঠল। ইন্দ্রকুমার স্বভাবতই রুষ্ট হলেন, তাঁর ছেলে
বীরেনও সম্মত হতে পারল না। তা ছাড়া চারদিকের আত্মীয়মহল তা তো মুখ ফিরিয়ে
থাকবেই।
কিন্তু গিরিবালা তাঁর নীতিতে নির্মম, সিদ্ধান্তে নির্বিচল।
তাঁর মেয়ের ভবিষ্যৎ তিনি স্থিরনেত্রে দেখে রেখেছেন। জীবনের এই তটভূমিতেই
ইন্দ্রের ঐশ্বর্য খুঁজে নিয়ে তাকে নতুন অমরাবতী রচনা করতে হবে।’
অনেক
বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে নজরুল ও প্রমীলার (নজরুলের দেয়া আশালতা/দুলীর নতুন
নাম) বিবাহ স্থির হয়েছিল গিরিবালা, প্রমীলা এবং নজরুলের বোঝাপড়ার মধ্য
দিয়েই। গিরিবালাদেবী এই বিয়ের জন্য মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দেবরের সংসার থেকে
চিরদিনের জন্য কলকাতা চলে আসেন। কিন্তু দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিলেই তো হবে না-
একজন মুসলমান ছেলের সঙ্গে একজন হিন্দু মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে যে আরও
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে, তার সমাধান কি?
যতই বলা হোক বিবাহ
সম্ভব হয়েছিল একমাত্র দুলীর মা গিরিবালা দেবীর দৃঢ়তার জন্য। মেয়ের
সুখশান্তিকে তিনি সবার উপরে স্থান দিয়েছিলেন। মেয়ে যাকে ভালোবেসেছে বিয়ে
করে যদি তাতে সুখী হয়, আনন্দ পায় মা হয়ে তিনি কেন বাধা দিবেন?
অন্যদিকে নজরুল স্থির করলেন প্রমীলাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু সে স্থির হলেই তো
অন্য পক্ষের সম্ভত হবার কথা হয়। এখানে অন্য পক্ষ অর্থ প্রমীলা একা নয়,
প্রমীলার গৃহ, প্রমীলার ধর্ম, প্রমীলার স্বজন-সমাজ। প্রমীলা নিজে
অর্পিতচিত্তা, স্থিরব্রতা, কিন্তু তার মা কী বলবেন, খুড়িমা
(বিরজাসুন্দরীদেবী) কী বলবেন, ইন্দ্রকুমার-বীরেন্দ্রকুমারই বা নেবেন
কীভাবে? আর অগণন আত্মীয়ের দলই বা কী চোখে দেখবে? এ তো আইন অতিক্রম করে
পলায়ন নয়, অপহরণ বা অপসারণ নয়, এ আইনের মধ্যে থেকে সসম্মান পাণি গ্রহণ,
কন্যাপক্ষ সহজে তা মানে কী করে?
যৌবন ধর্মের বিশেষত্ব হচ্ছে দ্রোহ
এবং প্রেম। নজরুলের জীবনে এই দুটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে প্রতিভাসিত। কাজেই
১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল, ১৩৩১ সনের ১২ বৈশাখ, শুক্রবার জুম্মার পর কলকাতা ৬নং
হাজি লেইনে নজরুলের সাথে দুলীর/আশালতা সেনগুপ্ত তথা প্রমীলার শুভ পরিণয়
হয়ে যায় মিসেস এম, রহমানের উদ্যোগে ও সহযোগিতায়।
এখানে বিশেষভাবে
উল্লেখ করতে হয় যে, নজরুল ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে বিয়ে হোক তা চাননি। হিন্দু
বা মুসলমান রীতি অর্থাৎ কোনো প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তিনি বিরোধী ছিলেন।
নজরুলের ইচ্ছানুযায়ী বিয়ে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারপরও দেখা
যায়, একমাত্র মেয়ের মা গিরিবালাদেবী ভিন্ন অন্য কেউ কন্যা পক্ষে উপেস্থিত
ছিলেন না। অন্যদিকে যিনি এই বিয়ের উদ্যোক্তা মিসেস এম,রহমান এবং
নজরুল-বন্ধু খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, মৌলবী মঈনউদ্দীন হোসায়ন, ওয়াজেদ আলী,
আবদুস সালাম প্রমুখ সেজন্য বিয়েটা ‘আহলুল কিতাব’ মতানুসারে প্রায় মুসলিম
রীতি অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
নজরুলের সাথে বিয়ের পর আশালতা হলেন
প্রমীলা নজরুল। প্রমীলার সাথে নজরুলের প্রথমে প্রেম ও পরবর্তীতে পরিণয়
সূত্রে বাঁধা পড়েন। নতুন সংসার পাতালেন দু’জনে, অভিভাবিকা হিসেবে মেয়ে
সংসারে থেকে গেলেন গিরিবালাদেবী। উপায় কি। গিরিবালার যে কোথাও যাওয়ার জায়গা
রইল না। এছাড়া নজরুলের সবই আছে, আবার কোনোকিছুই নেই। মেয়ের বয়স ষোল,
নজরুলের বয়স পঁচিশ। আয়-রোজগার লেখালেখির দক্ষিণা, অনিশ্চিত। এভাবেই চলেছে
নজরুল-প্রমীলার সংসার। বিবাহটি মুসলিম রীতিতে হলেও সংসারের পরিবেশটা হয়ে
যায় হিন্দুয়ানী। গিরিবালাদেবী এভাবে তাঁদের সংসার সাজালেন, বিধবা তিনি,
নিরামিষাশী, ঠাকুর-দেবতা পূজার আয়োজন করেন গৃহের মধ্যে। খাওয়া-দাওয়া,
তৈজসপত্র, কথাবার্তা ইত্যাদি সবই হিন্দুয়ানী। নজরুলও তাতে অভ্যস্ত হয়ে
উঠলেন। এ কেমন সংসার বলব-একটি অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে উজ্জীবিত নতুন আদলে
সংসার। তাতে আছে মানবিকতা তবে গিরিবালার ছিল কিছু বাড়াবাড়ি, তিনি দু’ধর্মের
মিশ্রিত সংসারের নতুনরূপ দিতে পারেননি। নজরুলের যখন শ্যামাসঙ্গীত ও
হিন্দুরীতি গান এবং কবিতায় হিন্দু ঐতিহ্যের ধারা দেখতে পাই, তখন তাঁকে
একভাবে দেখতে পাই, আবার ইসলাম ধর্মের শাশ্বত ধারার কবিতা ও গান যখন শুনি,
তখন নজরুলকে চিনতে আমাদের ভুল হয় না। তখনই মনে হয়-নজরুল হলেন
হিন্দু-মুসলমানের মিলিত যৌগিক একটি চিরকালীন সমন্বয়ের প্রতিরূপ, যেখানে
দেশ-কাল-সমাজ-ধর্ম-মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। নজরুল হলেন প্রকৃত বাঙালির
প্রতিনিধি। এমনটিই চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিও
চেয়েছিলেন-এভাবে না হোক, অন্তত মননে-আদর্শে আমরা বাঙালি হয়ে উঠি। এ সংগ্রাম
এখনও চলছে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জন্য আন্দোলনের সময় ছিলেন ‘মুসলমান
বাঙালি’, পাকিস্তান হওয়ার পর মোহ ভঙ্গ হলো, তাঁর উত্তরণ ঘটল এবং হলেন
‘বাঙালি মুসলমান’ এবং দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ‘বাঙালি’ হয়ে এবং জাতিকে
বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্ধুদ্ধ করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে
প্রতিষ্ঠা করলেন বাঙালির স্বাধীনদেশ ‘বাংলাদেশ’। এশিক্ষার পাঠ সৃষ্টি করলেন
নজরুল ইসলাম নিজের জীবনের অন্তর্গত বিশ্বাস যাপনে ও বিবাহ নামক ঘটনার
মাধ্যমে এবং রচিত সাহিত্যের পরতে পরতে। নজরুলের ‘বাঙালির জয়’ ও ‘বাংলার
জয়’ই তো বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’, আমাদের জাতিসত্তার জয়ধ্বনি, অনন্তশক্তির
আধার, কেন্দ্রিভূত শক্তি। এ শিক্ষা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামই
দিয়েছেন।
নজরুল-প্রমীলার বিয়ে কি শুধুই বিয়ে? এই বিয়ে অনুষ্ঠান
আমাদেরকে সামাজিক ও ধর্মীয় চেতনাবোধের দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধনের পথ দেখিয়েছে।
নজরুলের জীবন পরিক্রমায় কারিশমার অন্ত নেই। কিন্তু শেষ ঠিকানা প্রমীলার
আঁচলের নীচে চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। তাই প্রমীলার অসুস্থের পর
নজরুল তাঁকে সুস্থ করার জন্য গাড়ি বিক্রি করলেন, বনগাঁয়ের জমি বিক্রি
করলেন, একের পর এক বইয়ের স্বত্ব বিক্রি করে দিলেন এবং চিকিৎসার জন্য
আয়ুর্বেদী, হোমিওপ্যাথি, আধুনিক, আধ্যাত্মিক, টুটকা পানিপড়া থেকে এমন কোনো
চিকিৎসা-নির্ভর চেষ্টা বাদ দেননি যা অভাবনীয়। ১৯৩৯ সালে প্রমীলা পক্ষাঘাতে
আক্রান্ত হলেন, শরীরের নি¤œাঙ্গ অবশ হয়ে যায়, ১৯৪২ সালে নজরুল নিজেই
বোধশক্তিহীন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তারপরের ইতিহাস আমাদের জানা।
কুমিল্লা নজরুলের শতবর্ষ আগে আগমনের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় নজরুল-প্রমীলার
বিবাহ প্রসঙ্গ, বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক ঘটনাপ্রবাহ এবং
সেখান থেকে শিক্ষাগ্রহণ এবং দাম্পত্যজীবনে নজরুল-প্রমীলার মিলন ব্যাখ্যা
উদারভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমরা এভাবেই সামগ্রিক বিষয়টি দেখতে চাই,
বুঝতে চাই, সম্ভব হলে অনুসরণ করতে চাই। বাঙালি চেতনা ও মানসিকতায়
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে নজরুল-প্রমীলার জীবনচর্চা থেকে কি আমরা
পাঠ গ্রহণ করতে পারি না? বিষয়টি ভাববার সময় এসেছে। তাহলে অন্তত সামাজিক
প্রতিবন্ধকতা দূর হবে, ধর্মীয় বাধা অতিক্রম করা সহজ হবে, বাঙালি তার নিজের
শাশ্বত পরিচয়তা পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কারণ, নজরুল মানুষকেই
সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করতেন অন্তর্গত বিশ্বাস যাপনে। তিনি ছিলেন সাম্যবাদের
মহাকবি। তিনি লিখছেন-
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রীস্টান।’
জয় হোক নজরুল ইসলামের শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় আগমন। আমরা কুমিল্লাবাসী এ গৌরবে ঋদ্ধ এবং ‘নজরুল-কুমিল্লা’ মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ।
[একাদশ পর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]