সংসদে পাস হলো মহামারীকালের দ্বিতীয় বাজেট
Published : Thursday, 1 July, 2021 at 12:00 AM
এক
দিন বাদে শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি
টাকার বাজেট অনুমোদন করেছে সংসদ। বুধবার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধরীর
সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশনে আগামী অর্থবছরের জন্য এই বাজেট কণ্ঠভোটে পাস
হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার
থেকেই কার্যকর হবে এ বাজেট। গত ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল
সরকারের এই ব্যয়ের ফর্দ সংসদে তুলে ধরেছিলেন।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের
পর পুরো অধিবেশন জুড়ে এর ওপর আলোচনা করেন সংসদ সদস্যরা। তবে মহামারীর কারণে
গতবারের মত এবারও বাজেটের ওপর আলোচনা হয়েছে সীমিত আকারে। দুই দিন আলোচনা
করেই চলতি ২০২০-২১ অর্থ বছরের সম্পূরক বাজেট পাস হয়। সপ্তাহখানেক বিরতি
দিয়ে টানা চার দিন ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনা চলে। এরপর
আরও ১০ দিন বিরতি দিয়ে দুই দিন বাজেটের ওপর আলোচনা হয়। সব মিলিয়ে শতাধিক
সংসদ সদস্য এবার বাজেটের উপর আলোচনা করেন। সম্পূরক বাজেটসহ বাজেটের উপর ছয়
দিনে ১৫ ঘণ্টার মতো আলোচনা হয়।
এর আগে গত বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে
সংক্ষিপ্ত বাজেট অধিবেশন হয়েছিল। নয় দিনের ওই বাজেট অধিবেশনে ১৮ জন সংসদ
সদস্য ৫ ঘণ্টা ১৮ মিনিট আলোচনা করেছিলেন।
সচরাচর বাজেট অধিবেশন দীর্ঘ
হয়। অধিবেশনে সম্পূরক বাজেটের উপর দুই থেকে চার দিন এবং সাধারণ বাজেট এবং
উপর ১২ থেকে ১৫ দিন আলোচনা হয়। বাজেট নিয়ে ৫০ থেকে শুরু করে ৬৫ ঘন্টার মত
আলোচনা রেকর্ড রয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বসা অধিবেশনে সংক্রমণ
এড়াতে প্রতিদিন ৮০-১০০ জন আইনপ্রণেতাকে নিয়ে বসে সংসদ অধিবেশন। সংসদ
সদস্যসহ সংসদ সচিবালয়ে কর্মরতদের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করে সংসদে ঢুকতে
হয়েছে।
কয়েকজন সংসদ সদস্যের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে
মঙ্গলবার সংসদে অর্থবিল পাস হয়। অর্থবিলে বিনাপ্রশ্নে নগদ টাকা, নতুন
শিল্পে বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার, ফ্ল্যাট ও প্লট, ব্যাংক আমানতসহ বেশ কয়েকটি
খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
এক নজরে নতুন বাজেট:
নতুন
অর্থবছরের জন্য যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের
চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৭.৫ শতাংশের
সমান।
বিদায়ী অর্থবছরে মুস্তফা কামালের দেওয়া বাজেটের আকার ছিল ২০১৯-২০
অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১৩.২৪ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৭.৯ শতাংশের সমান।
গতবারের
মত এবারও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকে বাজেট দিতে হয়েছে করোনাভাইরাস
মহামারীর সঙ্কটে টিকে থাকার পাশাপাশি অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কঠিন
চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে। তার এবারের বাজেটের শিরোনাম- ‘জীবন-জীবিকায়
প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’।
২০৪১ সালে বাংলাদেশকে
উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করে আওয়ামী লীগ
নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আগের বাজেটগুলোতে উন্নয়ন খাত বরাবরই বেশি
গুরুত্ব পেয়ে আসছিল। কিন্তু মহামারীর ধাক্কায় গতবছর থেকে সেই ধারায় কিছুটা
ছেদ পড়েছে।
এবারের ৬ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে।
এবার পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেই যাবে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ১৯ শতাংশের বেশি।
দুই
বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি না থাকায় রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের
চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। অর্থমন্ত্রীর আশা, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য
ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন।
বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
এর
মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি
টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন কামাল। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের
লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৯.৭ শতাংশ। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৫৫ শতাংশের মত।
গতবারের
মত এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা
ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের
সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ শতাংশের মত বেশি।
বিদায়ী অর্থবছরের
বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬৩ কোটি
টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা ১ লাখ ১৫ হাজার ২১৭ কোটি
টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ১ লাখ ৪ হাজার ৯৫২
কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত
বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে আমদানি
শুল্ক থেকে ৩৭ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৫৪ হাজার ৪৬৫ কোটি
টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৫৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৩ হাজার ৮২৫
কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা আদায়ের
পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
এছাড়া বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে রেকর্ড ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মত, যা মোট জিডিপির ৬.২ শতাংশ।
বরাবরের মতই বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রীকে নির্ভর করতে হবে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর।
অর্থমন্ত্রী
আশা করছেন, বিদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস
থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি তিনি মেটাবেন।
অভ্যন্তরীণ
খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২
হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার
লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।
মহামারীর মধ্যেই বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ৮
দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা
দুই দফা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
অর্থমন্ত্রী আশা
করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে
আটকে রেখেই ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।
বুধবার
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনের শুরুতেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও
বিভাগের মঞ্জুরি দাবিতে আলোচনা করার কথা জানান। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা
এসব দাবিতে আলোচনা করেন।