শান্তনু চৌধুরী ||
ইউরোপ,
আমেরিকার দেশগুলো এখন করোনা ভাইরাস তাড়িয়ে দিতে সম হচ্ছে। এই সমতার পরিচয়
দিয়ে তারা ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনের দিকে। অন্যদিকে, আমরা
যারা নিজেদের করোনার চেয়ে শক্তিশালী ভেবেছিলাম এবং করোনাজয়ী বীর ভেরে
আস্ফালন করেছিলাম তাদের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ হচ্ছে। আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণের
জন্য সাফল্যগাথা রচনা করতে শুরু করেছিলাম বেশ কয়েকমাস আগেও। এবং এতে
সরকারের কি ধরনের কৃতিত্ব রয়েছেও তারও প্রচার চলছিল। কিন্তু সেই মানুষগুলোও
কেমন যেন চুপসে গেছে। যারা বলেছিল, এই রোগটি একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে ধরবে
না তারাও গর্তে ঢুকে পড়েছে। আর অনেকে মনে করেছিল এটি শহুরে মানুষ, যারা
আরাম আয়েশে বসবাস করেন তাদের রোগ, তারাও যেন আজ উপলব্দি করতে পারছেন। মোট
কথা দেশের মানুষ এখন স্বস্তিতে নেই। একটু কড়া করে বললে, মানুষ এখন ভালো নেই
এবং যতোণ পর্যন্ত না করোনা ভাইরাসকে তাড়ানো যাচ্ছে ততোণ পর্যন্ত ভালো
থাকার কোনো কারণ নেই। সেেেত্র সরকারকে দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই। কারণ নিজে
সচেতন না হলে সরকারের একার পে এসব সমাধান বেশ করা বেশ মুশকিল। তাছাড়া সব
েেত্র লাঠি দিয়েও সচেতন করা যায় না।
গ্রামে যে করোনা রোগ হয় না সেই
‘ধারণা’ এখন ভুল প্রমাণিত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতে, জেলা সদরের
হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর অর্ধেকের বেশি গ্রামের। গ্রামে এখন
ঘরে ঘরে ঠা-া এবং জ্বরে ভোগা রোগী আছেন। তাদের মাঝে যারাই টেস্ট করাচ্ছেন,
পজিটিভ হচ্ছেন। আবার করোনার ভয়ে অনেকেই টেস্ট করাতে যাচ্ছেন না মৌসুমি জ্বর
ও ঠা-া ভেবে। গ্রামে গ্রামে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ
হয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। বেড়েছে মৃত্যুও। ঢাকার পাশপাশি সব বিভাগেই
বেড়েছে করোনা সংক্রমণের হার।
এসব বিভাগের প্রায় সব জেলায় রোগী পাওয়া
যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। ঢাকা বিভাগের ঢাকা, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ি, ফরিদপুর,
কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জে রোগীর সংখ্যা বেশি। ময়মনসিংহ বিভাগের
ময়মনসিংহ জেলা, চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলা, কক্সবাজার, ফেনী,
নোয়াখালী, কুমিল্লাতে রোগীর সংখ্যা বেশি। তাছাড়া রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী
নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর,
পঞ্চগড়, গাইবান্ধায় সংক্রমণের হার বেড়েছে। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে
বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠি, এবং সিলেট বিভাগের সিলেট,
সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
এখন কথা হচ্ছে, কেন গ্রামে
রোগী বেড়েছে বা বাড়ছে। এেেত্র জাতীয় সংসদে বলা প্রধানমন্ত্রীর কথাটা স্মরণ
করতে হয়, তিনি বলেছেন, গত ঈদে মানুষ গ্রামে না গেলে এখন এতোটা খারাপ
অবস্থা হতো না। সেটা যে কতোটা সত্য তা এখন মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
সামনে ঈদুল আজহা। এেেত্র কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে হবে মানুষকে। যে মহিমায়
আমরা বলে থাকি পশু কোরবানি। এবারের ঈদে গরুর হাট না বসালে, ঈদে গ্রামে না
ছুটলে সামনের পরিস্থিতি ভালো হবে বলে আশাবাদ। প্রয়োজনে অনলাইনে কেনাকাটা
সেরে নেওয়া যায়। দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতেতো আমরা কতো উৎসবই না জাঁকজমকভাবে
করি না। সেটা পারিবারিক সংকটের সময়ও, আর এতো দেশের জন্য মহা দুর্যোগ।
পুলিশের আইজি বলেছেন, ১৫ দিন ঘরে থাকুন, ৫০ বছর ভালোভাবে বাঁচুন।
এই
কথার কিন্তু গূঢ় অর্থ রয়েছে। কিন্তু এসব কথা শুধু শিতি মানুষজন বুঝলে হবে
না। প্রতিটি মানুষকে বিবেচনায় নিয়ে অনুধাবন করতে হবে। এটা ঠিক যে, মানুষ
অর্থকষ্টে আছে, খাদ্যের কষ্টে আছে। এসব বিষয় নিশ্চয় সরকার বিবেচনা করবে।
পাশাপাশি মানুষকে এটা বিবেচনায় নিতে হবে, যদি করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার
জন্য মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা বা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার
মতো সাধারণ নিয়মগুলো মেনে চলতাম তাহলে সংক্রমণও বাড়তো না।
একইসঙ্গে
সরকারকেও কঠোর হতে হতো না। তাই এেেত্র সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব কম নয়।
অনেকে বলছে, খাবার দিয়ে লকডাউন দিতে। আসলে এটাও পুরোপুরি সমাধান নয়, ওই যে
বললাম ভাইরাস তাড়ানো না গেলে খাবার দিয়ে কি মানুষ বাঁচবে? সবাইকে বুঝতে হবে
আমি কি আমার দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করছি। বাইরের দেশের দিকে যদি দেখি,
যারা ভাইরাস জয় করেছে সেখানে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে
নিজের বিষয়ে সচেতন। অনবরত তারা ভাইরাস থেকে বাঁচতে করণীয় ঠিক করতে প্রচার
চালাচ্ছে। আমাদের দেশের কতোজন মন্ত্রী, মেয়র বা সচিব বা প্রশাসন কতোটা
প্রচার চালিয়েছে? আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোকেও আরো বেশি বেশি করে প্রচার
চালাতে হবে। কারণ গ্রাম বলেন আর শহর বলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি বোধ,
বিবেচনা না আসে। তারা যদি মাস্ক করার মতো বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে না পারে
তাহলে লকডাউন কোনো কাজে আসবে না।
আমরা কী দেখছি? রাস্তাঘাটে সেনাবাহিনী
ঘুরছে, পুলিশ ঘুরছে, বিজিবি ঘুরছে কিন্তু তাতে কী লাভ হচ্ছে? বরং সব খুলে
দিয়েও যদি কেবল শতভাগ মাস্ক পরা নিশ্চিত করা যায় তবেই সম্ভব দেশকে রা করা।
প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। মাস্ক না পরলে জেলে যাওয়ার মতো আইন তৈরি করতে হবে,
প্রয়োগ করতে হবে। কোনও জরিমানাতে কাজ হবে না, হচ্ছেও না। মানুষ যদি বুঝত,
যদি বোঝার হতো তাহলে এত মানুষকে প্রতিদিন জরিমানা করতে হতো না। যেটা
বলছিলাম, লকডাউন চলছে, যদিও কঠোরতা কমেছে। কিন্তু নিজের জন্য নিজেকে সচেতন
হতে হবে। দেশকে বাঁচাতে সচেতন হতে হবে। উৎসব ফিরে ফিরে আসবে। জীবন একটাই
একবার চলে গেলে আর ফেরানো যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।