আজ ২৭ জুলাই’২১ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর ৬৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ১৯৫৭ সনের ২৫ ও ২৬ জুলাই দুই দিনব্যাপী পুরানো ঢাকার সদরঘাটের কাছে রূপ মহল সিনেমা হলে তৎকালীন পাকিস্তানের সর্ববৃহত্তম গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ২৭ জুলাই জন্ম নেয় সারা পাকিস্তান ভিত্তিক সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, অসম্প্রদায়িক দল ন্যাশনাল আওয়াামী পার্টি (ন্যাপ)।
ন্যাপ গঠনে নেতৃবৃন্দের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ তোয়াহা, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, সেলিনা বানু, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, আহমেদুল কবির প্রমুখ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছিলেন সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফার খান, ইফতেখার উদ্দিন, জিএম সৈয়দ, মাহমুদুল হক ওসমানী, গাউস বক্স বেজেনজো, মিয়া ইফতেখার উদ্দিন প্রমুখ।
১৯৬৭ সালে রাজনৈতিক মতবিরোধের ফলে ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তখন সারা পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি হন খান আবদুল ওয়াালী খান ও পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে সকল আন্দোলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক েেত্র ন্যাপ এবং ন্যাপের প্রয়াত সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের অবদান ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) দেশের বহুল আলোচিত একটি রাজনৈতিক দল। আন্দোলন সংগ্রাম আর মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে নিবেদিত এ রাজনৈতিক সংগঠনটির আজ ৬৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এ উপ মহাদেশে বাম রাজনৈতিক চেতনা ও সংঘবদ্ধ রাজনীতি সূচিত হয়েছিলো বৃটিশ যুগে। সেই সূত্র ধরে নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে ২৭ জুলাই বাম ধারার এ রাজনৈতিক সংগঠনটি জন্ম লাভ করে। সারা পাকিস্তান ভিত্তিক এ সংগঠনের আতœপ্রকাশ ঘটে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সংকল্পবদ্ধ একটি দল হিসেবে। সকল বিদেশি শক্তির প্রভাব মুক্ত, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ঘৃণ্য চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে , বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ সংগঠনের মূল আদর্শ হয়ে দাঁড়ায় যার ফলে সমাজতন্ত্র ই এ সংগঠনের উদ্দেশ্য রূপে প্রভিভাত হয়। যার ফলে একটা আদর্শিক মতাদর্শ ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে দেশের বহু বরেণ্য কবি সাহিত্যিক, শিক্ষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এ সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। জন্ম নেয় নতুন প্রত্যাশা ও নবজীবনের উদ্দীপিত পথচলা।
১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই এক কর্মী সম্মেলনের মধ্যদিয়ে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে নতুন এ উদারনৈতিক সংগঠনের আতœপ্রকাশ হয়। ২৭ জুলাই সংগঠনটির নতুন কাঠামো অর্থাৎ কমিটি গঠিত হয়। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ‘ নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন’ এ ব্যানারে আয়োজিত এ সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সীমান্ত গান্ধী নামে খ্যাত খান আবদুল গাফফার খান সহ অনেক নেতৃবৃন্দ যোগদেন। উভয় প্রদেশ থেকে সর্বমোট ১২শত সদস্য এ কর্মী সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে।
উপস্থিত সদস্যদের সর্ব সম্মতি ক্রমে সংগঠনের নাম নির্ধারণ হয় । নিখিল পাকিস্তান ন্যাপ এর সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের ও সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই থেকে শুরু নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে ন্যাপ একটি গণতান্ত্রিক শক্তি রূপে আবির্ভূত হয়। ১৯৬৬ সালে মস্কোপন্থি চীন পন্থি মতানৈকের মধ্যে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ প্রাদেশিক ন্যাপের (মস্কো পন্থি) সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আলতাফ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকুরী ছেড়ে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। ন্যাপ কৃষক মজুর ও সাধারণ নিরন্ন মানুষের ভাতের অধিকার, চাকুরীর অধিকার, সামাজিক অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এ রূপ নানা রকম আন্দোলন সংগ্রামে বহু নেতা কর্মী নিহত হয় ভোগ করতে হয় জেল জুলুম হুলিয়া। তবুও একটি আদর্শিক ত্যাগী সংগঠন হিসেবে ন্যাপ গড়ে ওঠে। জন মানুষের আস্থার অর্জন করতে সমর্থ হয়।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ন্যাপ অংশ গ্রহণ করে। ন্যাপ ছাত্রইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করে এ বাহিনীতে ২০ হাজারের অধিক সদস্য ছিলো। তার বাইরেও সাধারণ মুক্তিয়োদ্ধাদের মাঝেও ন্যাপ কর্মীরা যুদ্ধে অংশ নেয়। প্রাণ দেয় অনেক নেতা কর্মী। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন আধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাহায্য সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ রাখেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। তিনি এ সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ইতিহাসের যুক্তিসংগত পরিণতি। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনও স্বর্ণোজ্জল অধ্যায়। স্বাধীনতার পর ন্যাপ একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। শ্রমিক কৃষকের দাবি, সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী কর্মসূচি, দুর্নীতি , সামাজিক ন্যায়, নানা বিষয়ে সোচ্চার হয়। তৈরি হয় আন্দোলন সংগ্রামে ন্যাপের নতুন ইতিহাস। দেশের সার্বিক কল্যাণ ও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ও স্বাধীনতা বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র রুখতে ত্রিদলীয় ঐক্য জোটে যোগ দেয় ন্যাপ।
মহান জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকা- পরিস্থিতিতে ন্যাপের কার্যক্রম স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। ৯০-৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় ঘটে। ইতোমধ্যে বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যেও সোভিয়েত বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ে। ন্যাপের অবস্থা হয় তখন ‘কিংবর্তব্য বিমূঢ়’। সামরিক শাসনের পর গণ তান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলে বিপর্যস্ত ন্যাপ আগের শক্তি ও জন সমর্থনে দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তারপর দেখা দেয় ন্যাপ ভাঙন। কিছু কিছু নতুন দল একতা পার্টি, গণতান্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, ন্যাপ (হারুন) গড়ে ওঠে। আবার বিপুল সংখ্যক নেতা কর্মী বিভিন্ন দলে যোগ দেয় ফলে ন্যাপ একটি দুর্বল দলে পরিণত হয়। তারপরও ন্যাপের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ন্যাপ প্রধান জননেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় ন্যাপের কর্মচাঞ্চল্যেও গতি শ্লথ হয়ে যায়। ন্যাপের শ্লথ গতি থেকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ জননেতা পঙ্কজ ভট্টচার্যের নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্যের আহবানে ঐক্য ন্যাপ গঠিত হয়। আজ আমাদের প্রিয় নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রয়েগেছে ন্যাপ। রয়েগেছে হাজার হাজার ত্যাগী পরীক্ষিত কর্মী সমর্থক যাদের বেশির ভাগই এখন নিষ্ক্রিয়। শুধু মাত্র আদর্শিক কারণে সারা জীবন ত্যাগ স্বীকার করে কোনো লোভ ও মোহের কাছে নতি স্বীকার না করে হাজার হাজার কর্মী সমর্থক আজ আমাদের কাছ থেকে চির বিদায় নিয়ে গেছেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা জীবন দিয়ে গেছেন সেই সব বীর শহীদ ও নেতা কর্মীদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি।
আজ দেশের সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান প্রয়োজন। বাম ধারার ঐক্য সময়ের দাবি। সেই সাথে নিষ্ক্রিয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ন্যাপ কর্মী এবং অন্যদলে থাকা ন্যাপের কর্মীদের ন্যাপের পতাকা তলে সমবেত করা প্রয়োজন। ন্যাপ কে শক্তি শালী করতে হলে ঐক্যের বিকল্প নেই। ন্যাপের কাছে মানুষের প্রত্যাশা এখনো আছে। তাই একান্ত আহবান আসুন সকল অভিমান ভুলে আমরা ন্যাপের পতাকা তলে সমবেত হই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে মেহনতি মানুষের আকাক্সক্ষা বাস্তাবায়নে বিকল্প শক্তি হিসেবে দেশে আদর্শিক রাজনীতি ও সামাজিক ন্যায় বোধের প্রতিষ্ঠা করি। দেশবাসী এখনো আমাদের চায়। মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে আসুন আমরা আবার সক্রিয় হই। নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা উজ্জীবিত হই। সকল মান অভিমান তিক্ততা ভুলে ন্যাপ গঠনে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। আগামীদিনে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমন্বিত নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গড়ে তুলি।
ঐক্যবদ্ধ ন্যাপ গঠনের প্রত্যাশায়
কুমিল্লা উত্তর জেলা ন্যাপের সাবেক সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মোস্তাকুর রহমান (ফুল মিয়া চেয়ারম্যান), কুমিল্লা উত্তর জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের সরকার, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি কুমিল্লা জেলা শাখার সাবেক সহ সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই, সাবেক সভাপতি সরকার ফারুক আহমেদ, সাবেক সভাপতি মো: বশির আহমেদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন টুটুল, সাবেক কার্যকরী সভাপতি অধ্যাপিকা নাজমা আহমেদ, সাবেক সহ সভাপতি আবদুল কাদের, সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বাবুল, সাবেক সহ সভাপতি কামাল আবু নাছের হাছান, সাবেক সভাপতি অধ্যাপক সমিরন চৌধুরী, সাবেক সভাপতি অধ্যাপক সুজিত কুমার রায়, সাবেক সহ সভাপতি আহমেদ খায়রুল বাসার খোকন, শহর শাখার সাবেক সভাপতি জুলফিকার আগা বাছেদ, কুমিল্লা জেলা শাখার সাবেক সভাপতি একেএম ইকবাল, সাবেক সহ সভাপতি গোলাম মহিউদ্দিন (অপু) ও সাবেক আহবায়ক সানোয়ার আহমেদ।