বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
Published : Saturday, 31 July, 2021 at 12:00 AM
রণবীর ঘোষ কিংকর।
কুমিল্লার
চান্দিনা উপজেলার পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে গল্লাই গ্রাম। ওই গ্রামেরও পশ্চিমাংষে
স¤্রান্ত মুন্সি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ। ওই
মুন্সিবাড়ির পরই পাশ্ববর্তী চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার সীমানা।
গল্লাই
থেকে চান্দিনা উপজেলার দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ
অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে পিতা আলহাজ্ব মাওলনা ইসমাইল হোসনে মুন্সি ও মাতা
শাসমছুন্নাহারের গর্ভে জন্ম নেন অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ।
মায়ের
অনুপ্রেরণায় প্রায় দুই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বাড়ির বৈঠকখানায় শিক্ষজীবন
শুরু করেন তিনি। খাল-বিল নালার বর্ষায় অবলম্বন নৌকা আর শুকনো মৌসুমে রোদ
জল কাঁদা পেরিয়ে পায়ে হেঁটে যাতায়াত ছিল তাঁর।
গল্লাই থেকে ১৫ কিলোমিটার
পথ পায়ে হেঁটে রামমোহন এসে পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বৃত্তি
লাভ করেন তিনি। শৈশবেই পিতাকে হারিয়ে মায়ের আঁচলেই তার ঠিকানা। ১৯৬২ সালে
চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
তিনি কুমিল্লা নিউ হোস্টেলে
থেকে লেখাপড়া করতে শুরু করেছিলেন। মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় প্রায়ই
মায়ের কথা মনে পড়লে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে আসতেন তিনি। টেম্পু বা ‘মুড়ির
টিন’ খ্যাত বাসে করে চান্দিনা নেমে প্রায় ২৬ কিলোমিটার খাল-বিল-পথ পায়ে
হেঁটে প্রত্যন্ত গ্রাম গল্লাই গিয়ে মায়ের আঁচলে গিয়ে মুখ মুছতেন তিনি। যখনই
মায়ের মুখ দর্শন করতেন তখনই তার সব কষ্ট যেন ¤œান হয়ে যেতো।
ওই সময়
পাকিস্তান শাসক আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জেগে উঠে পূর্ব বাংলার সকল
ছাত্র-শিক্ষক। শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের প্রতিবাদে আন্দোলন। চলছিল,
আইয়ূব-ফাতিমা জিন্নাহর নির্বাচন। ভোটার ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ও
সদস্যরা ভিক্টোরিয়া কলেজ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায়
জোড়ালো বক্তব্য দেন তৎকালিন মেধাবী শিক্ষার্থী মো. আলী আশরাফ। ওই সময় তার
বক্তৃতা জনতার হৃদয়ে দাগকাটতে থাকে। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সেই বছর হোসেন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমান আসেন কুমিল্লা টাউন হলে।
একদিন
রাতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সিনিয়র ছাত্রদের সাথে টাউন হলে দেখা করতে
আসনে মো. আলী আশরাফও। গিয়ে দেখেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘুমিয়ে আছে।
সাক্ষাৎ দিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই সময় ছাত্রনেতা হাবিবউল্লাহ চৌধুরী, আফজল খান,
যুক্তফ্রন্টের মিনিস্টার আব্দুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন। প্রথম সাক্ষাতের
পর বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ করার পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হন আলী আশরাফ।
আলী আশরাফ
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যয়ণরত অবস্থায় ঢাকায় ছাত্রলীগের কনফারেন্স
হয়। ওই কনফারেন্সে যোগ দিলেন আলী আশরাফও। কিছুক্ষণ পর গাড়িতে চড়ে ওই
কনফারেন্সে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গাড়ি থেকে নেমে আলী আশরাফ কে
দেখা মাত্রই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই ছেলে, তোমার বাড়ি কুমিল্লা না?’
কিছুক্ষণের দেখায় এতোদিন পর আলী আশরাফকে মনে রাখায় অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেলেন
তিনি।
সেই দিন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীক্ষায় দিক্ষিত
হয়ে রাজনৈতিক জীবনের পথ চলা শুরু। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া বাংলাদেশ
ছাত্রলীগে যোগদান করেন আলী আশরাফ। বঙ্গবন্ধুর স্বপক্ষে জনমত গঠনে বক্তব্য
দিতেন কুমিল্লাসহ আশ-পাশের জেলা নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চাঁদপুর ও
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা।
১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে
অধ্যয়ণয় করে এসএম হলে থাকতেন তিনি। অর্থনীতি বিভাগের ছাত্ররা তখন রাজনীতিতে
তেমন সক্রিয় না থাকলেও আলী আশরাফ ছিলেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে এমএ পাশ করেন। লেখাপড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলেও জ্ঞানার্জনের জন্য
বই ত্যাগ করেননি তিনি। আমৃত্যু বইয়ের সাথে ছিল তাঁর দারুন সখ্যতা। যে কারণে
বহুমূখী অধিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি।
১৯৭০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম
পাকিস্তান নির্বাচনে সংসদ নির্বাচনে মাত্র ২৩ বছর বয়সে স্বতন্ত্র প্রার্থী
হয়ে ‘মই’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। একই বছর দোল্লাই নবাবপুর
গ্রামে গড়ে তোলেন দোল্লাই নবাবপুর কলেজ। ওই কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতাও
করেছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের প্রথম দিকে মায়ের আদেশে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ
হন তিনি। শুরু হন মুক্তিযুদ্ধ। অন্তঃসত্তা স্ত্রীকে রেখে বঙ্গবন্ধুর ডাকে
সারা দিয়ে দেশ মাতৃকা রক্ষায় ঝাপিয়ে পড়েন সাহসী ওই মুক্তিযোদ্ধা।
দেশ
স্বাধীনের পর মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃ প্রচার বিভাগের
পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশ সংসদ প্রথম
নির্বাচনে তৎকালীন চান্দিনার আওয়ামীলীগ নেতা হাজী রমিজ উদ্দিন কে দলীয়
মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। হাজী রমিজ উদ্দিন এর বাড়ি মুরাদনগর এবং আলী আশরাফ
এর বাড়ি চান্দিনায় এমন প্রশ্নে কেন আলী আশরাফকে মনোনয়ন দেয়নি সেই ক্ষোভে
চান্দিনার অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ আলী আশরাফকেই এমপি পদে নির্বাচনের জন্য চেপে
ধরেন। কিন্তু তিনি যে মায়ের কথা ছাড়া এক পাও চলেন না! এসময় নেতা-কর্মীরা
ছুটে যান তাঁর বাড়িতে। অনুনয়-বিনয় করে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন
নেতা-কর্মীরা। সকলের অনুরোধে সম্মতি মিলে মা সামছুন্নাহারের। ‘মাছ’ প্রতীক
নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ।
পরবর্তীতে
আওয়ামী লীগ যতগুলো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন সকল নির্বাচনেই তিনি আওয়ামী
লীগের মনোনীত প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ১৯৯৬,
২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫ম বারের মত বিজয়
লাভ করেন। রাজনৈতিক কর্মকান্ড আরও গতিশীল করতে ১৯৯৩ সালে কুমিল্লা উত্তর
জেলা পৃথক হওয়ার পর তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতা
সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৮ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও
পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০০০ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদের ডেপুটি
স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষে তিনি আমৃত্যু সরকারি প্রতিশ্রুতি
বাস্তবায়ণ সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। শুক্রবার
বিকাল সাড়ে ৩টায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রায় ৬০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ইতি
টানেন বর্ষিয়াণ ওই আওয়ামী লীগ নেতা।