ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
নারীর বস্ত্রহরণের নিকৃষ্ট উল্লাস বন্ধ হোক
Published : Wednesday, 18 August, 2021 at 12:00 AM
নারীর বস্ত্রহরণের নিকৃষ্ট উল্লাস বন্ধ হোকলীনা পারভীন ।।
দুদিন পরপর একেকটি ইস্যু আসে আর আমাদের মধ্যে চলতে থাকে নারকীয় উল্লাসের মজমা। আর সেই ইস্যু যদি হয় একজন নারীকে কেন্দ্র করে, তাহলে সেই মজমায় যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া আলোচিত নায়িকা পরীমণির ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনলাইন মিডিয়ায় চলছে সত্য মিথ্যার আসর। ফেসবুক, ইউটিউব খুললেই এখন কেবল পরীমণি আর পরীমণি।
ভেবেছিলাম এই বিষয়ে কিছু লিখবো না, কারণ এটি একান্তই বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা বলে আমি মনে করি। কিন্তু যেভাবে মেয়েটিকে নিয়ে মুখরোচক কাহিনি বানানো হচ্ছে, না লিখে আর পারা গেলো না। চারপাশের কা- দেখে মনে হচ্ছে দেশে হয়তো এই প্রথম কোনও নারীকেন্দ্রিক ঘটনা ঘটলো বা এই প্রথম একজন মানুষ পাওয়া গেলো যে দেশের আইন অমান্য করে ঘরে মদ রেখেছিল। পরীমণি দোষী কী নির্দোষ সেই আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। কারণ, বিষয়টি বিচারাধীন এবং আইনের বিষয়। সময় সবকিছু পরিষ্কার করে দেবে বলে বিশ্বাস করি। পরীমণি যদি কোনও অপরাধ করে থাকে তাহলে তো তার আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি হবেই। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যে অরুচিকর ভিডিও বানানো হচ্ছে সেগুলো কি অপরাধ নয়?
ইউটিউবে এখন পরীমণির কাহিনি ছাড়া আর কোনও ভিডিও প্লে লিস্টে আসে না। সেসব ভিডিওর প্রায় সবগুলোই হচ্ছে বানোয়াট ও উদ্ভট কাহিনি দিয়ে ভরপুর। যে যেভাবে পারছে মনের মতো করে গল্প বানিয়ে কিছু ভিডিও বানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে অনলাইনে আর আমাদের মাথামোটা জনগণ সেগুলো গোগ্রাসে গিলছে। একেকটার ভিউ লাখের ওপরে।
ভিডিওগুলোর সবকটির চটকদার হেডলাইন দিয়ে ভেতরে কুৎসিত ভাষায় কিছু বর্ণনা ছাড়া আর কিছুই নেই। একটি ভিডিও দেখলাম লেখা পরীমণির গোমর ফাঁস করে দিলেন গায়ক আসিফ, অথচ ভেতরে আসিফের কোনও বক্তব্য নেই। এমন বানোয়াট ভিডিও কারা ছাড়ছে? কী লাভ তাদের? কী পাচ্ছে এরা?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেখলে মনে হয়, দেশে আর কোনও অপরাধী কখনও ধরা পড়েনি।
এ দেশে আর কারও কি এমন লাগামহীন জীবনযাপনের কাহিনি নেই? পরীমণি যা করেছে সেখানে কি কোনও পুরুষ ছিল না? সে একা একাই সব করেছে? কারা যেত তার মদের আসরে? তেমন বিষয় নিয়ে কিন্তু কোনও ভিডিও নেই। কেন নেই?
পরীমণি একজন নারী বলে? নারীদের নিয়ে কল্পকাহিনি করা খুব সহজ বলে? কোনও নারীর চরিত্র নিয়ে মন যা চায় তা-ই বলে পার পাওয়া যায় বলে? আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী করছে এখন? পরীমণি যদি কোনও অপরাধ করে থাকে তাহলে তো সেটি আইন ও আদালতের স্বাভাবিক নিয়মেই বিচার হওয়ার কথা, এত মিডিয়া ট্রায়াল কেন? লোকের চোখে তাকে একজন খারাপ নারী প্রমাণ করার কী এমন তাগাদা এবং কাদের? যারা অনলাইনে পরীমণিকে নিয়ে যা ইচ্ছেতাই সত্য মিথ্যার গল্প বানিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কেন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না?
পরীমণিও তো এ দেশের একজন নাগরিক। তারও আইনি সহায়তা পাবার অধিকার রয়েছে। তার গোপনীয়তা রার দায়িত্ব এই রাষ্ট্রের। কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি কি?
রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকদের গোপনীয়তাকে রা করতে না পারে তাহলে সে রাষ্ট্রকে সভ্য রাষ্ট্র বলা যায় কি? একজন অপরাধীর বিচার হবে তার অপরাধের ত্রে ধরে। কেন তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে টানাটানি হবে? একজন মানুষ কখন, কোথায় কী করেছে সেগুলো জানাটা কতটা প্রাসঙ্গিক? এর মাধ্যমে কি আমরা সমাজকে ভালো কিছু শিখাতে পারছি? আমাদের প্রজন্মের সামনে এ কোন সংস্কৃতিকে উন্মোচন করছি আমরা? কী শিখবে আমাদের সন্তানেরা?
একজন নারীর সম্পর্কে কতটা সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখ ও মন জন্মাবে তাদের? একজন মানুষ সে নারী বা পুরুষ যেই হোক, তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অবশ্যই রা করতে হবে। সভ্য রাষ্ট্র, সভ্য সমাজে এমন নারকীয় উল্লাসকে আমন্ত্রণ জানানো কখনই ভালো উদাহরণ হতে পারে না। রামায়ণে সীতার বস্ত্রহরণের বর্ণনা পড়েছিল সবাই। কিন্তু সেটি তো ছিল প্রাচীন ও পিছিয়ে পড়া যুগের কাহিনি। আধুনিক ও সভ্য যুগে কি এসব চলতে পারে? একবিংশ শতকে এসেও যদি আমরা কল্পকাহিনিতেই মজা পেতে থাকি তাহলে বুঝতে হবে আমাদের মধ্যে আধুনিকতার হাওয়া কিছুই লাগেনি। এখনও আমরা কূপম-ূকতার যুগেই পড়ে আছি। এমন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা একপ্রকার বিলাসিতা। বিড়ালের গলায় মুক্তোর মালার মতো শোনায়। রাষ্ট্র এগোবে কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনগণের চিন্তাচেতনাতেও যদি পরিবর্তন না আনা যায় তাহলে সেই এগোনো আসলেই এগোনো নয়; পিছিয়ে পড়াই বলা যায়।
লেখক: কলামিস্ট