নগর সভ্যতা
কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||
তারপর
আবার বৃষ্টি নামে শহর ও শহরতলীতে। উত্তরের কালো আকাশ, আষাঢ়ে আকাশ। মতিগতি
ভালো না। শহরতলীর বাড়িগুলো থেকে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বের হয়ে ভয়ানক আকাশ
দেখে, দৌড় দিয়ে ঘরে যায়, আবার ফিরে এসে তাকিয়ে থাকে। ডাক পড়ে, মা বাবার
অথবা মামা খালার, ঘরে ফিরে যেতে। এমন দিনে যখন মানুষ মাছ খেতে শিখেনি, তখনও
গুহার ভেতর থেকে মানুষ আকাশ দেখেছে। এখন মানুষ মাছ নিয়ে গবেষণা করে।
কিভাবে মনোসেক্স তেলাপিয়া বাজারে মাছের ডালায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। কী কারেণে
মনোসেক্স এতো মোটা হয়, দক্ষিণ ভিটার ছেলেটা জাল বাঁধে আর ভাবে, দুত্তরি
শালার ড্রেইনে দিয়ে পুঁটি মাছ আসে না , আমি ভাবছি মনো সেক্স তেলাপিয়া।
উত্তর ঘরের ছেলাটা বলে, কিরে , এ যে দেখছি এক ঠ্যাং ভাঙা। একটা মুলি লাগে।
... আরে আমার জালডারে ইঁদুর কেটে দেখ কী করেছে। তাদের জাল ঠিকঠাক হতে হতে
‘বোরগা নুইজ্জা’ পুলের মুখে জাল পেতেছে। মুখ খারাপ হলে এখানকার মানুষ বলে
‘বোরগা’। নজির, নজু - রুপান্তর হতে হতে হয়েছে নুইজ্জা। বয়স্ক লোক। উত্তর
ওদক্ষিণ ভিটার দুজন জাল ঠিক করে নুইজ্জার দিকে তাকাতে তাকাতে ড্রেইনের
সামনে শেওড়া গাছ তলে আগে পিছে জাল পাতে। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পেছনের
জনের সিগারেট বৃষ্টিতে আধা ভিজা। ... কিরে সিগারেট আছে?.. আছে তবে অর্ধেক
ওদা। ... আরে আগুন লাগা, আগুন লাগালে ওদাবোদা জ্বলতে দেরি করবে না। ঠা-ায়
শইল কাঁপতাছে, হি হি হি, বুঝলি , মাছ না পাইলে এই কাঁপন আরও বাইরা
যাইবে।... মাছ আইবো কইত্থাইক্কা, পানি কেমন কালা হইতাছে দিন দিন দেখছস।
দুজনে জাল পাতে , হতাশার ভেতর জাল পেতে মনের ভেতরে আরও সামনে যায়।...
বৃষ্টি এসেছে গো, ওরা তখন ল্যাংটা, লাফিয়ে লাফিয়ে বাপের পেছনে আসে, বাপ
বলে, ঢুলা ধরে দাঁড়াইতে পারবি তো, দাঁড়া , পিছল জায়গা , আছাড় খেয়ে পড়লে মাছ
‘বগাস’ হইয়ে যাবে। ... বগাস কী বাবা? ... বগাস হলো মাছ ভাইগ্গা যাবে।
পুকুরের
পানি জমির পানি খালের পানি এক রকম। ফটফটে পানি। বিয়ে করা পুঁটি মাছ ঝাঁক
বেঁধে জালে আসে। একটা মাছ মাছিম ফকিরের নামে ছেড়ে দেয়। প্রথম মাছটি। এখন
মাছ কই ছাড়বে যে। কালো পানির পরিমান গত দৃইদিনেও কমেনি। একটু ফিকে হয়েছে
মাত্র।
বাঁশের খুঁটিতে ছাতা বেঁধে ঝুম বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে। মাথার
উপর বিস্তৃত হাওড়া গাছ। সব টিক আছে কিন্তু মাছ নেই। বোরগা মইজ্জার জাল
পুলের তিন মুখে। একটা না একটা ওঠে। তবে আগের মত নয়। ধরে আর ঢুলায় রাখে।
গজগজও করে। মনের মতো ওঠছে না। সামনের পেছনের দুজন ওদা সিগারেট টেনে গালের
চামরা ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে, আর বোরগা নুইজ্জার জালের দিকে আড় চোখে তাকায়।
দেখেতে দেখতে কখন সন্ধ্যা নামে। ডেঙু মশা দল বেঁধে জেট বিমানের মতো নেমে
আসে।
তখন সামনের জনের জালে একটা কিছু ওঠে। মাছ মনে করে হাত দিয়ে ধরে
দেখে নরম, মাথা নিচু করে দেখে হলুদ বস্তুটি থেকে নাক সরিয়ে না নিয়ে উপায়
নেই। সামনের জন জাল ওল্টে দিয়ে ঘিন ঘিন শরীেের দাঁড়িয়ে থাকে। সেই জাল থেকে
পেছনে দ্বিতীয় জনের জালে ওই একই বস্তু গিয়ে জমা হয়। দ্বিতীয় জনও জাল আলগি
দিয়ে জালের থলিতে হাত দেয়, তার গা ভার হয়ে যায়। নাক বন্ধ করে, সে জাল ফেলে
দিয়ে দুই তিন টক্করে পশ্চিম দিকের উঁচা ভূমিতে ওঠে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
পেছেনে এসে যোগ হয় সামনের জন। এবার তারা দেখবে নুইজ্জার জালে সেই বন্তু ওঠে
কি না।
তাদের জাল এমনি পড়ে ছিল দুদিন।
সেখান থেকে গোসল করতে নেমে
ডুব দিয়ে সামনের জন দেখে, লম্বা ড্রেনের দুপাশে প্লট হচ্ছে , প্লাট হচ্ছে,
কমদামী ক্রেতারা বস্তি বানাচ্ছে। আর হরহর করে বের হচ্ছে। সংকুচিত খালের উপর
সিটি কর্পোরেশনের ড্রেইন হচ্ছে। কালো পানির প্রতিযোগিতা। সে একটুকরা
কাপড়ের ভেতরে আটকে গেছে। কাপড়ে লেগে আছে হলুদ হলুদ নরম নরম বস্তু। নাম নিতে
কেমন লাগে । আবার জলের নিচের থেকে ওঠতে পারছে না। তবে সে ওঠে আসবে, এ
বিশ্বাস তাঁর আছে। তাঁর সামনের জন তাঁকে না পেয়ে পুকুরের পাড়ে ওঠে অপেক্ষা
করে। কিছুক্ষণ পর সে ভুস করে তিমি মাছের মত ভেসে ওঠে।
পাড়ে ওঠে দুজন লুঙ্গি খুলে গা মুছে। পুকুর পাড়ে কোন লোক নেই। আদিম দুজন মানুষ কোন কথা না বলে ভেজা লুঙি পিন্ধে বাড়িতে আসে।
দুজনের মা একই কথা বলে, কীরে মাছ কই জাল কই মাছ রাখার ডেকসি কই।
তারপর হতে তারা আর কোন দিন মাছ ধরতে যাইনি।
তাদের এলাকার ডেভোলফমেন্ট চলছে। জাইকার টাকায় বেশ শক্ত মজবুত ড্রেইন কালভার্ট হচ্ছে।
তারা
বাজারে যায়। গিয়ে তাদের একজন, মাছ বিক্রেতার ডালার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা
মনোসেক্স তেলাফিয়া মাছের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
বিয়ের মেহেদি করা পুঁটি মাছ দেখে মনে মেন বলে, চাষের মাছ
মগ্নদূতের আত্মমগ্নতামানিকরতন শর্মা ||
ওঠ না, কী হল
আগে তুমি ওঠ, আমি আরেকটু ঘুমাব
কোলবালিশটা বাম পাশ থেকে ডানপাশে নিয়ে চোখ বুঝে নেয় প্রশাখা।
বিছানা
থেকে নেমে বারান্দায় আসন করে বসে মগ্নদূত। যোগাসন করে বসে প্রায় বিশমিনিট
ভ্রামরী ও অনুলোম-বিলোম প্রাণায়ম করে। তারপর ব্রাশ নিয়ে সোজা বাথরুমে। স্নানশেষে রুমে এসে যতসামান্য চুলে চিরুনি লাগাতে লাগাতে বলে, নাস্তা কি
আছে?
ভাঙাঘুমের মাঝে বলছে, ফ্রিজে রুটি বানানো আছে, একটু ছেকে নিও।
ঘুমের
বেশি বেঘাত করলে প্রচ- রাগ করে প্রশাখা। তাই আর কোনো কথা বাড়ায় না সে।
দুটো রুটি ছেকে ঢেড়শভাজি দিয়ে খেয়ে নেয়। বের হওয়ার আগে প্রশাখার কানে কানে
বলে, এবার দরজাটা লাগাও। আমি অফিসে যাচ্ছি।
আলুথালুবেশে দরজাটা লাগাতে বিছানা থেকে নামে সে। এরি মাঝে ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে যায় মগ্নদূত।
স্বামী
যাবার পর আর ঘুমোতে যায় না প্রশাখা। কাটা ঘুম আর জোরা লাগে না। মগ্ন ঘরে
থাকলেই হল। ঘুমটা বেশ জমে ওঠে। চুল বাঁধতে গিয়ে একটু মুচকি হেসে ভেবে নেয়
সে। আজ একসপ্তাহ হল ছেলে তনু মামার বাড়িতে বেরাতে গেছে। স্কুল বন্ধ। অবারিত
লকডাউন। শ্বশুর-শাশুড়িও দেবরের বাড়িতে। ওরা ওখানে একমাস থাকবে। আগামি
মাসেই আবার এখানে চলে আসবে। বাসাটা একদম শূন্য। মগ্ন ও প্রশাখার দখলে এখন।
প্যান্ডামিকের কারণে স্কুলের লম্বা লকডাউন। ফলে প্রশাখার স্কুলও বন্ধ।
অফিসে
যাবার সময় প্রায়ই বলে, কাজ শেষে তাড়াতাড়ি চলে এসো। প্রশাখার রোজ এই কথাটা
মগ্নের কানে একদম গেঁথে গেছে। কিন্তু আজ আর বলেনি সে। হয়তো ঘুমের ঘোরে
থাকাতে ভুলে গেছে। না বললেও ঠিকই মনে দোল খায় তার কথা, ভাবে মগ্ন।
অফিসে যেতে কখনো অটোরিক্সা কখনো রিক্সায় যায়। বর্তমান অবস্থার কারণে গণপরিবহন এড়িয়ে চলে সে।
সিরিয়াস
পাঠক মগ্ন। হাতের নাগালে ভালো বই পেলে সেটা কিনে আনবেই। ধার করা ভালো বই
পড়তে তার পছন্দ নয়। কলেজ লাইফে এরকম বইপড়তো না সে। চাকরিতে ঢুকার পরই
নেশাটা চেপে বসে। তাই এখন তার বাসায় দুটো আলমারিতেই ঠাসা বই।
একদিন
সকালে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা নিয়ে একটা গাছের নিচে রিক্সার জন্য
অপেক্ষায়। বেশ সময় হল, কোনো রিক্সা খালি পায় না সে। মনে মনে একটু বিরক্ত।
অবশেষে একটা পাওয়া গেল। দাম হাকার আগেই চড়ে বসে সে। রিক্সাওয়ালার বয়স
ষাটোর্ধ হবে। প্রথমে মগ্নই কথা বললÑ
চাচার বাড়ি কোথায়?
দত্তখোলা বাবা,
এখানে কোথায় থাকেন?
মেড্ডা, তিতাসের পাড়
আপনার ছেলেমেয়ে কজন
দুইডা মেয়ে, কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে যায় সে।
কি হল ছেলে নাই আপনার?
বাবা থাইক্যাও নাই
কীরকম চাচা
বাতাসের
গতি বাড়ছে। আকাশে ঘনমেঘ। পশ্চিম আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রিক্সা ধীর গতিতে
চলছে। চাচার সাথে কথা একটু একটু করে গভীরে যাচ্ছে। কৌতূহল হচ্ছে মগ্নদূত।
হোন্যা কী লাব বাবা! আপনারা অইচেন শিক্কিত লোক। আচ্চা বাবা কন দেহি, আপনাগ বইয়ে কী স্বার্থপরের কথা লেহা আছে?
কথাটার
মাঝে একটা প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ রয়েছে তার। উত্তরটা কেবল হ্যাঁ না’র মাঝে নেই।
খুবই গভীর প্রশ্ন। ভাবে মগ্ন। অফিস আদালতে সংসারের আনাচেকানাচে সর্বস্থানে
তথাকথিত শিক্ষিতরাই প্রচ-ভাবে স্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ। কেউ কাউকে
এত্তোটুকু ছাড় দেয় না। তাহলে বড়বড় পাশটাশ দিয়ে কী লাভ! যদি স্বার্থটাই বড়
হয়ে যায়। মগ্নদূত আবার ফিরে আসেÑ
একটু খুল্যা কন দেহি
এত্তো দিন কই নাই বাবা, কেন জানি মনে কইতাছে আপনারে কথা কঅন যায়। আর আপনিও হোনতে চাইছেন। তয় হোনুন,
আমার
একক্যানমাত্র পোলা। অনেক কষ্টে হেরে পড়াইছি। মাইনসের বাইত মুনিবদিল্যা
দিছি। মাথার হাম পায়ে ফেইল্যা পোলাডারে পড়াইছি। পা চাপা রিক্সা চালাইয়া
পোলার পড়ার হরচ দিছি। স্যাররা কইচে, পোলার মাথাবালা। পড়াশোনা করলে মস্তবড়
অফিসার অইব। এহন হে হুব বড় অফিসার আইচে বাবা!
কেন আপনারে দেখে না; এই
কথাটা কণ্ঠে এসেও চেপে যায় মগ্ন। ভাবে যদি দেখতই তাহলে বাপ আজ আর রিক্সা
চালাত না। তাই প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে বলে-
আপনার সাথে তার কোনো যোগাযোগ নাই।
না
বাবা। হেরে আমরা হক্কলে ভুল্যা গেছি। যে বিদ্যা বাপ-মারে ভুলাইয়া দেয়, হে
বিদ্যার পোলা দিয়া কী লাভ! মানুষ বোলা বিদ্যার কপালে থু দেই।
চাচার বুকে
উথলে ওঠে ঘৃণা। সেই ঘৃণা ও তিরস্কারের বিষ বেরুচ্ছে দেখে মগ্ন ফিরে তাকায়
নিজের দিকে। তাহলে এ কেমন বিদ্যা অর্জন করেছি আমরা! সত্যিই তো, ঘরে ঘরে
আমরা কিসের বিদ্যা শিখাচ্ছি সন্তানদের। বয়সের ভারে থাকা মা-বাবার মুখটি
আচমকা ভেসে ওঠে তার ।
সাধ্যমত চেষ্টা করে মা-বাবার সেবা করার মগ্ন।
সম্পূর্ণরূপে যে পারে তা নয়। ছোটছোট দুটো রুম। একটায় প্রশাখাকে নিয়ে থাকে।
অন্যটাতে গাজাগাজি করে শোয় মা-বাবা, আর তনু। খাটে পাতাইরা শোয় ওরা। বাবা
বেশ লম্বা, তাই শোবার পর তার পা দুটো খাটের বাইরে ঝুলে থাকে। এই দেখে একটা
চেয়ার এনে দেয় মগ্ন। ছুটির দিনে কিংবা রাতে বাবাকে নিয়ে খেতে বসে সে। নিজ
হাতেই খাবার দেয়। দুর্বল। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে পড়া বাবাকে মনের চোখ দিয়ে
ক্ষণেক্ষণে দেখে। আর ভাবে এটা আমার বাবা নন, এই যেন আমি। আমি আজ আমার
বাবাকে দেখিনা, দেখি কেবল আমাকে। আমার ছেলে কী অন্তিমে এইভাবে আমার পাশে
থাকবে। মনে মনে বাবাকে বলেÑবাবা তুমি আশীর্বাদ করো; আমি যেন তোমার ছেলের মত
সন্তান পাই।
কেন চাচা, হে কি একদম আসে না?
না বাবা, ঢাকার একবড় স্যারের মাইয়ারে বিয়া কইরা হে...। থাক বাবা।
রিক্সার বেল দিতে দিতে পরক্ষণে আবার বলে-আচ্ছা বাবা, হক্কল নারীকি পুরুষ মাইনসেরে ভোলাতে পারে!
এবার
চাচার কথাটা টং করে মাথায় এসে বারি খায় মগ্নদূতের। মানবজাতির ইতিবৃত্তে
দেখেছে নারীরাই হরণকারী। পুরুষের মন আর পুরুষ ধরে রাখতে পারেনি। নারীর
ক্ষমতার কাছে পুনঃপুনঃ পরাজিত পুরুষকূল। কী দেবতা, কী ঈশ্বর, নারীর প্রেমের
কাছে নতজানু সকলে। তবে ঘোর কলিযুগে এসে এর রূপ বদলেছে পুরোটাই। এখন প্রায়
নারীতে প্রেমশূন্য। রাহুর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে তারা। কেউ শুদ্ধপ্রেমে ঘর
করে না। স্বার্থের গেঁড়াকলে আটকে আছে তারা। যেটুকু সংসার টিকে আছে, তা শুধু
কণা কণা প্রেমাভাসযুক্ত মায়ার কারণে। এর আবরনটা অত্যন্ত হালকা ও ঠুনকো।
ভুল
করছি বাবা, বড় ভুল। পোলারে বিদ্যার ঘাটে না দিয়া যদি আমার লগে
মুনিবদিল্যায় নিয়া যাইতাম তহন ভালা অইত। জানেন বাবা, হের কারণেই হের মাডা
কাইন্দা কাট্যা মইরা গেছে। বাবা, জীবনটা তো এক নিশ্বাসের। দম পালাইলে যে
আবার দম নিতে পারুম হের কোনো গেরান্টি নাই।
অনেক দিন তো অইল বাবা, এবার যাওনের পালা। আল্লারে কই, হে আল্লা আমার সব দুহকষ্ট আমারই থাক, তবে নেওনের আগে আমার গোনা মাপ কইরা দিও।
পার্থিব
জরা-ব্যাধির সংসারের প্রতি এক ধরনের মোহশূন্যতা তৈরি হয়েছে চাচার। বুঝতে
পারে মগ্ন। এই যে সাধের সংসার ইহা কেবলই মিছামায়ার জালে ঝুলে আছে। মুহূর্তে
প্রশাখার মুখ, তনুর মুখ, বাবা-মার কথা ভেসে ওঠে। তাহলে এই মোহমুগ্ধতা
কেবলই কী শূন্যতা, ভাবে মগ্নদূত।
বাবা আমার পোলাডারে মন থাইক্যা হমা কইরা দিছি। হে হের মত কইরা থাক, ভালা থাক। হেই দোয়াই করি।
একটা
ঘোরের মধ্যে রিক্সা থেকে নামে মগ্নদূত। ঠিক এমন সময় ঝড়ঝড়িয়ে এক পসলা
বৃষ্টি ঝরে পড়ল। অফিসের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে তার সন্তান তনুর শিশুমুখটার পাশে
বড় হওয়ার মুখটা ভেসে ওঠে। ভাবে বড় হতে হতে সকল তনু কী এভাবেই হারিয়ে যায়,
সিঁড়িতে দীর্ঘশ্বাসে হুঁচট খায় মগ্নদূত।
আবেদীন মাওলার
মৎস কথা
১
মাছ, তোমারও কি তৃষ্ণা জাগে ?
২
মাছ, তুমিও অস্থির লোভী
পরান কাঁপে বড়শি থেকে
পড়ে যাও যদি।
৩
মাছ, তোমার পর্দাহীন চোখ
লজ্জা নেই।
আমিও মাঝে মাঝে নির্লজ্জ হই
প্রেমে পড়ি যদি
৪
তুমি পানিতে আমি বাতাসে
সেইতো নিমজ্জিত আছি
হালে অক্সিজেন কমে গেছে
এ কথা বুঝে না আমার সাদা কুকুর টম
টম বুঝে না মরম। কুকুর তো।
৫
আচ্ছা সত্য করে কও তো মাছ
চ-িদাস যে বড়শি ফেলেছিলো
তোমারা তা মুখে নিয়ে টান দাওনি কেন?
বুঝেছি, তোমরাও রজকিনির রূপে...
বারো বছর উপোষ ছিলে।
৬
মাছ, তোমরাও আরাম প্রিয়
উষ্ণ আর শীতল স্রোতের
মজা নেয়ার অভ্যাসে
তোমরা ফকল্যা-ে যুদ্ধ লাগিয়েছিলে।
দরোজা খুলে দাওআরিফুল হাসান ||
হ্যালো, আমি ভেতরে যাবো
কেউ কি শুনতে পাচ্ছো,
কে আছো?
দরোজাটা খুলে দাও।
কবাট বন্ধ ঘরের
বাইরে বৃষ্টি অথবা খুব রোদ
ভিজছি আমি যাচ্ছি পুড়ে রোদে
আমার জন্য একটু মায়া নেই?
হ্যালো, তুমি শুনতে পাচ্ছো কি?
দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়ে আছি
মহাকালের পথিক
ক্লান্ত আমি, ভীষণ ক্লান্ত আজ
তুমি দরজা খুলো, দরজা খুলো
ভেঙে সকল লাজ
হ্যালো, তুমি শুনতে পাচ্ছো কি?
চাবি দিয়ে রাখবে কতো দূরে
আমি এসেছি আজ ফিরে
কতো পথের স্মৃতি, ধূলার গাঁথা
ঝোলার মধ্যে ধরি
আমি এসেছি আজ ফিরি
কতো পাখির কুজন, নদীর সোঁতা
সঙ্গে এনেছি
আমি আজ ফিরে এসেছি
হ্যালো, তুমি শুনতে পাচ্ছো কি?
দেখো আমার দুহাত ভরা ফুল
কাটাও আছে, আঘাত আছে
আছে বিষের হুল
দেখো আমার পূর্ণতা ও ভুল
কতো পাহাড় ডিঙিয়েছি
কতো মরুর পথে একা
কতো রাতের জ্যোৎস্না সাথে নিয়ে
দেখো আবার ফিরেই এসেছি
হ্যালো, তুমি শুনতে পাচ্ছো কি?
সারাদেহে মানিকরতন
অনেক ঘাঁ আর অনেক পচন
অনেক যুদ্ধ
অনেক শোকের ভার
বইতে আমি পারছি নাতো আর
ভেঙে পড়ছি হাঁটু গেড়ে
তোমার দরোজায়
শ্রান্ত অসহায়
দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না আর আমি
হ্যালো, তুমি শুনতে পাচ্ছো কি?
দরোজা খুলে দাও।
তোর অভিধানখলিলুর রাহমান শুভ্র ||
তোর হাসিটা কইলজা ধইরা টান মারে
তোর বাঁশিটা বদের হাড্ডি বিষ ছুঁড়ে
তোর চলাটা ঢেঁকিছাটা ঝরঝরে
তোর গলাটা মিষ্টি বিকেল আষাঢ়ে
তোর হাতটা শীর্ণনদী ঝিরঝিরে
তোর মুখটা চন্দ্র কমল মন জুড়ে
তোর চোখটা কীযে বলে কই কারে
তোর নাকটা হীরক বিন্দু ঘাম ছাড়ে
তোর নামটা ফ্রেমে বাঁধা অন্তরে
তোর মনটা রংধনু এক রং ঝরে
তোর ইটা ঘরের পৈঠা হাত নাড়ে
তোর মিঠা চোরাকাঁটা ঘুম কাড়ে
তোর সাঁটা জানালাটা চোখ পোড়ে
তোর মোটা কুকুর দু'টা আয় তেড়ে
তোর ছাঁটা রঙন গাছটা গান ধরে
তোর হাসিটা কইলজা ধইরা টান মারে
তোর বাঁশিটা বদের হাড্ডি বিষ ছুঁড়ে