ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
মেধাবী তরুণ কেন অসুস্থ পথে পা দেবে?
Published : Sunday, 22 August, 2021 at 12:00 AM
মমতাজ লতিফ ||
এবার, আবারও একদল বিজ্ঞান পড়া মেধাবী তরুণ গোষ্ঠীকে উগ্র জঙ্গী বোমাবাজ, ড্রোনের ধ্বংসাত্মক ব্যবহার করতে প্রচন্ড আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা গেল। এবারের জঙ্গী উত্থান জনগণকে বিস্মিত করে। কারণ-(১) ২০১৬ সালে এবং তার আগে থেকে যে মোল্লা গোষ্ঠীর উগ্র উস্কানির ফলে দেশে একদল তরুণ বিদেশী ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হত্যা করে বেহেশতে যাবার স্বপ্নে বিশ্বাসী হয়ে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগী সদস্য রাজীব হত্যা দিয়ে প্রগতিশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী কবি, সাহিত্যিক, লেখক, প্রকাশককে হত্যার সূচনা করেছিল, কট্টর সেই মোল্লারা আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষায় শিতি ছিল না। তারা বাংলাকে আফগান বানানো এবং নিজেরা তালেবান হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এদের অনেকে আফগানিস্তানে তালেবানের পে যুদ্ধ করেছিল। (২) বর্তমান সময়টিতে তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন ঘটেছে এবং বিজ্ঞান, মহাকাশ, সূর্য, গ্রহ, নত্র, গ্যালাক্সিসহ মহাকাশের অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। যে জ্ঞান অন্তত বিজ্ঞান পড়া, রসায়ন-পদার্থ বিজ্ঞান পড়া তরুণদের আরও বিজ্ঞানমনস্ক, মহাকাশ-জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী করে তুলবে, এমন ধারণাই ছিল জনগণের মনে। কিন্তু দেখা গেল, বিজ্ঞানের মেধাবী কিছু ছাত্র প্রযুক্তিবাহিত আধুনিক উচ্চ মতাসম্পন্ন বোমা তৈরি, ড্রোন তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, যা দিয়ে তারা স্বদেশের উন্নয়ন, শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস করে সেই প্রাচীন ধারণা-তালেবানী উগ্র ধর্ম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার রক্তে অর্জিত নিজেদের এই স্বদেশকে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী সরকারকে ধ্বংস করতে তাদের প্রযুক্তি জ্ঞানকে ব্যবহার করছে।
এই ফোরকান বা তার দ্বারা অনলাইনে আইইডি বানানোতে প্রশিতি প্রযুক্তি-দ তরুণদের প্রতি জিজ্ঞাসা- তোমরা কেন এত মেধাবী হয়েও ওই নিরর, ধর্মান্ধ, তালেবানপন্থী মোল্লাদের দ্বারা চালিত হচ্ছ? তারা তো নিজেদের পুত্রদের জঙ্গী বানাচ্ছে না। বরং তোমরা যারা অন্যের সন্তান, তাদের দেশদ্রোহী, হত্যাকারী, স্বদেশ-ধ্বংসকারী হিসেবে তৈরি করছে, যাদের শেষ গন্তব্-বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু অথবা আদালতে জেলখানায় ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য ফাঁসিতে মৃত্যুদ-! তোমরা কি ’৭১-এর বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী আলবদর হয়ে উঠবে? আলবদর ও পাকিপন্থী দেশদ্রোহী হওয়াই কি তোমাদের মেধা ও জ্ঞান তোমাদের নির্দেশ করেছে? এমন বর্বর, যুগের পে অনুপযোগী, প্রাচীনপন্থী হওয়া তোমাদের কি অর্জন করাবে? তোমরা কি কোন দেশে সুস্থ, শিতি মানুষকে ‘তালেবান’ বা নিরীহ অন্য ধর্মাবলম্বী এবং স্বদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বা কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের হত্যা করতে দেখেছ? তোমরা নিজেদের প্রশ্ন কর- মানুষকে সেবা দেয়া কি মানুষ হত্যার চাইতে অনেক উচ্চমানের কাজ নয়? (২) দ্বিতীয়ত, জনগণ বিস্ময় প্রকাশ করছে- বর্তমান এই সময়ে পুরো বিশ্ব, স্বদেশ যখন কোভিড-১৯ নামে এক অজানা নতুন জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত, যে রোগে লাখ লাখ নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী মারা যাচ্ছে, যাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য শত শত রসায়নবিদ, বিজ্ঞানী, ভাইরোলজিস্ট, ওষুধ ও টিকা উদ্ভাবনের, বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তোমরা তোমাদের রসায়ন বিজ্ঞানের জ্ঞানসহ প্রযুক্তি জ্ঞান নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল না হয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার অস্ত্র তৈরিতে নিযুক্ত থাকাকে কি বলবে? তোমরা কি দেখছ- আমাদের শত শত তরুণ ভলান্টিয়ার হয়ে করোনা রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য, মৃতকে কবর বা দাহ করার জন্য দিনরাত কাজ করে চলেছে বিনামূল্যে। অনেকেই কর্মহীন, আয়হীনদের খাদ্য সহায়তা করছে। অনেক তরুণ অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছে মুমূর্ষু রোগীদের কাছে বিনামূল্যে। একবার নিজেদের ধ্বংসাত্মক কাজ ও এই তরুণদের মানব সেবার কাজের তুলনা কর। বস্তুত এই তুলনা তোমাদের বোমা না বানিয়ে কর্মহীন, আয়হীন মানুষকে খাদ্য সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা দিতে অবশ্যই উদ্বুদ্ধ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ, শেষ পর্যন্ত তোমরা তো কোন না কোন নারী বা মায়ের সন্তান। মা, এই আমাদের মা পৃথিবীর মতোই সর্বংসহা। নিজে অভুক্ত থেকে সন্তানের মুখে যেখান থেকে পারেন, খাদ্য সংগ্রহ করে নিয়ে এসে তিনি তাঁর সন্তানের মুখে তুলে দিয়ে যে শান্তি ও আনন্দ পান, তা পুত্রদেরও বুঝতে হবে। তোমরা পুত্রেরা যদি নিরীহ মানুষ হত্যা করতে বোমা বানাও, বুকের দুধ পান করিয়ে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা সেই সন্তান একজন খুনী, হত্যাকারী হয়ে উঠলে এটি মাকে অপমান করা, ছোট করা, অসম্মানিত করার বড় একটি পথ। বাঁচিয়ে তোলা সন্তান গুন্ডা-বদমাশ-নারী ধর্ষক হলে যেমন মায়ের অপমান, তেমনি সে নিরীহ মানুষ হত্যায় মেতে ওঠা জঙ্গী-খুনী হয়ে উঠলেও মায়ের জন্য সমান অপমান। সমাজে জঙ্গীর মা, খুনীর মা, ধর্ষকের মায়ের অসম্মান কতখানি, তা উপলব্ধি কর।
ফোরকান এবং অন্য বোমা-ড্রোন তৈরিতে দতা অর্জনকারী তরুণদের বলব- আমরা চাই তোমরা এক একজন রসায়নবিদ বা বিজ্ঞানী বা আবিষ্কারক হয়ে ওঠো। তোমাদের পরিচয় হোক বিজ্ঞানী। তোমরা জেনেছ নিশ্চয়- ‘আমাদের দেশের তিনজন নারী বিজ্ঞানী বিশ্বের একশ’ নারী বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়ে আমাদের মুখোজ্জ্ব¡ল করেছে এবং আমাদের, বাঙালী জাতিকে করেছে গৌরবান্বিত। তারা এবং আমাদের শত শত তরুণ-তরুণী তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন ধরনের কৌশলকে ব্যবহার করে দেশের উন্নয়নের ল্েয অবিরাম কাজ করছে। যাদের অর্জিত বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক আয় দেশের এবং ওদের নিজেদের কাজে লাগছে। ওরা দেশের, জাতির সেবা করতে পেরে যে গৌরব অনুভব করছে, ভেবে দেখ, তোমরাও সেই একই রকম গৌরবের কাজ করে মানবতার কল্যাণে, জাতি ও দেশের কল্যাণে কাজ করে গৌরবান্বিত হতে পার। তোমরা জান, ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আবদুল কালাম একজন প্রখ্যাত মিসাইল নির্মাতা ছিলেন। তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানী এবং জাতি ও দেশসেবায় ব্রতী হতে বারবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর ফর্মুলায় তৈরি মিসাইল স্বদেশ শত্রুর হাতে আক্রান্ত হলে আত্মরার কাজে ব্যবহার করার জন্য তৈরি হয়েছিল, অকারণে মানুষ হত্যার জন্য নয়। আমাদের দেশের এ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট জামাল নজরুল ইসলাম, যিনি প্রথম মহাকাশে ব্ল্যাকহোলের অর্থাৎ কৃষ্ণ বিবরের অবস্থানের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। শুনে রাখ, ড. জামালই সর্বপ্রথম জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমাদের বিদেশের অর্থ সহায়তার প্রয়োজন নেই। বিদেশী সহায়তা বন্ধ হলে আমরা আত্মনির্ভর হতে পারব। আমাদের যথেষ্ট সম্পদ আছে। বিজ্ঞান মানুষকে যুক্তিবাদী করে বলেই বিজ্ঞানীরা কখনও অমানবিক হন না। হয়ে থাকেন খুবই মানবিক, মানুষের জন্য প্রকৃত কল্যাণকামী এবং বিশ্বের জন্য, পৃথিবীর জন্যও কল্যাণকামী, নিবেদিত।
বর্তমান পৃথিবীর জলবায়ুর উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর সব দেশ যেভাবে ধ্বংসের মুখে পড়েছে, যেখানে অতিবৃষ্টি, বন্যা, টর্নেডো, ঝড়, ভূমিধ্বস, স্থায়ী বন্যা এবং অতি উষ্ণতার ফলে দেশে দেশে বিশাল বিশাল বনাঞ্চলে দাবানলের আগ্রাসী প্রকোপ দেখা দিয়েছে, এসব সঙ্কটের মধ্যে পৃথিবীর এবং বাংলাদেশের তরুণরা পৃথিবী ও দেশ এবং দেশের দুর্গত মানুষের কল্যাণে সেবা দেয়ার কাজ করতে এগিয়ে আসবে, এটাই আশা করি। এ অবস্থার ভেতরে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের তরুণ দেশের সম্পদ ধ্বংস, দেশের মানুষকে হত্যার ল্েয বোমা, গ্রেনেড, অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত হতে পারে বলে একদম বিশ্বাস করি না। একটা কথা জেনে রাখ, সুস্থ ও মানব সেবার পথ কখনও কেউ বন্ধ করে দিতে পারে না। বন্ধ করে একমাত্র ব্যক্তি নিজে, নিজের কর্ম দ্বারা। মানুষ যে কোন দিন মন্দ পথ ত্যাগ করে ভাল ও সুস্থ পথে যাত্রা শুরু করতে পারে। এর জন্য কোন সময় নির্ধারিত নেই। এটি নির্ভর করে ব্যক্তির সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ওপর। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলমের নিজ অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বই- ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’, বইয়ে বর্ণিত গেরিলাদের অবিশ্বাস্য যুদ্ধ-কাহিনী পাঠ করে তোমরাও নতুন যুগের মুক্তিযোদ্ধা হবে। ঘৃণা করবে আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটির দেশবিরোধী কাজকর্মকে। ফোরকান, মেধা সবাই পায় না, তুমি, তোমরা কেউ কেউ পেয়েছ। সে মেধাকে অবশ্যই মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে শুরু কর। লাদেন, মোল্লা ওমর, বাগদাদী তোমাদের মডেল হতে পারে না কখনই।
লেখক : শিক্ষাবিদ