ড. শফিক আশরাফ ||
করোনাকাল
প্রায় দুই বছর পার হতে চলল। প্রায় দুই বছরের অধিক সময় ধরে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো নেই। আমাদের সন্তানরা
অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তারা তাদের দহন যন্ত্রণা, অভাব-অভিযোগের কথা কারো কাছে
ঠিকমতো প্রকাশও করতে পারছে না। করোনার আগেও আমার সন্তানের চোখে চশমা ছিল
না। এই করোনাকালে কখনো কাসের নামে, কখনো অ্যাসাইনমেন্টের জন্য তারা এখন
সারা দিন মোবাইল ফোননির্ভর। এখন তাদের চোখে ভারী চশমা। কিছুদিন আগে আমার
বিভাগের কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে আরো ভয়াবহ তথ্য পেলাম। প্রত্যন্ত
গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের একটা অংশ ভার্চুয়াল জুয়া
খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। একটু বিত্তশালী যারা তারা মা-বাবাকে চাপ দিয়ে
বিভিন্ন অসিলায় টাকা নিয়ে সারা দিন জুয়া খেলে, অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল
শিক্ষার্থীরাও অন্যের জমিতে কাজ করে, কখনো রিকশা-ভ্যান চালিয়ে টাকা উপার্জন
করে অনলাইনে জুয়া খেলে। মা-বাবারা হয়তো জানে তাদের ছেলে-মেয়েরা মোবাইল
ফোনে অনলাইনে কাস করছে, অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছে। তারা সত্যিই সেখানে কী
করছে, সেটা উঁকি মেরে দেখার প্রয়োজন বোধ করছে না! এগুলো ছাড়াও চোখ ব্যথা,
কাঁধ ব্যথা, মাথা ব্যথা, অতিরিক্ত স্থূলতা ইত্যাদি সমস্যা আমাদের
শিক্ষার্থীদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। আমার বিভাগের কোনো কোনো শিক্ষার্থী
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাকে বলেছে, করোনার আতঙ্ক থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে
দিতে বলেন, কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে আমরা এমনিতেও মারা যাব। কবে
আমাদের পড়াশোনা শেষ হবে, কবে আমরা চাকরি পাব, আমাদের অনেকের সরকারি চাকরির
বয়স শেষ হতে চলেছে, সেটা নিয়ে আতঙ্কে আমরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না।
আমাদের
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে
কোনো প থেকে তাঁর কাছে কোনো চাপ নেই।’ কথাটার মর্মার্থ আমার কাছে পরিষ্কার
না। শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ গ্রামে বাস করে। তাদের কান্না-হাহাকার সুদূর
ঢাকার শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। তাদের পিতা-মাতারাও
যেহেতু গ্রামের সাধারণ মানুষ, কাজেই তাদের গলার স্বরও অতটা উঁচু নয়। এখন
ঢাকা শহরের কিছু অভিজাত অভিভাবকের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ থাকতে
পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার ব্যাপারে তাদের অভিমতও থাকতে পারে,
কিন্তু মনে রাখতে হবে তারা অবশ্যই দেশের সব অভিভাবকের প্রতিনিধি নয়। করোনা
অবশ্যই একটা সমস্যা, আর এই সমস্যার মোকাবেলার জন্য সরকারের আন্তরিকতারও
কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দুই বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে করোনা
মোকাবেলার সিদ্ধান্তও যৌক্তিকতা হারিয়েছে। সেখানে কলকারখানা, দোকানপাট,
লঞ্চ-বাস-ট্রেন সবই খোলা রেখে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখাটা সঠিক
সিদ্ধান্ত নয়। যদিও এখন জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, অনলাইন কাস, ভার্চুয়াল পরীা
নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখে শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার
চেষ্টা চলছে। আমি কয়েকটি ব্যাচের কাস অনলাইনে নিয়েছি। সেই কাস নেওয়ার
অভিজ্ঞতা আমার খুব একটা ভালো নয়। প্রথম দিকে একটা কাসে ৭০-৮০ শতাংশ
শিক্ষার্থী অংশ নিত। মনে করা যেতে পারে, প্রথম দিকে শিক্ষার্থীদের কাছে কাস
করাটা ছিল ইউটিউব-ফেসবুকের মতো বিনোদন। খুব দ্রুতই শিক্ষার্থীরা কাসের
প্রতি মনোযোগ হারাতে থাকে। শেষ দিকে কাসে উপস্থিত হয় ২৫-৩০ শতাংশ
শিক্ষার্থী। এর মধ্যে আবার অনেক শিক্ষার্থী ডিভাইস অন রেখে, ভিডিও বন্ধ করে
অন্য কাজ করে। শিকের ডিভাইসে শো করে উপস্থিত ৩০ শতাংশ, ভিডিও অন করতে বললে
আবার অর্ধেককে পাওয়া যায় না! এখানে শিকের কাস ডেলিভারির দুর্বলতা বিষয়ে
প্রশ্ন উঠতে পারে, এর উত্তর হলো—বেশির ভাগ শিকের কাস নেওয়ার একই অভিজ্ঞতা।
অথচ এসব অনেক শিকের ফিজিক্যাল কাস তার শিক্ষার্থীরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে
শুনত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অনলাইন কাস কিছুটা আইওয়াশের মতো কাজ করছে। আমরা
বলছি চলছে তো, আসলে চলছে না। একটা অটো পাসের ঘোষণা শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত ফিসফাস করে, আমাদেরও অটো পাস দিয়ে দেওয়া হোক। করোনার
দুর্যোগে এই পড়াশোনাহীন অটো পাসের প্রজন্ম আমরা তৈরি করে চলেছি, এর শেষ
পরিণতি গোটা দেশ ও জাতির ওপর পড়বে। কারণ এই প্রজন্ম একসময় রাষ্ট্রের
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশ চালাবে।
তাহলে আমরা কী করব?
শিক্ষার্থীদের জীবনের রিস্ক নিয়ে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেব? এর
পরিষ্কার উত্তর হবে—হ্যাঁ, দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। রিস্ক
নিয়ে যদি কলকারখানা খোলা যায়, ট্রেন-বাস খোলা যায়, দোকানপাট খোলা যায়,
অফিস-আদালত খোলা যায়, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় কেন? বরং লঞ্চ-বাস,
দোকানপাটের চেয়েও অধিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব।
প্রয়োজনের একটা কাসের শিক্ষার্থীদের দুই ভাগে ভাগ করে, অর্থাৎ শিক্ষার্থীর
সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে এসে কাস চালানো যেতে পারে, পরীা নেওয়া যেতে
পারে। এ েেত্র সিলেবাসও কিছুটা কমানো যেতে পারে। অনলাইনে কাস/পরীার চেয়েও
সেটা অনেক বেশি কার্যকর হবে। আর করোনার ঝুঁকির কথা যদি বলি, সেটা
হলো—করোনায় মৃত্যুহার ২-৩ পার্সেন্ট, আর সেটা ঘরে বসেও শিক্ষার্থীরা
আক্রান্ত হতে পারে বা হচ্ছে। কারণ নানাবিধ প্রয়োজনে পরিবারের অন্য সদস্যদের
বাইরে যেতে হচ্ছে, বাইরে থেকে এসে তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিশছে।
সেই বিবেচনায় করোনার ঝুঁকি এখন ঘরে-বাইরে প্রায় সমান। আর শিক্ষার্থীরা
করোনা থেকে বাঁচলেও করোনার চেয়ে ভয়াবহ নেশাতে, অসুখে আক্রান্ত হয়ে
মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে, তারা তাদের দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে, মোবাইল ফোনে আসক্ত
হচ্ছে, জুয়ায় আসক্ত হচ্ছে। কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে কেন! শুধু
করোনা থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে
যে ফলের প্রত্যাশায় বসে আছি, তার চেয়েও ভয়াবহ বিষফল নিয়ে একটা প্রজন্ম তৈরি
হচ্ছে। শরীরের অসুখের চিকিৎসা সহজ, কিন্তু মনের অসুখের চিকিৎসা অনেকটা
দুঃসাধ্য। এই দুই বছরে আমাদের শিক্ষার্থীদের মনেও অসুখ বাসা বাঁধছে, তারা
হয়তো ধরেও নিচ্ছে এই পৃথিবী থেকে করোনা কোনো দিন যাবে না, আর তাদের পড়তেও
হবে না!
এই অসুখ আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে
দিন। দেশের যখন সামর্থ্য হবে তখন তারা টিকা পাবে, টিকার ভরসায় বসে থেকে
একটা প্রজন্মকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়ার আর কোনো মানেই হয় না।
শিক্ষার্থীরা চায় তাদের শিক্ষাজীবন ফিরে আসুক, অভিভাবকরাও চায় তাদের
সন্তানরা আবার পড়াশোনায় ফিরুক, আর শিকরা তো তীর্থের কাকের মতো
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অপোয় দিন গুনছে। কাজেই দেশের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে
দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন, সম্ভব হলে টিকা দিয়ে আর না হলে টিকা
ছাড়াই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর