ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রক্তাক্ত আগস্ট ও চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু
Published : Monday, 23 August, 2021 at 12:00 AM
রক্তাক্ত আগস্ট ও চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু....মেহেরুন্নেছা ||
সেদিন ঘরের পাশে রজনীগন্ধারা উন্মাতাল লয়ে গন্ধ বিলিয়ে দিয়েছিল। রক্তজবারা ফুটেছিল আরো রক্তাভ হয়ে। কানশিরা আর জিরাকাটার মতো বনফুলেরা তাদের রঙিন আভায় ভরে দিয়েছিল পুরো পৃথিবীকে। হয়তো সেদিন রাতের আকাশে ছিল রজত জোছনার বেহাল হাতছানি।
চাঁপার সৌরভ ছিল প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে। মহুয়ার গন্ধে বিভোর ছিল বনবাদাড়। কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরিতে নেমে এসেছিল কল্পলোকের পরীরা। টুঙ্গিপাড়ার উঠোনে কেবলি রবি ফসলের ঘ্রাণ। মধুমতি ও বাঘিয়ার বইছিল আপন প্রবাহে। আকাশ জুড়ে ছিল মেঘ আর রোদ্দুরের লুকোচুরি।
দিনটি ছিল ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ। উচ্ছ্বসিত আর উদ্বিগ্ন শেখ পরিবারের গৃহকোণ থেকে ভেসে এলো নবজাতকের কান্নার রোল। পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়ানো বাংলা জানলো এসেছে তাদের মুক্তিদূত। এমনি শুভণে বাবা লুৎফর রহমান আর মা সায়েরা খাতুনের কোল জুড়ে যে মুক্তির দূত এসেছিলেন সেই আমাদের খোকা যার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল এদেশের রক্তাক্ত ইতিহাস, এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
তারপর এক শ্রাবণের রাতে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল। হত্যা করলে আমাদের খোকা, আমাদের জাতির পিতা, আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের অবিসংবাদিত নেতা--- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি একের পর এক চক্রান্তের ফাঁদ পেতেই চলেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাষী কয়েকজন সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করেছে ওই চক্রান্তেরই বাস্তব রূপ দিতে। এরাই স্বাধীনতার সূতিকাগার বলে পরিচিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে হামলা চালায় গভীর রাতে।
সেইদিন বাংলার ভেজা বাতাস ডুকরে কেঁদেছিল। শ্রাবণের অশ্রুপাতের সঙ্গে আগস্টের রক্তঝরার মর্মান্তিক হত্যাকা- বাংলাদেশকে শোকে বিহবল করে তুলেছিল। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্র ও বিভৎষতায় ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ মুষড়ে পড়েছিল। মহাকালে কালিমা লেপন করে গেল বাংলার মাটির এই জঘণ্য হত্যাকা-।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকা-ের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্ব গাঁথার ইতিহাস মুছে ফেলতে।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকা- বাঙালি জাতির জন্য করুণ বিয়োগ গাঁথা হলেও ভয়ঙ্কর ওই হত্যাকা-ে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত না করে ষড়যন্ত্রকারীরা বরং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আড়াল করার অপচেষ্টা করেছে। এমনকি খুনিরা পুরস্কৃত হয়েছে নানাভাবে। হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' জারি করেছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাক সরকার। বাংলার ইতিহাসে আগস্ট এখন কেবলি রক্তঝরার ইতিহাস।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়ানক গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং অন্তত ৫০০ নেতাকর্মী আহত হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট মাত্র আধাঘণ্টার ব্যবধানে সারাদেশের ৬৩ জেলার ৩০০ টি স্থানে ৫০০ টিরও বেশি সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। বলার অপো রাখেনা যে, এই ভয়ানক ঘটনাগুলি মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ন্যাক্কারজনক বিষয় হল ১৫ আগস্টের পর 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' আবার কী জিনিস টাইপ প্রশ্নের উত্থাপন শুরু করল একটা গোষ্ঠী। এতে করে ঘাতকের সন্তানদের রাজত্বের তোড়ে শহীদদের সন্তানেরা মুখ লুকোতে বাধ্য হয়। একটা সময় বঙ্গবন্ধুকে আড়ালে রেখে ঘাতকদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়।
সেই যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বেঈমানী আজ অবধি তা চলছে। একটা প স্বাধীনতার ভুল ইতিহাস, ভুল বার্তা, বিতর্কিত ইতিহাস----এসকল হঠকারিতার আলোকে গোপন ষড়যন্ত্রের বিন্যাসে মত্ত হয়। বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন রকম ন্যাক্কারজনক ঘটনার।
এই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা,  তাকে আমরা কি বলবো! এটি আসলে একটা জাতির নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা,  নিজের শেকড়ের সঙ্গে লড়াই। বোধহীনতাকে সঙ্গী করে একটা জাতির নিজের সঙ্গে  পাপে লিপ্ত হওয়া।
তবে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় মতায় আসীন হলে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয় এবং নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিচার সম্পন্ন হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার যে কলঙ্ক জাতির কপালে কলঙ্ক তিলক হিসেবে ছিল---সেই কলঙ্কের কালিমা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করলেও সারাবিশ্ব আজ দেখছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই।

কবিগুরু বলেছেন,

                  হে মৃত্যু
তুমি জীবন হয়ে ফিরে এসো।

আমি মনে করি জাতির পিতার েেত্রও মৃত্যু জীবন হয়ে ফিরে এসেছে।  তিনি চিরঞ্জীব। কেননা তিনি একটি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি। তিনি সমগ্র জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষক-পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, বঙ্গবন্ধু এক মহান আদর্শের নাম।
তিনি হয়ে উঠেছেন সাধারণ থেকে অসাধারণ একজন। তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের এক মহান নেতা। আমি গর্ববোধ করি, যখন আমার চারপাশের কেউকেউ কাশ্মীর সংকটে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার অভাবের কথা বলেন। যে কাশ্মীরের ৪৭ সালেই স্বাধীন হওয়ার কথা, সেই কাশ্মীর এখনও তিন পরে টানাটানিতে ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ধুঁকছে।
সুতরাং বঙ্গবন্ধু চিরকালীন, বৈশ্বিক। তিনি শুধু আওয়ামী লীগের নন, শুধু বাংলাদেশের নন, তিনি সারা বিশ্বের। অন্নদাশংকর রায় ঠিক এ কথাটি বলেছিলেন কবিতার ভাষায়,

"যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান....."

বঙ্গবন্ধুকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁদের বিশ্বাস বঙ্গবন্ধু যদি উন্নত বিশ্বে জন্ম নিতেন তাহলে তিনি হতেন সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা। বস্তুতঃ কৃষক-মজুরের সংগ্রামী জীবন বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতিতে উস্কে দিয়েছিল। ছাত্রজীবনেই তিনি মেহনতি কৃষক-মজুরের পে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। সেসময় মেহনতি মানুষকে জাগ্রত করার জন্য মুজিব হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা'য় এইসব বাংলার মাটিঘেঁষা মানুষের সুখ-দুঃখের বয়ান আমরা পাই।
তখনকার সময় দিনমজুর কৃষক একজেলা থেকে অন্যজেলায় যেত ধান কাটতে। মজুরি বাবদ যে ধান পত তা নৌকায় করে নিয়ে ফিরত। এদের বলা হতো দাওয়াল। পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার দাওয়ালদের ধানের নৌকা আটকাতে শুরু করলো। সরকারি ভান্ডারে ধান জমা না দিলে ধান ও নৌকা বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা এলো। শেখ মুজিব দাওয়ালদের পে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললেন। সভা-সমাবেশ করে কৃষক-মজুরদের পে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুললেন।
শাইখ সিরাজ তাঁর এক লেখায় ঠিক এভাবে বঙ্গবন্ধুর কথা তুলে ধরেছেন,"আমি গোপালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় চিত্র ধারণের কাজ করছি। ভরদুপুরে দেখি আবাদি েেতর কাজ শেষ করে ফিরছেন এক প্রবীণ কৃষক। খালি গা। পরণে লুঙ্গি। বললাম, বঙ্গবন্ধুর কোনো স্মৃতি মনে হলে বলার জন্য। নামাজের জন্য তাড়াহুড়ো ছিল তাঁর। অনুনয়-বিনয় করলাম। বললেন, একটি স্মৃতিকথা। পাকিস্তান আমল। ঋণের দায়ে জর্জরিত এক কৃষকের ঘরের চাল খুলে নিয়ে যাচ্ছিল সরকারের লোকজন। খবর পেয়ে শেখমুজিব ছুটে এলেন। শুনলেন কত টাকা। নিজের পকেট থেকে সেই ঋণ শোধ করে দিলেন। সরকারের পেটোয়া বাহিনী চলে যাচ্ছিল। তখন পেছন থেকে তিনি ডাক দিলেন। বললেন, 'টাকাতো শোধ হয়েছে, এবার যেসব নিয়ে যাচ্ছেন আর এলোমেলো করেছেন, সেগুলো ভদ্রলোকের মতো ঠিক করে দিয়ে যান।' এই স্মৃতি পুরনো মানুষের অনেকেরই জানা।"
এভাবেই মানুষের ভালোবাসা আর সমর্থনে তিনি হয়ে উঠেছেন জাতীয় নেতা। ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের আশা-আকাঙ্ার কেন্দ্রবিন্দু। ৫২-র ভাষা আন্দোলন তেকে ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এভাবেই বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রগুলোতে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালির কান্ডারি। ষাটের দশকের শেষদিকে মাটি ও মানুষের নেতা হিসেবে তিনি পেলেন 'বঙ্গবন্ধু' খেতাব। তিনি বলতেন, আমাদের সবার শেকড় কৃষিতে। ৭ই মার্চ, ১৯৭১, ঢাকা, রেসকোর্স ময়দানে যত মানুষের ভিড় তার মধ্যে বড় একটি অংশ ছিলেন কৃষক, মজুর, মেহনতি মানুষ। ২৬শে মার্চ শুরু হওয়া বাংলার রক্তরনাঙ্গনে ছিলেন এদেশের কৃষক,  শ্রমিক,  মেহনতি মানুষ।
স্বাধীন বাংলাদেশে সোনার বাংলা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু প্রথম যে পদপে গ্রহণ করেন তার সর্বাগ্রেও ছিলেন কৃষক। তিনি কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা চিন্তায় সমবায়কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মোটকথা কালের স্রোতধারায় বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এদেশের সাধারণের এক মহান নেতা। উল্লেখ্য, নবগঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের সাধারণ বাড়িটিতেই বাস করতেন। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অধিষ্ঠিত প্রবীণদের অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া পথের অভিযাত্রী হয়ে তারাই গড়বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, এটাই আজ জাতির দৃঢ় প্রত্যাশা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান,কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।