ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ
Published : Monday, 23 August, 2021 at 12:00 AM, Update: 23.08.2021 1:20:22 AM
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ




অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ
উপমহাদেশের বাম আদর্শিক রাজনীতির কিংবদন্তিতুল্য প্রবাদ পুরুষ
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদএডভোকেট গোলাম ফারুক ||
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ উপমহাদেশের বাম আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কিংবদন্তিতুল্য রাজনীতিবিদ। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে আইয়ুব খাঁন বিরোধী আন্দোলন হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যার ভূমিকা ছিল গৌরব দিপ্ত। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিব নগর প্রবাসী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন বর্ণিল সংগ্রামের এক সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমা। রাজনীতির এই মহানায়কের বিস্তৃত এ জীবনের সবটুকু আমাদের জানা নাই তবে যতটুকু জেনেছি এবং কাছে থেকে দেখেছি তাই আজ তুলে ধরার চেষ্টা করব।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় : অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এর জন্ম ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলার দেবিদ্বার থানার এলাহাবাদ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতার নাম আলহাজ¦ কেয়াম উদ্দিন ভূঞা ও মাতার নাম আফজারুন্নেছা। ভূঞা পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলেও তিনি কখনো নামের সাথে পরিবারিক টাইটেল ব্যবহার করেন নি।
ছাত্র জীবন : অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এর পিতা ছিলেন শিক্ষক। তাই তার পুত্র সন্তানদের শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গি ছিল প্রখর। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী নিজ গৃহে ও মসজিদ ভিত্তিক মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা সমাপ্ত করেন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন হোসেনতলা ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনষ্টিটিউট হতে। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট মডেল হাই স্কুল হতে। তখন এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এরপর তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি স্নাতক (সম্মান) এ ভর্তি হন। ¯œাতক শ্রেণির পরিচিতিমূলক কাশে শিক্ষক অর্থনীতি বিষয় এর গুরুত্ব ও কঠোরতা ব্যক্ত করে বলেছিলেন বিষয়ের উপর কঠোর নিমগ্নতায় মনোনিবেশ করলে ২য় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারবে। এই মেধাবী ছাত্র সেদিন শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলেন  ডযু ঘড়ঃ ঋওজঝঞ ঈখঅঝঝ. শিক্ষক উত্তর দিয়েছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ পর্যন্ত কেহ ঋওজঝঞ ঈখঅঝঝ পায়নি। মোজাফ্ফর সে দিন ঋওজঝঞ ঈখঅঝঝ পাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। অবশ্য তাদের স্নাতক সমাপনীতে এ  ঋওজঝঞ ঈখঅঝঝ কেহ পায়নি। মোজাফ্ফর আহমেদ ২হফ ঈখঅঝঝ ঋওজঝঞ হয়ে ছিলেন। তিনি একই বিশ^বিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে অর্থনীতিতে মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ইউনেস্কো স্কলারসিপে বিদেশ হতে অর্থনীতিতে ডিপ্লোমা ডিগ্রী ও লাভ করেছিলেন।
কর্ম জীবন : মোজাফ্ফর আহমদ এর ছাত্র জীবন শেষ হলে দেখতে পান ভারতবর্ষ তখন জড়িয়ে গেছে ২য় বিশ^যুদ্ধে। যুদ্ধকালীন সময়ে অর্থনীতি ভেঙ্গে পরেছে দারিদ্রতা তখন প্রখর জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকা এক কঠিন পরিস্থিতি। তাই পরিবারের পশে দাঁড়াতে হবে নেমে পড়লেন জীবনযুদ্ধে। পারি জমালেন কলিকাতায়, চাকুরী হয়ে গেল খাদ্য বিভাগে। কলিকাতায় যে কয়জন কুমিল্লার মুসলিম ছেলে ধর্মতলার এক মেছে থাকতেন, তারা হলেন ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন, কুমিল্লা জিলা স্কুলের শিক্ষক (পরবর্তী জীবনে) কুমিল্লা ঢুলিপাড়ার আব্দুল মজিদ ও নাঙ্গলকোট আব্দুল কাদের সাহেব। কলিকাতায় প্রত্যক্ষ করলেন যুদ্ধের ভয়বহতা খাদ্য সংকট তার সাথে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কোলকাতা থাকা হলো না। মোজাফ্ফর আহমদ ফিরে এলেন নিজ মাতৃভূমে। যুদ্ধ থেমে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হলে তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে যে শিক্ষা পেলেন, তা হল যুদ্ধ হলো হত্যার খেলা, যুদ্ধের আড়ালে কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল মেতে উঠে দুর্নীতিতে, আর থাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হলি খেলা। তরুণ মোজাফ্ফর কে ভাবিয়ে তুলে। আবার জীবন যুদ্ধে ও বেঁচে থাকতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন আমি অর্থনীতির ছাত্র আমি আমার নূতন দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আগামী প্রজন্মের অর্থনীতিবিদ তৈরি করে যাব। যারা আমার দেশকে আগামী দিনের সাম্রজ্যবাদীদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা থেকে মুক্ত করে দেশের মানুষের মুক্তি এনে দেবে। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর তিনি তার চাকরিস্থলে থেকে গেলে অনয়াসে বড় আমলা হতে পারতেন। না তিনি সে পথে পা বাড়ান নি। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করেন। শুরুতেই তিনি চট্টগামের একটি কলেজে অধ্যাপনায় যুক্ত হয়ে যান। চট্টগাম এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাকালে কুমিল্লা প্রখ্যাত মেধাবী আইনজীবী অধ্যাপক মফিজুল ইসলামের সুযোগ হয় অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সরাসরি ছাত্র হওয়ার। ১৯৭৯’র জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই দুই গুরু শিষ্যের সুযোগ হয়েছিল একই সাথে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার। বাজেট আলোচনায় দুই গুরু শিষ্য মাতিয়ে দিয়েছিলেন সেই দিনের সেই জাতীয় সংসদ। এর পর তিনি যোগদান করেন ঢাকা কলেজে। এই ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা কালে অধ্যক্ষ মহোদয়ের কন্যা আইভী রহমানের সাথে বিবাহ হয় বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমানের। এই বিবাহে মোজাফ্ফর আহমদ আইভী রহমানের উকিল  পিতা হয়ে বিবাহ সম্পন্ন করেছিলেন।
এরপর ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মত লোভনীয় চাকরি ছেড়ে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
রাজনৈতিক জীবন : অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছাত্রাবস্থায় তিনি একবার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ও গান্ধীর জনসভায় যোগদান করেছিলেন। সুভাষ চন্দ্র বসু ও গান্ধীর সেই সব জনসভার ভাষণ তাকে সে দিন ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সেই আকৃষ্টতা থেকে তিনি রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেই সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিষ্ট পার্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভাষা আন্দোলনের সম্পৃক্ততা ও অর্থনীতির ছাত্র হওয়ায় কারণে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সর্ব হারার রাজনীতি অপরিহার্য্য মনে করে তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে জড়িয়ে পড়েন। তাই রাজনৈতিক জীবনের কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের লোভনীয় অধ্যাপনার পদ ছেড়ে দিয়ে ১৯৫৪ সালে  জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুক্ত ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লার দেবিদ্বার হতে মুসলীম লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী মফিজউদ্দিন আহমদকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে তরুণ এই অধ্যাপক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি একটি বিরল ঘটনা। বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সরাসরি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ।
বামপন্থী আদর্শের অনুসারীরা ও জাতীয়তাবাদীরা এতদিন এক সাথেই কাজ করছিল। ১৯৪৮ সালে ২৩ জুন আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠিত হলে এর সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক হন জনাব ছামসুল হক। বামপন্থী অনুসারী যারা আওয়ামী মুসলিম লীগ এর মধ্য থেকে কাজ করছিলেন তারা কিছুতেই মুসলিম শব্দটি মেনে নিতে পারছিলেন না। যদিও মুসলিম শব্দটি কিছু দিনের মধ্যে বাদ পরে সংগঠনটি আওয়ামীলীগ নাম ধারন করে অসম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়।
অবশেষে ১৯৫৭ সালে ২৫ ও ২৬ জুলাই দুই দিনব্যাপি পুরান ঢাকার সদর ঘাটের “রূপ মহল” সিনেমা হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহত গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ক্রমে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী অসম্প্রদায়িক দল ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। “নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন” এ ব্যনারে আয়োজিত এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সর্বমোট ১২ শত সদস্য এ কর্মী সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা ভাষানী। তিনি নিখিল পাকিস্তান ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)’র সভাপতি হন। মাওলানা ভাষানী পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ এর ও সভাপতি হন।
১৯৫৪ সাল থেকে পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে চরম অস্থিরতা চলে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। এই সুযোগে ফিল্ড মার্শাল আইযুব খাঁন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে শাসন ক্ষমতায় বসেই বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল নেতার নামে হুলিয়া জারি করেন এর মধ্যে অন্যতম হলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। মোজাফ্ফর আহমদকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে দেয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেন। ১৯৬৬ সনে হুলিয়া প্রত্যাহার হলে মোজাফ্ফর আহমদ প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পান। মোজাফ্ফর আহমদের দীর্ঘ আট বৎসরকাল আত্মগোপনকালীন সময়ে তার সহধর্মিণী আমেনা আহমেদ একমাত্র শিশু কন্যা আইভিকে নিয়ে চরম দুর্যোগের মধ্যে দিনাতিপাত করেন।
১৯৬৭ সনে আর্ন্তজাতিক ভাবে সমাজতান্ত্রিক অনুসারীদের মাঝে চীনপন্থী ও রাশিয়ানপন্থীদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তএল। এই বিভক্তির বাতাস এ দেশেও পরিলক্ষিত হয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশের (চীনপন্থী) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হন মাওলানা ভাষানী এবং অন্য অংশ (মস্কো) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হন ওয়ালী খান। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দ আলতাফ হোসেন। ১৯৬৮ আইয়ুব খান ১৯৬৯ সনের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের রাউয়ালপিন্ডিতে এক গোল টেবিল বৈঠক ডাকেন। গোল টেবিল বৈঠক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে আইয়ুব খাঁন ২৪ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মো: ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন। এই গোল টেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি দলে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ অন্যতম সদস্য ছিলেন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসে ১৯৭০ এর নির্বাচনের ঘোষণা দেন। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ সেই নির্বাচনে দেবীদ্বার-চান্দিনা নির্বাচনী এলাকা হতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সারা পাকিস্তানে বিপুল ভোটে সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। স্বভাবতই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া টাল বাহানা শুরু করলে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ন্যাপ এর সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান ও সাধারণ সম্পাদক গাউস বখ্শ্ বেজেঞ্জো ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে সর্বাত্মক সমর্থনের ঘোষণা দেন। কেন্দ্রীয় ন্যাপ এর এই ভূমিকায় অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইয়াহিয়া খানের সাথে ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ ও বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ব্যার্থ হলে বাঙ্গালী জাতির কপালে নেমে আসে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ এর কালোরাত্রী।
২৫ শে মার্চের পরে শুরু হলো স্বাধীনতা সংগ্রাম, শুরু হলো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের পরে যে নেতার বলিষ্ট ভূমিকা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে ইনিই হলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি নিজ দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) কে সংগঠিত করেছেন। সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীকে সংগঠিত করেছেন। তাদের জন্য কুটনৈতিক সফলতা দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট হতে সশস্ত্র ট্রেনিং, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন অত্যন্ত সফল ভাবে। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সোভিয়েত রাশিয়া সহ সমাজতান্ত্রিক বিশ^কে আমাদের পক্ষে আনতে পেরেছিলেন। তিনি মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের একজন উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন সফল ভাবে।
আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনেক দ্বন্দ্ব সংঘাত নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয় কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে। কাস্ত্রো সেদিন বলেছিল আমি হিমালয় দেখিনি আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন আমার সশস্ত্র বিপ্লব ও এর পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞাতা থেকে তোমাকে বলছি তোমাকে মুক্তিযুদ্ধে যে সকল রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছে এবং অংশ গ্রহণ করেছে তাদের নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করবে। দেশ পরিচালনার জন্য আর কোনক্রমেই তুমি ভারতীয় পার্লামেন্টারি রাজনীতির পথে পা বাড়াবে না। মনে রাখবে যারা তোমার দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতা করেছে তারা সুযোগ পেলেই প্রতি বিপ্লব ঘটাবে তাই তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আমি ও আমার দেশে তাই করেছি।
১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারি স্বাধীন দেশে প্রথম পুলিশের গুলিতে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী নিহত হল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হলো। ছাত্র ইউনিয়ন এর এক হটকারী সিদ্ধান্ত পালনের ফলে সারাদেশে ছাত্রলীগ কর্মীরা ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি, এ ছাত্র ইউনিয়ন অফিস ভাংচুর করল।
এর পরই দেশে সাধারণ নির্বাচন উপস্থিত হলে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ দেবীদ্বার এ কুমিল্লা শহরে সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ সারা দেশে বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। ইতোমধ্যে দেশের রাজনীতিতে জাসদ এর জন্ম হলে ছাত্রলীগ দ্বিধা বিবক্ত হয়ে গেল। জাসদ উগ্রভাবে সরকারের বিরোধীতা শুরু করল। বাম প্রগতিশীলদের জন্য কঠিন সময় ১লা জানুয়ারির ঘটনার কারণে আওয়ামী লীগ এখন বিশ^াস এর দোলাচলে ন্যাপ পারছেনা পরিপূর্ণ বিরোধীদল হতে, তা হলে প্রতি বিপ্লবী শক্তি ও জাসদ মিলে সরকারের অবস্থা নড়বরে করে ফেলবে। আবার সরকাকে পূর্ণ সমর্থন ও জানানো যাচ্ছেনা। ইতেমধ্যে দুর্নীতি সার্বিক হয়ে উঠেছে। এই কঠিন অবস্থা বাম প্রগতীশীল “ঐক্য ও সংগ্রামের” নীতি কৌশল সাধারণ মানুষের নিকট বোধগম্য হয়নি। এর মধ্যে দেশে অরজাকতা বৃদ্ধি পায়। সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ দেখা দেয়। ¤্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের হস্ত প্রসারিত করে দেয়। ফল স্বরূপ ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট নেমে আসে জাতীয় জীবনের সর্বময় কালোযুগের অধ্যায়, স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারের হত্যাকা- পুরো জাতি স্তম্ভিত হয়ে যায়। স্বাধীনতার পক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের ন্যায় পাশাপাশি ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি ও কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়ে। দলের অস্তিত্ব বিলিন করে দিয়ে বাকশালে যোগদানের পর আবার দলকে পুনর্গঠিত করে স্বাভাবিক অবস্থায় দেশ ও দল ফিরে আসতে সময় লেগে গেল কয়েক বছর।
১৯৭৯ সনের নির্বাচনে ন্যাপ অংশ গ্রহণ করে এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদ সংসদ সদস্য হন। সংসদ এ বিরোধী দলের পক্ষে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮১ সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অধ্যাপক মোজফার আহম্মদ বাম গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন।
বাংলাদেশ রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান হত্যা সা¤্রাজ্যবাদীদেরই চক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জিয়াউর রহমান এর সম্পৃক্ততা, এ হত্যার মাধ্যমে মুছে ফেলার একটি প্রয়াস মাত্র। এরপর বিএনপি কিছু সময়কাল ক্ষমতায় থাকলেও জিয়া হত্যার ব্যাপারে টু শব্দটিও করেনি। আজও বিএনপি জিয়া হত্যা নিয়ে কথা বলে না।
এরপর স্বৈরাচার এরশাদ ও জিয়াউর রহমান এর ন্যায় স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে চলতে থাকে। শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করেন।
১৯৭৬ হতে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ন্যাপ আর ১৯৭২ এর অবস্থায় যেতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হলো এর মধ্যে ন্যাপ আর টোটাল বিরোধী দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
১৯৯০ সালে পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের সোভিয়েত মডেল বাধাগ্রস্ত হলে পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়। এর সাথে ন্যাপ এর রাজনীতিও বাধাগ্রস্ত হয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফ্ফর সেই সময় বিশ^ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে “ধর্ম কর্ম সহ সমাজতন্ত্রের” তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এতে করে বাম সমাজতান্ত্রিক শিবিরে আরো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক মোজাফ্ফর মালয়শিয়ার মাহতির মোহাম্মদ এর মতে হাটতে চেয়েছেন। কিন্তু এই তত্ত্ব নিয়ে তিনি এগোতে পারেন নি। তবে একথা অনস্বীকার্য্য তার নিকট বন্ধুরা এমন কি দলের বন্ধুরা তাকে ছেড়ে গেলেও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহম্মদ আদর্শচ্যুত হননি। এরশাদের পতন  এর পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা আরোহন এ অধ্যাপক মোজাফফর এবার ও টোটাল বিরোধী দল হতে পারেনি। কারণ ইতিমধ্যে ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জিয়া ও এরশাদের সময় যে উত্থান ঘটেছে এই সময়ে আওয়ামী লীগকে বিরোধীতা করে সাম্পাদায়িক শক্তির ছাতা তলে যাওয়া সঠিক ছিল না। ন্যাপ দল হিসেবে সঙ্কুচিত হলেও অধ্যাপক মোজাফ্ফর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিলেন মর্যদার আসনে। আবার আওয়ামীলীগ বর্তমান অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে যেমন সমর্থন দিয়েছে, তাদের দুর্নীতির ও সমালোচনা করেছে কঠোর ভাষায়।
বাংলাদেশে শাসক আওয়ামী লীগের অনেক টালবাহানা গরিমসি সত্বেও সুখী ও সমাজতান্ত্রিক বাংলদেশ গঠনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে সমর্থক যুগিয়েছেন অদ্যাবদি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভয়ানক ভাবে পাল্টে গেছে। আজ বহুধাবিভক্ত বামশক্তি দুর্বল অবস্থান নিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আগের বিশালতা ও শক্তি হারিয়ে অনেকটাই দুর্বল। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহম্মদ সাহেবের সাথে তরুণ রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তা ভাবনার জেনারেশন গ্যাপ বেড়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের কথা এই যে অগ্রসরমান রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় তিনি হালের বাম বলে কথিত অনেক দলের তরুণ নেতাদের চেয়ে বেশি তরুণ রয়ে গিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতির আন্তর্জাতিক ও উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে অনেক তরুণ নেতাদের চেয়ে তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এ দেশে বাম রাজনীতি গুরুত্ব অনুধাবন করে গেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির এই মহানায়ক ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট অনন্ত জীবনের যাত্রা পথে পা বাড়িছেন।
তিনি আমাদের ক্রান্তিকালের এক মহানায়ক। তাকে স্মৃতিভ্রমে বিস্মৃতির অন্ধকারের অতল তলে ঠেলে দেওয়া যাবে না। পঞ্চাশের দশকে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর জন্ম এবং সেই দলে মাওলানা ভাষাণীর শূন্যতা পূরণে মোজাফ্ফর আহমদ এর  অসাধারণ দক্ষতা, স্বাধীনতা যুদ্ধে মহান সোভিয়েতের সমর্থন আদায়ে তার কুটনৈতিক সাফল্য, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে তার অবিচল আস্থা ও নিষ্ঠা তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে “ধর্ম কর্মসহ সমাজতন্ত্রের” তত্ত্ব আজ গবেষণার দাবি রাখে।
আমাদের জানা মতে অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদকে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে অবস্থিত তার প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান এর আঙ্গিনায় তাকে সমাহিত করার কথা ছিল। যে লক্ষে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু ডাঃ আবদুল অদুদ কে সেখানে সমাহিত করে গেছেন। পরে কি কারণে রাজনীতির এই মহান ব্যক্তিকে তার নিজবাড়ীর আঙ্গিনায় সমাহিত করা হলো তা আমাদের জানা নাই।
অতি সাম্প্রতি তার মেধা মননশীলতা দিয়ে গড়া দল ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর হাল ধরেছেন তার সুযোগ্য কন্যা আইভী আহমেদ। মেধাবী তার এই কন্যাকে শিশুকাল থেকে খুব কাছে থেকে দেখে আসছি। আমাদের মতে আইভীর রাজনীতিতে আগমন বড় বিলম্বে হলো। তার পর ও তার নেত্বত্বের প্রতি আমরা আশাবাদি।
তবে আইভী তার জীবনের কঠিন সময়ে সরাসরি রাজনীতিতে পা বাড়ালো। যখন সে সদ্য পিতৃহারা। শ্রদ্ধেয়া মাতা যখন বার্ধক্যজনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ। তার পরম শ্রদ্ধেয়া মাতা সম্পর্কে দুটি কথা বলতে চাই। তখন আইয়ুবের আমল পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর আজম খান। স্বামীর হুলিয়া তুলে নেয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশু কন্যা আইভীকে সহ দেখা করে ছিলেন আজম খানের সাথে। সেদিন আজম খান তার মাথায় হাত রেখে বলে ছিলেন গধু এড়ফ নষবংং ুড়ঁ  এই সান্ত¦না নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। এই মহিয়সী নারী সর্ম্পকে আজ কবির ভাষায় বলতে হয়
“কোন দিন ও একা জয়ী হয়নিকো পুরুষের তরবারী
সাহস যুগিয়েছে, প্রেরণা যুগিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী”
বিবাহিত জীবনে স্বামীর চরম দুর্দিনে এই বিজয় লক্ষী নারী একাধারে পিতা ও মাতা হয়ে শিশু কন্যাকে আগলে রেখে জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসের একটি ঘটনা- আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জেলে চলে গেলে পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তার সহধর্মিণী আফিয়া খাতুন সে দিন দেশ ত্যাগ করেছিলেন। আর কোন দিন সামছুল হক সাহেবের নিকট ফিরে আসেন নি। এই সংবাদে “টাঙ্গাইল বীর” সামছুল হক সাহেব অপ্রকৃতস্থ হয়ে যান এবং এ অবস্থাতেই নেতা কর্মীদের দাড়ে দাড়ে ঘুরে মৃত্যুবরণ করেন।
আমেনা আহমেদ এরূপ অনেক সুযোগ সুবিধার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সেনা সরকারের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে স্বামী অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহাম্মদের সাথে থেকেছেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
আর একটি কথা ন্যাপ বহুধা বিভক্ত হয়েছে তাই ন্যাপ ঐক্যবদ্ধ হওয়া আজ যুগের দাবি। এক্ষেত্রে ঐক্যের ডাক আসতে পারে মূল সংগঠন ন্যাপ এর মধ্য হতে। বিভক্ত হয়ে যাওয়া অংশ থেকে নয়, তবেই ন্যাপ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে ধরা যাক ভারতের কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ হবে। তা হলে সে ঐক্যের ডাক কে দিবে? মূল কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী না তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? নিশ্চই রাহুল গান্ধী।
তবে শেষ কথা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ এক অনন্য ইতিহাস। এই বিনষ্ট রাজনীতির যুগে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সততা ও ন্যায় বোধের এক ইতহাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি শুধু দেশের নয়, পৃথিবী নামক গ্রহে তার একখ- জমির ও কোন মালিকানা নেই। দেশি ও বিদেশি কোন ব্যাঙ্কে তার কোন ব্যাংক হিসাব নেই।
তিনি ব্রহ্মচারীর মত জীবনধারণ করেছেন দিনহীন ভাবে, আর হয়ত জীবনের শেষ দিনে তার পরিবারের নিকট তারই ব্যক্ত করা মতে তাকে নিজ পৈত্রিক ঠিকানায় সামহিত করেছেন। অন্য স্থানে সমাহিত হলে হয়ত মৃত্যুর পর ভূমি ঋণ থেকে যেত। তাই তিনি তার পরিবার ও শুভানুধ্যায়ী ও অনুসারীদের কে সেই ভূমি ঋণ থেকে দায় মুক্তি দিয়ে গেছেন। নিজ পৈত্রিক ভিটায় সমাহিত হলেন দিনহীন ভাবে।
এই ভিটিতে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজম্মা শিশু জীবনের গোধূলী লগ্নে ধূলিমাখা দেহে বাড়ি ফিরলেন।
এডভোকেট গোলাম ফারুক
লেখক ও গবেষক


একনজরে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদগ্রন্থনা:মোহাম্মদ আলী ফারুক ||
উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টাম-লীর মধ্যে বেঁচে থাকা সর্বশেষ সদস্য ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-মোজাফফর) প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। তার স্ত্রী আমিনা আহমদ বর্তমানে ন্যাপের সভাপতিম-লীর সদস্য এবং বাংলাদেশ নারী সমিতিতে সভানেত্রী হিসেবে আছেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুতে জন্মস্থান কুমিল্লার দেবিদ্বারসহ দেশের সর্বত্র নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। কুমিল্লা টাউন হল মাঠে ও দেবীদ্বারের এলাহাবাদে জানাজা শেষে তাঁকে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।
মোজাফফর আহমদের জন্ম ও শিাজীবন
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আলহাজ্ব কেয়াম উদ্দিন ভূইয়া, মায়ের নাম আফজারুন্নেছা। বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক। মোজাফফর আহমদ স্থানীয় হোসেনতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক, জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশন ও দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা করেন।
পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং ইউনেস্কো থেকে ডিপ্লোমা লাভ করেন।
কর্মজীবন ও রাজনীতিতে যোগদান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র মোজাফফর দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিকতা করেন। সর্বশেষ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। তার রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত বর্ণিল।
রাজনীতি অঙ্গনে তার শুভসূচনা হয় ১৯৩৭ সালের দিকে। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের (শেরে বাংলা-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী) প্রার্থী হিসেবে নিজের এলাকা কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে প্রভাবশালী মুসলিম লীগ প্রার্থী ও তদানীন্তন শিামন্ত্রী মফিজউদ্দিনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেন।
আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ’র প্রতিনিধি নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে ১৯৫৮ সালের দিকে। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়। আত্মগোপন থাকা অব¯'ায় তিনি আইয়ুব সরকার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেন। দীর্ঘ আট বছরব্যাপী আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কারাবরণও করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকার ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং সেই ৬ জনের মাঝে তিনিই এ যাবৎ একমাত্র জীবিত উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের ল্েয বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেন। সে সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নিজস্ব উনিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনে অধ্যাপক আহমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
স্বাধীন বাংলার রাজনীতিতে পদচারণ
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লার দেবিদ্বার আসন থেকে কুঁড়েঘর প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে তিনি কারারুদ্ধ হন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, দণি ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের নানান দেশে সফর করেন।
সরকার ২০১৫ সালে অন্যদের সঙ্গে তাকেও স্বাধীনতা পদক দেয়ার ঘোষণা দিলে তিনি সবিনয়ে তা নিতে অস্বীকার করেন। তার মতে ‘রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। পদ বা পদবির জন্য কখনো রাজনীতি করিনি। পদক দিলে বা নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই।’


‘কুঁড়েঘরের’মোজাফফর আহমদ
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদসোহরাব হাসান ।।
গেল শতকের চল্লিশের দশকে যখন বেশির ভাগ বাঙালি মুসলমান মুসলিম লীগ বা পাকিস্তানবাদে সমর্পিত ছিলেন, তখন যে গুটিকয়েক তরুণ বামপন্থার রাজনীতিতে দীা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মোজাফফর আহমদ অন্যতম, তিনি অনুসারীদের কাছে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং সাধারণ মানুষের কাছে কুঁড়েঘরের মোজাফফর নামে পরিচিত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মোজাফফর আহমদ প্রথমে কলেজে এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিকতা করেন। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তাঁর জীবনধারা অনেকটা বদলে দেয়। ইতিমধ্যে নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটেছে। তিনি আজিমপুরে যে বাসায় থাকতেন, সেখানে তাঁরা নিয়মিত বৈঠক করতেন। ১৯৫৪ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মোজাফফর আহমদ পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন। ওই পরিষদে তিনি স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব এনেছিলেন, যা তখন মতাসীনদের সমর্থন পায়নি। তখন মোজাফফর আহমদ আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) কেন্দ্রীয় নেতা।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলে মোজাফফর আহমদের ওপর হুলিয়া জারি করা হয়। এরপর তিনি আট বছর আত্মগোপনে থেকে রাজনীতি করেন। ১৯৬৬ সালে সরকার হুলিয়া তুলে নিলে মোজাফফর প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান। তখনো ন্যাপ ঐক্যবদ্ধ এবং সাংগঠনিকভাবে শক্ত অবস্থানে। ষাটের দশকে যে ব্যাপক সংখ্যায় মেধাবী তরুণ বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হন, তাতে ন্যাপের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৬৭ সালে দলটি মতাদর্শগত কারণে বিভক্ত হলে মোজাফফর আহমদ পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের (মস্কোপন্থী) সভাপতি হয়েছিলেন। পাকিস্তানভিত্তিক ন্যাপের সভাপতি হন আবদুল ওয়ালি খান।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে মস্কোপন্থী অংশ সমর্থন দেয়। অন্যদিকে ভাসানীর নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী গ্রুপ ছয় দফার বিরোধিতা করে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রোপটে রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খান আহূত গোলটেবিল বৈঠকে যে ন্যাপ নেতা জোরালোভাবে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ছয় দফাভিত্তিক শাসনতান্ত্রিক সমাধানের প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন, তিনি মোজাফফর আহমদ।
ষাটের দশকে মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছে, তা হলো তাদের বাম চিন্তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার সংশ্লেষণ। এর প্রভাব তৎকালীন আওয়ামী লীগেও পড়েছিল। উনসত্তরে আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্রে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা যুক্ত করে। অন্যদিকে চীনপন্থী বামেরা জাতীয়তাবাদী আকাক্সক্ষা উপো করলে জনগণ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদের একাংশ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধিতা করে।
মুক্তিযুদ্ধে মোজাফফর আহমদ মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনী গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন, মুক্তিযুদ্ধের পে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়েও সচেষ্ট ছিলেন। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে মোজাফফর আহমদ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হ�