সৈয়দ আহমাদ তারেক মুক্তিযুদ্ধের সেই কিশোর কবিপ্রবীর বিকাশ সরকার ||
এই
জীবনে যা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় তা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসে বাঙালি
স্বাধীনতার জন্য বহুবার যুদ্ধ করেছে কিন্তু ১৯৭১ সালেরটি ছিল শেষ যুদ্ধ।
প্রচুর, প্রচÐ রক্তক্ষয়ী ভয়াল এক যুদ্ধ। সেই ভয়ঙ্কর জীবন সঙ্কটের মধ্যে
জন্ম নিয়েছে অনেক স্মৃতি। ৫০ বছর আগের কথা। দিনরাত গুলির শব্দ, বুটের শব্দ,
মর্টারের শব্দ, কামানের দুম দম আওয়াজ আজও ঘুমের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে।
সেই
একাত্তরের রক্তঝরা, তুমুল যুদ্ধের কুমিল্লা শহরে এক কিশোর কবির জন্ম
হয়েছিল। শুধু কবি বললে ভুল হবে, অঙ্কন শিল্পীও বটেন! স্বহস্তে লেখা কবিতার
একটি গ্রন্থ তৈরি করেছেন নিজেই যার কোনো দ্বিতীয় কপি নেই কোথাও!
হস্তনির্মিত স্বতন্ত্র তার সেই কাব্যগ্রন্থটি আমাকে মুক্তিযুদ্ধের এবং
পরবর্তী উন্মাতাল দিনগুলোতে নিয়ে যায় বারবার।
সাধারণ গ্রন্থের চেয়ে
কিছুটা লম্বাকৃতির কিন্তু সর্বত্র রুচি ও আধুনিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। সবচেয়ে
বড় বিষয় হচ্ছে, কবি কিশোর হলেও মননে, অনুভবে এবং শারীরিক চেতনায়
সম্পূর্ণভাবে সাবালক। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই কবিতাগুলো রচিত। তিনি যে তখনই
সাবালক মাত্র ১৭ বছর বয়সে গ্রন্থের নামকরণেই এর প্রমাণ বহন করে ‘জ্যোৎস্নার
দুপুরে হারমোনিআম’, সৈয়দ আহমাদ তারেক।
মাত্র
১৭ বছর বয়সে সাবালক কবিতা রচনা, অভিনব আঙ্গিকের হস্তলিখিত গ্রন্থ
প্রকাশ---আবার তাতে চমৎকার সব অলঙ্করণ রীতিমতো সব্যসাচী না হলে সম্ভব নয়।
প্রচ্ছদের ডিজাইনও আধুনিক, কেননা হরিণ নিয়ে ক্রীড়ারত নায়িকার প্রতিচ্ছবি
তিনি দৃশ্যমান করেননি ইমেজ হিসেবে রেখে দিয়েছেন। বা বলা যায় পাঠকের ভাবনার
ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তার প্রেয়সীর ছবিটি। অর্থাৎ পাঠককে একটা ধোঁয়াশার মধ্যে
রেখে দেয়া। বস্তুত এটা যে শুধু আধুনিকতা তাই নয়, ভাষালিপিতে অস্পষ্ট, গুহ্য
অর্থকে আবিষ্কার করার সুযোগ করে দেয়াই আধুনিক কবির কাজ। কেননা কবিরা
হচ্ছেন দার্শনিক বা জ্ঞানী। পাঠককে তার অর্ধেক হতে হবে না হলে কবির সঙ্গে
একাত্ম হতে পারবেন না, খুঁজে পাবেন না কবিতার অর্থ। সুতরাং এখানে পাঠককে
চিন্তা-ভাবনা বিনিয়োগ করতে হবে। বস্তুত কবি ও পাঠক এই শর্তাধীনে বাঁধা।
মাত্র
২১ পৃষ্ঠার ছিপছিপে গ্রন্থটি সূচিপত্র ও পৃষ্ঠা নম্বরহীন। ছোট-বড় মিলিয়ে
সর্বমোট কবিতা ১১টি। কিন্তু আমার কাছে গ্রন্থের প্রিন্টার্স লাইনটিই একটি
কবিতা বলে মনে হয়েছে: স্বলিখিত প্রকাশনা / অবকাশ, ২২ জিন্নাহ্ এভিনিউ,
ঝাউতলা, কুমিল্লা / প্রেরণা ও প্রকাশনা: রওনক হক / প্রচ্ছদ পরিকল্পনা,
আঙ্গিক নির্দেশনা ও মুদ্রণ: সৈয়াতা / বিনিময়: চাহিবামাত্র ফেরত দিতে বাধ্য
থাকিবেন / প্রথম প্রকাশ: হলুদ তৃণের মতো এক সকালে, শিশিরের ঘ্রাণে। পাঠক
পড়ুন এবং দেখুন কবিতার উপকরণ এখানে স্পষ্টতই পরিলক্ষিত।
প্রেরণাদাতা
গ্রন্থের প্রকাশক রওনক হককেই উৎসর্গ করছেন গ্রন্থটি যেটা অপ্রচলিত হলেও
উৎসর্গপত্রে বিখ্যাত কবি ওমর আলীর জনপ্রিয় একটি কবিতার লাইন ‘এদেশের শ্যামল
রং রমণীর সুনাম শুনেছি’ পঙক্তিটি দিয়ে। কত আধুনিক এই কিশোর কবি! কবিতার
পাতায় যাওয়ার আগে রয়েছে ‘জ্যোৎস্নার দুপুরে হারমোনিআম’ শিরোনামে কবির
স্বাক্ষর নির্দেশিত একটি কাব্যিক-বার্তা:
তোমার আঙুল নেচে যায়
আইসক্রিমের মতো নরোম শরীরে নেচে যায়
রীডের উপর শব্দের বিলাসিতা নিয়ে অথবা তোমার
মতো একটি হার্মোনিআম বেঁচে আছে জ্যোৎস্নার দুপুরে।
বস্তুত নারীর রূপক এই হার্মোনিআম ছুঁয়ে দেখার প্রবল টান টান বাসনার কাব্যিক রূপ সতেরো বয়সে হয়তো বা মাত্রাতিরিক্ত কিন্তু শৈল্পিক।
কবিতাগুলো
হচ্ছে: আমরা ঝলোময় জ্যোৎস্নায়, সুখময় শব্দের ফুল, নিহত করুণা, বিকল্প
অনুধ্যান, বিপরীত রাতে ক্রংকীটে, রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা: আগুন আর বরফ
(স্বঅনূদিত), ঈশ্বর আমায় বিরক্ত করে, আমি সেখানেই, আমার চেনা ভদ্রলোক, আমার
নিবাস, পাঠক শুনুন--(জনাবা রওনক হক শুভেচ্ছাস্পদেষু)। বলা বাহুল্য,
কবিতাগুলোর বাক্য রচনা আলুলায়িত তবে উদ্দেশ্য, বাসনায় কাঁচা মনের কোনো
প্রশ্রয় নেই, বরং রয়েছে সতেরো বছর বয়সী আবেগ, তীব্র প্রেমরাগ, শারীরিক
উত্তাপ এবং জীবনানন্দীয় বিষাদের প্রাবল্য যেমন মাত্র তিন লাইনের ‘নিহত
করুণা’ কবিতাটি: প্রথম বাতাসের রাগ সমুদ্রকে / করুণা করে না / যেমন আমায়
করে না করুণা যুগের নিষ্ঠুরতা।
না, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো কবিতা
গ্রন্থে নেই! থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু স্বভাবতই কবিরা যুদ্ধকে ঘৃণা করে
থাকেন। হয়তো সৈয়দ আহমাদ তারেক সেরকম কবি। এর জন্য আমার কোনো অভিযোগ নেই।
বরং অভিযোগটি এখানেই---প্রতিভা থাকা সত্তে¡ও প্রভূত সম্ভাবনাময় সৈআতা
জীবনটাকে ছিন্নভিন্ন খÐখÐ করে ছেড়েছেন নিজেই। যুদ্ধ পরবর্তী অসময়, অভাব,
অনাচার, সন্ত্রাস সর্বোপরি সামাজিক ও রাজনৈতিক স্খলন তাকে পায়নি সত্যি
কিন্তু সৃষ্টিশীলতায় ও তারুণ্যে তিনি ছিলেন তরুণদের গুরুস্থানীয়--শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের তুমুল জনপ্রিয় ‘পা-মাথা টলোমল’ জীবনধারার অনুসারী। ঘরছাড়া,
বোহেমিয়ান। কবিতা লেখা, অঙ্কনচর্চার পাশাপাশি চলছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়
অদলবদলের খেয়ালিপনা। একবার ইংরেজি, আরেকবার চারুকলা। পরে কোনোটাই হলো না।
অথচ তিরিশের পূর্বেই সমস্ত মাথা ছেয়ে গেল শ্বেতকেশে! ঢাকা, চট্টগ্রামের
পত্রিকা অফিসে রাতদিনকার আড্ডাবাজ, নেশাগ্রস্ত বোহেমিয়ান--উড়নচÐি তারেকের
সন্ধান পাওয়া যেতো গভীর রাতে শুড়িখানা ছেড়ে আসা টালমাটাল অবস্থায় রাজপথে,
গলির মোড়ে। কখনো কখনো রাগান্বিত হয়ে ছুঁড়ে মারতেন কালো মোটা ভারী চশমাটি,
কখনোবা নেইলকাটারের ছুড়ি বাড়িয়ে ধরেছেন আড্ডার মধ্যে কাউকে। টাকার দরকার তো
ছুটে গেছেন আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ কালাম মজুমদারের কাছে।
ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম এই তিন শহরে পরিণত হয়েছিলেন কিংবদন্তিতে। এমন
শব্দবর্ষী, অনলউষ্ণ এবং প্রগাঢ় প্রেমাবেগের তরুণ তখন সারা বাংলাদেশে আর কেউ
ছিল বলে আমাদের জানা নেই।
স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামে কতিপয় তরুণ কবি,
লেখক ও সাংবাদিকের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল তুখোড় একটি সংগঠন ‘স্পার্ক জেনারেশন’
সেখানে সৈয়াতা ছিলেন মধ্যমণি। কুমিল্লার একাধিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও
নাট্যমঞ্চ কাঁপিয়ে তুলেছিলেন, ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন
‘আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী’র অন্যতম সংগঠক।
মোরগ ফুলের মতোই টকটকে লাল
দিনকাল কেটেছে তার। সকালে যদিবা কাজ করে এসেছেন সাপ্তাহিক ‘সন্ধানী’তে রাতে
কুমিল্লায় এসে হাজির। স্থির ছিলেন না কোথাও। কুমিল্লারই এক আত্ম-হন্তারক
তরুণ কবি ফজল মাহমুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন ‘তাহমিনা বিষয়ক
জটিলতা’। নিজের অগ্রজকে নিয়ে তীব্র ব্যাঙ্গাত্মক গল্প ‘চুইংগাম’ যেমন
লিখেছেন তেমনি কোমল প্রেমের গল্প ‘জয়ন্তীকে বোধয় ভালোবাসি’র মতো গল্প।
অস্বচ্ছ অনিশ্চয়তা বহুবছর তাকে রেখেছিল গৃহ ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে।
কিন্তু
প্রাণীর বয়স তোলা এক নির্মম সত্য। অপ্রতিরোধ্য। তাকে আলাদা রেখে হাঁটাচলা
করা যায় না। সুতরাং মানবপুত্র সৈয়দ আহমাদ তারেকও একসময় বয়সের কাছে পরাজিত
হয়ে স্ত্রী-সংসার-সন্তানে স্থিতু হন। কিন্তু বয়স তাকে কাবু করতে পারেনি আজও
তিনি সচল ও প্রাণবন্ত। পূর্ণিমা ঝলসানো রাতের স্পর্শে অথবা অমাবশ্যার
প্রভাবে যখন এলোমেলো হয়ে যান তখন ঢুকে পড়েন চিরচেনা ভুল পথে বা গলিতে।
‘জ্যোৎস্নার দুপুরে হার্মোনিআমে’র মতোই মধ্যরাতে জেগে ওঠেন তেজদীপ্ত
কিংবদন্তিসম কবি সৈয়দ আহমাদ তারেক।