দেবীদ্বারে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা
Published : Monday, 13 September, 2021 at 12:00 AM
এবিএম আতিকুর রহমান বাশার ঃ
দেড় বছর পর আবারো শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত দেবীদ্বার উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা।
সরকারি নির্দেশনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে১২ সেপ্টেম্বর সারা দেশের ন্যায় খুলছে দেবীদ্বারের সকল স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। ৫৪৪ দিন পর শিক্ষার্থীরা ফিরছে ক্লাসে। এক বছর ছয় মাস পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের আঙ্গীনায় পদচারণা, শ্রেণি কক্ষে বন্ধুদের সাথে দেখা, ভালোবাসা বিনিময়। শিক্ষকদেরও শিক্ষার্থী এবং কলিকদের সাথে কুশল বিনিময় এ যেন এক অনাবিল আনন্দ ঘন পরিবেশের মুখরিত মিলন মেলার দৃশ্যাবলোকন। পাশাপাশি কোভিড-১৯ এর কড়াল শ্রোতে হারিয়ে যাওয়া সহপাঠী শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের সহকর্মী হারানো শোকের বহিঃপ্রকাশে অশ্রুসিক্ত হৃদয়বিদারক দৃশ্যপটের অবতারনাও কম ছিলনা।
সরেজমিনে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কর্মচারীদের প্রবেশের সময় লাইন ধরে একে একে প্রবেশ করতে দেখা যায়। প্রবেশের সময় কন্টাকলেস থার্মোমিটারের মাধ্যমে তাপ মাত্রা পরীক্ষা, হ্যান্ড সেনিটাইজার ও মাক্স ব্যাবহারের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ভেতরে, শ্রেণি কক্ষে এবং অফিস কক্ষে প্রবেশ করতে দেখা যায়।
বিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের আলোকে প্রস্তুতি এবং পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী কোন কোন বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ, রং তুলির ছোঁয়ায় নানা রঙ্গে রঙ্গীন ভবন। শ্রেণিকক্ষ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, শ্রেণি কক্ষের পরিবর্তন, টুল- ব্যাঞ্চ, টেবিল- চেয়ার, ফুলের বাগান অপরুপ সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। আবার কোন কোন বিদ্যালয়ের টেবিল- চেয়ার, আঙ্গীনা বিদ্যালয় খোলার দিন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে দেখা গেছে।
দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীর ইসহাক, ফারদিন মাহমুদ, তাহসিনা রহমান, মাইশা মমতাজ, সামিউজ্জান বলে, দীর্ঘদিন একটি শ^াসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পেয়েছি। আজ স্কুলে এসে অনেক আনন্দ পেয়েছি। বন্ধুদের সাথে দেখা শিক্ষকদের সাথে দেখার আনন্দটাই আলাদা। তবে বিদ্যালয়ে ঢুকার পর যা দেখে বেশি আনন্দিত হলাম, তা হল আমাদের বিদ্যালয়ে ঢোকার কাদাযুক্ত সড়কটি পাকা হয়েছে, বিদ্যালয়ের ভবনটি বিভিন্ন রঙ্গে রাঙ্গানো হয়েছে। দ্বিতল ভবনে উঠার সময় দেয়ালে দেয়ালে বর্ণমালা, ছয় ঋতুর নাম, নামতা, বিভিন্ন রঙ্গের নাম চিত্র সহ নানাভাবে প্রদর্শিত আছে। যা দেখে, হাঁটতে এবং দি¦তল ভবনে উঠার সময় শিখে নিতে কষ্ট হবেনা।
দেবীদ্বার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ পাইলট মডেল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়শা রহমান প্রজ্ঞা বলে, প্রায় দেড় বছর পর আজ ক্লাশে আমার বান্ধবীদের সাথে মিলিত হলাম। এসময়ে বিদ্যালয়ের অনেক পরিবর্তন হলেও শিক্ষার পরিবর্তন হয়নি। বিদ্যালয়ের প্রধান গেইটের বাহিরে অভিভাবকদের বসার জন্য সুন্দর একটি ছাউনি আছে, সামনে বিভিন্ন ফুলের বাগান, ভেতরে ৪তলা ২টি ভবন নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের পথে। বিদ্যালয়ের ভেতরেও বাগান সহ বিভিন্ন স্থাপনার অনেক সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা ঘরে বসে একটি চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছি, তবে যেটুকু পুথিগত শিক্ষা নিয়ে পাশ করার কথা তা করতে পারিনি। আমাদের শ্রেণির প্রমোশন বেড়েছে কিন্তু মেধা বাড়েনি। এখন বিদ্যালয় খোলা তাই আমাদের মেধার ঘাটতি পূরণ করে এগিয়ে যেতে হবে।
বিদ্যালয় খোলার প্রথম দিনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ,কে,এম আলী জিন্নাহ, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গাজী মোঃ আনোয়ার হোসেন সহ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাগন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শণ করেন।
মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ,কে,এম আলী জিন্নাহ বলেন, দেবীদ্বারে ৫২টি মাধ্যমিক, ১৬টি কলেজ, ৩১টি মাদ্রাসা এবং ৪০টি বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ ১৪৯টি বিদ্যালয়ের প্রায় ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। আজ বিদ্যালয় খোলার প্রথম দিনেই প্রায় ৯৫% উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক রুটিন তৈরির পাশাপাশি ক্লাসরুমে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করে বসানো, পাঠ ও মূল্যায়ন নীতি, পরিকল্পনা অনুযায়ী এসএসসি ও এইচএসসি এবং পিইসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস সপ্তাহে ৬ দিন হবে। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ক্লাস হবে সপ্তাহে একদিন। এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর পর নবম শ্রেণির পাঠদানের দিন সংখ্যা বাড়বে। আর পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্য শ্রেণির পাঠদানের দিন সংখ্যাও বাড়বে। পাশাপাশি পরিস্থিতি বিবেচনায় জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হবে। কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে সেই তালিকা তৈরির পাশাপাশি এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গাজী মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, দেবীদ্বারে ১৮৫টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯২টি কিন্ডারগার্টেন, ৩টি এনজিও নিয়ন্ত্রিত ও ১টি আন রেজিষ্টার বিদ্যালয় সহ প্রায় ৩৮১টি বিদ্যালয়ের ৩৯ হাজার ৭১২জন উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থী সহ প্রায় ৫৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুল খোলার প্রথম দিনে ৯০% শিক্ষার্থীর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। আমরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত নিয়মাবলি অনুসরণে স্কুলগুলোতে মৌলিক রুটিন তৈরি করে দিয়েছি। ওই রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিন পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হবে। সঙ্গে শনিবার চতুর্থ শ্রেণি, রবিবার তৃতীয় শ্রেণি, সোমবার দ্বিতীয় শ্রেণী, মঙ্গলবার প্রথম শ্রেণি, বুধ এবং বৃহস্পতিবার শুধুমাত্র পঞ্চম শ্রেণিরই ক্লাশ নেয়া হবে। তবে নার্সারী বা প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির কোন ক্লাশ নেয়া হবেনা। যেসব স্কুলে শিক্ষার্থী বেশি সেখানে প্রয়োজনে দুই শিফটে ক্লাস নেওয়া যাবে। প্রথম শিফট সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে ৩টা ঘণ্টা চলবে। দুপুরে ৩০ মিনিটের বিরতি থাকবে। এরপর ক্লাস শুরু হয়ে বেলা ৩টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিনই ক্লাস শুরুর আগে ১০ মিনিট করে কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক আলোচনা করতে হবে। এর আগে ৩০ মিনিট থাকবে শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশের জন্য। একসঙ্গে প্রবেশ ও বের হওয়া যাবে না। প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শুধু বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান হবে। আর পঞ্চম শ্রেণীর সব বিষয়েই পাঠদান চলবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান বলেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারই আলোকে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা অনুসরণ করেই করা হচ্ছে। সরকারি নির্দেশনায় পাঠদান চলাকালে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসংক্রান্ত নিয়মাবলি কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমাদের কাছে মূল অগ্রাধিকার ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা। সেটিকে সামনে রেখে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পুনরায় লেখাপড়া শুরুর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। করোনাসংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় নির্দেশিত পন্থায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন, সিটে বসানোর ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব বজায়, হাত ধোয়া, অসুস্থ হলে বিশেষ কক্ষে পরিচর্যা ইত্যাদি প্রস্তুতি নিয়ে এবং ওয়াশ কক্ষ, ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন সহ সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েই প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেয়া হয়েছে।