ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আসছে উন্নয়নের দিনকাল আসুক প্রাণ গোপাল
Published : Thursday, 16 September, 2021 at 12:00 AM
আসছে উন্নয়নের দিনকাল আসুক প্রাণ গোপালঅধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
অধ্যাপক ডা: প্রাণ গোপাল দত্ত বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন দু:সাহস আমার নাই তবে পেশার খাতিরে দু’একটি কথা না বললেই নয় সঙ্গে তাঁর স্নেহের পরশটুকুও লেখার ব্যাপারে দায়িত্বটুকু বাড়িয়ে দেয়। তিনি স্বর্গীয় কালাচাঁদ দত্ত ও স্বর্গীয় কিরন প্রভা দত্তের সন্তান। ১৯৫৩ সনের ১লা অক্টোবর চান্দিনা উপজেলার মহিচাইল গ্রামের ডাক্তার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। চান্দিনা পাইলট হাই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে এইচএসসি এবং ১৯৭৬ সনে মেধাতালিকায় স্থানসহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে তিনি মুক্তিযোদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন মেডিকেল কলেজ পড়া অবস্থায়। পরবর্তীতে তিনি রাশিয়া, জার্মানী, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর ইএনটি বিভাগীয় ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯ সাল থেকে দুই মেয়াদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব সুনামের সহিত পালন করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে মেধাবী অবস্থানে থেকেও তিনি একটি বর্ণীল রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন অতিবাহিত করেন। ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে পরবর্তীতে সেই কলেজে শিক্ষকতা করে প্রচুর নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ তৈরি করেছেন যারা সারাদেশে এখন অধ্যাপনা করছেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর অনেক পোস্ট গ্রাজুয়েট ডাক্তারদের পড়িয়েছেন যারা এখন গোটা দেশে বিশেষজ্ঞরূপে কাজ করছেন। বিএসএমএমইউতে শিক্ষকতার সময় ইএনটি বিভাগকে আধুনিকায়ন করে অনেক বিরল সার্জারি চালু করেছেন। তাঁর প্রাইভেট প্রাকটিসটিও ছিল অত্যন্ত ব্যস্ততাপূর্ণ। সকালে আমরা যখন ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ি তিনি তখন উনার টিম নিয়ে সার্জারি শুরু করেন এবং সকাল ৭:৩০ মি: এ সার্জারি সমাপ্ত করেন। ৮:০০ টায় গিয়ে বিএসএমএমইউতে হাজির। নিজস্ব আয়োজনে ছোট্ট দুটা লুচি আর বুটের ডাল দিয়ে নাস্তা করতেন। আমি পাঁচ বৎসর বিএসএমএমইউর একাডেমিক কাউন্সিলের মেম্বার থাকার সুবাদে মাঝে মধ্যে তাঁহার সঙ্গে কুমিল্লা থেকে গিয়ে ঐ নাস্তাই করতাম। শুধু অপারেশন ছাড়া দুটা মোবাইল চালু থাকত সবসময় এবং প্রত্যেকটি কলের জবাব নিজেই দিতেন। এটা কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে চান্দিনার একজন সাধারন মানুষের কলও থাকত। চিকিৎসা, অফিস, রাজনীতি একই সঙ্গে একই গতিতে চালাতে পারে এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে অধ্যাপক ডা: প্রাণ গোপাল দত্ত।
জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সর্বশেষ অবস্থান ছিল পরপর দুই মেয়াদে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। একদিন দুপুরে একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং এ উনার পাশে বসেছিলাম। তিনি মিটিং প্রিসাইড করছেন হঠাৎ একটা মোবাইল ফোন জ্বলে উঠল। পাশে থাকার কারণে শুনতে পাচ্ছিলাম ওপাশ থেকে মামা বলে এক মহিলা অটিজম সম্পর্কে কথা বলছে। পরে জিজ্ঞেস করলাম এটা আপনার কোন ভগ্নি অটিজম নিয়ে কথা বলল। তিনি বললেন সে ভাগ্নি হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে পুতুল। তিনি বললেন আমার এ ভাগ্নিটি আমাকে অটিজমের ব্যাপারে যে সমাজ কর্মটি করাচ্ছে এটা এদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং আমার সমাজ কর্মের নেশাটিও এতে অনেকটা স্বস্তি পায়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় ১৯৭১ সনের মহান মুক্তিযোদ্ধে প্রাণ গোপাল স্যারের একটি গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায় আছে। মুক্তিযোদ্ধে মুজিব বাহিনীর জেলা কমান্ডার সৈয়দ রেজাউর রহমানের সঙ্গে থেকে মুজিব বাহিনীতে যোগদান করে মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনিরও একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শেষের দিকে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক কার্যাদি পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে চিকিৎসা সেবায় বিশেষ অবদান ও মুক্তিযোদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক-২০১২’ লাভ করেন। জীবনে একটি মূহুর্তের জন্যও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নাই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করে কিন্তু গুনে ও মানে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌছতে পারে নাই। অধ্যাপক প্রাণ গোপাল ২০০৯ এ উপাচার্যের দায়িত্ব নেয়ার পর পরই মেডিকেল সায়েন্সে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাল্টে উন্নত বিশ্বের ন্যায় রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম চালু করেন। রোগীদের উন্নত চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে রিউমাটলজি, এন্ডোক্রাইনোলজি ও কমিউনিটি অফথালমলজি বিভাগ খোলেন। চিকিৎসা শিক্ষায় গবেষণাকে জোরদার করার জন্য পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠার জন্য সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট এন্ড অটিজম, ক্যান্সার চিকিৎসায় উন্নত সেবাদানে ব্রাকিথেরাপি সেন্টার ও পেলিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট, ফুসফুসের রোগীদের চিকিৎসায় রেসপাইরেটরি উইং খোলেছেন। নিয়োগ ক্ষেত্রে যে বাহুবল ও দলীয়করণের অপতৎপরতা চলছিল তিনি সেটা মেধার ভিত্তিতে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন বিভাগের স্থান সংকুলানের জন্য পাশের ১২ বিঘা জমি যা বিলাশবহুল হোটেল নির্মাণের জন্য নির্ধারিত ছিল এবং রাস্তার ওপারে বাংলাদেশ বেতারের ভবনের জায়গাটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করে নেন। আইসিইউ শয্যাসংখ্যা ১১ থেকে ৩৭ সিসিইউর শয্যাসংখ্যা ১৪ থেকে ৩৫, সাধারণ শয্যা সংখ্যা ১১০০ থেকে ১৫০০, কেবিন সংখ্যা ৬২ থেকে ১২৪, অপারেশন থিয়েটার ২১ থেকে ৫৬ এ উন্নীত করেন। টিনের ঘরে চালু আউটডোরটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার ফলে আগত রোগীর সংখ্যা ১৯০০ থেকে বেড়ে ৫০০০ এ দাঁড়ায়। দুই মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটিকে ন্যায় ও সততা, শিক্ষা, গবেষণা এবং সেবার একটি অনন্য পর্যায়ে এনে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে রূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন।
তিনি যা বলেন তা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও স্পষ্ট। চিকিৎসার ব্যাপারে এবং চিকিৎসা শিক্ষায় তিনি কোন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন না। উন্নয়ন ও সমাজকর্মেও তিনি সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখেন। তিনি একবার এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমার একটা ব্যক্তিগত মতামত, আমরা চিকিৎসকরা বর্তমানে সমাজে যেরকম নন্দিত হবার কথা ছিল, সে রকম নন্দিত নই। বরং কিছুটা সমালোচিত বা নিন্দিত। তাই আমাদের স্ব স্ব অবস্থানে থেকে ব্যবহার, চিকিৎসা সেবা, রোগী এবং তার আত্মীয় স্বজনদের প্রতি এমন সহমর্মিতা দেখাতে হবে তারা যেন আমাদের অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেন এবং আমরাই যেন হই তাদের একটি সত্যিকারের ভরসা স্থান।  আমার অনুরোধ শিক্ষা এবং চিকিৎসা যেন পন্য না হয়ে যায়। যদি পণ্য হয়ে যায় তবে তার গুনগত মান থাকে না। মনে রাখবেন: অ ফড়পঃড়ৎ রং ধ ংঃঁফবহঃ ঃরষষ যরং ফবধঃয”. চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র শিক্ষকদের সদুপদেশ দিতে তাঁর কোন কার্পন্য নাই। ২০১৫ সনে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় সমাবর্তনীতে বলেন, “আপনাদের জীবনের সুবর্ণ অধ্যায়টি এই প্রিয় শিক্ষাঙ্গণে কাটিয়ে গেছেন। আপনারা যে যেখানে থাকুন না কেন, সেখানেই আপনারা আপনাদের এই মাতৃসম প্রতিষ্ঠানের জন্য শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করে যাবেন। আপনাদের সাফল্য এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য, আপনাদের সম্মান ও প্রাপ্তি প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিষ্ঠানের সম্মান ও প্রাপ্তি। আমি আশা করব আপনাদের শিক্ষা ও সেবা শুধু ব্যক্তি কল্যাণে নয়, সামগ্রিকভাবে মানব কল্যাণেও ব্যবহৃত হইবে। আবারও স্মরন করিয়ে দিচ্ছি, অ ঢ়ধঃরবহঃ ফড়বং হড়ঃ পধৎব, যড়ি সঁপয ুড়ঁ শহড়ি ৎধঃযবৎ ঃযবু ফবসধহফ যড়ি সঁপয পধৎরহম ুড়ঁ ধৎব”.
যেসকল চিকিৎসক নেতা হন তাদের প্রায় অনেকেই চিকিৎসা পেশা ছেড়ে দেন অথবা চিকিৎসা বিদ্যা ভুলে যান। তবে তার ব্যতিক্রমও আছে যেমন বিধান রায় ও প্রফেসর ইব্রাহীম। আমার মনে হয় অধ্যাপক প্রাণগোপাল ব্যতিক্রমই হবেন, যত ব্যস্ততাই থাকুক তিনি পেশাকে একটা সময় অবশ্যই দিবেন। এমপি হলে আশা করি মন্ত্রীও হবেন পেশাও ছাড়বেন না সাথে রাজনীতি, উন্নয়ন ও সমাজকর্ম চলবে সমান্তরাল। তাঁর দৃষ্টি বড়ই তীক্ষ্ম তাই এরই মাঝে দেখে ফেলেছেন চান্দিনার মৌলিক সমস্যাগুলি কি কি। মনোনয়ন যে দিন পেলেন তার পরের দিনই বলেছিলেন সবুজ বিপ্লব, শ্বেত বিল্পব, স্কুল কলেজের উন্নয়ন, রাস্তাঘাটের মেরামত ও উন্নয়নের কথা। চান্দিনার এমন কোন সমস্যা নাই যেটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না বা সে সমস্যাটা তিনি সমাধানে সচেষ্ট হবেন না। সরকারের এমন কোন পর্যায় নাই যেখানে প্রাণ গোপালের গমনাগমন নাই। তাই বলব শুধু চান্দিনা নয় কুমিল্লাকে বিভাগ করতে বা কুমিল্লার চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন কুমিল্লা জেলা শাখা