ড. মো. সহিদুজ্জামান ||
সারা দেশেই ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ থাকলেও সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ঢাকা শহরের বাসিন্দারা। দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রকোপ। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ১৩ সেপ্টেম্বর এক দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩২১ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। ১০ দিনে তিন হাজার ২০০ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে। এ বছরের শুরু থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ১৪ হাজার ২২১।
ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের মধ্যে প্রথম তিনটি সেরোটাইপ (ডেনভি-১, ২ ও ৩) এযাবৎ শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশে। বর্তমানে টাইপ-৩ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, যাতে মৃত্যুহার বেশি বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডেঙ্গু নিয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা শোনা গেলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে সমস্যা কোথায়। সমস্যা নিশ্চয়ই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা ও জনসচেতনতার অভাব। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একার পক্ষে ডেঙ্গু বা মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস। প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। যার কাজ তাকে করতে দেওয়া, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নেওয়া এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ যেকোনো রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ডেঙ্গু যেহেতু একটি মশাবাহিত রোগ, তাই মশা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আবার মশা নিয়ন্ত্রণ ও নিধন একটি টেকনিক্যাল ও বিজ্ঞানসম্মত বিষয়। শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মশার ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা। মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার। মশা নিয়ন্ত্রণে প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ হলো মশার নজরদারি করা বা প্রাদুর্ভাব স্টাডি করা অর্থাৎ কোন এলাকায় কোন মশা আছে এবং কী পরিমাণে আছে তা খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়ত, ওই সব এলাকায় মশার প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য কারণ ও উৎস খুঁজে বের করা। তৃতীয়ত, মশা ও প্রজননের ধরন অনুযায়ী মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণে টেকসই পদ্ধতি প্রয়োগ করা। পাশাপাশি ব্যবহৃত ওষুধগুলো কতটুকু কার্যকর এবং এগুলোর বিরুদ্ধে মশা প্রতিরোধ তৈরি করেছে কি না, তা-ও পরীক্ষা করে দেখা।
প্রতিবছর একই সময়ে (বর্ষাকালে) মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। বছরের এই বিশেষ সময় ডেঙ্গু কোথা থেকে আবির্ভূত হয়, তা নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। আমাদের প্রকৃতিতেই এই ভাইরাস তার জীবনচক্র রক্ষা করে চলেছে। মশার দেহে বংশপরম্পরায় রয়েই যাচ্ছে এই জীবাণু অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এটি স্থানান্তরিত হচ্ছে প্রকৃতিতে। পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মশার প্রজনন একদিকে যেমন বেড়ে যায়, অন্যদিকে ডেঙ্গু ভাইরাস মশার পুরো শরীরে বিস্তার লাভ করে যখন নাকি মশাটি ডেঙ্গু ছড়াতে সক্ষম হয়। আবার পরিবেশের তাপমাত্রা যখন কম থাকে, তখন মশার শরীরে ডেঙ্গু থাকলেও তা কামড়ালে মানুষে ছড়াতে পারে না। তাই উষ্ণ আবহাওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়।
বর্ষার আগেই এডিস মশার আবহাওয়ার পূর্বাভাস সাপেক্ষে আগাম সতর্কীকরণ, আবাসস্থল পর্যবেক্ষণ, প্রজনন নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ, মশার দেহে ডেঙ্গুর উপস্থিতি এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
আমাদের দেশে মশার ওষুধ ছিটিয়ে কাজ হয় না প্রায়ই শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় হতে পারে—প্রথমত, ব্যবহৃত কীটনাশকের পরিমাণ ও গুণগত মানে সমস্যা এবং দ্বিতীয়ত, মশার মধ্যে কীটনাশক বা বালাইনাশক প্রতিরোধী সক্ষমতা তৈরি হওয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্গানোফসফরাস ও পাইরিথ্রইডস গ্রুপের বালাইনাশকের বিরুদ্ধে মশার প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠার রিপোর্ট রয়েছে। আমাদের দেশে ব্যবহৃত বালাইনাশকের বিরুদ্ধে মশার প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তা নিয়মিত পরীক্ষা করা দরকার। এ ছাড়া কৃষিকাজে পোকামাকড় দমনে অপরিমিত কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহারে মশার প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে গিয়ে এসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। তাই মশা নিধনে অবশ্যই নতুন নতুন বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
ডেঙ্গু ভ্যাকসিন বা টিকা নিয়ে চলছে গবেষণা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত এ পর্যন্ত মাত্র একটি টিকা রয়েছে, যেটি বিশ্বের প্রায় ২০টির অধিক দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে, বিশেষ করে ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে যেমন মশার প্রজনন বেড়ে গেছে, তেমনি জনসংখ্যা বাড়ার কারণে এডিস মশার প্রজননের স্থানও বৃদ্ধি পেয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের পাশাপাশি জনসচেতনতাও প্রয়োজন। প্রয়োজন আমাদের নাগরিক দায়িত্ব পালন। বাড়ির আশপাশে বা ছাদে যাতে মশা প্রজনন ঘটাতে না পারে সেটি খেয়াল রাখা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। কারো অবহেলায় বা অসচেতনতায় যদি মশার প্রজননের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে উন্নত দেশগুলোর মতোই আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মশা ও অন্য ভেক্টর বা বাহক নিয়ন্ত্রণের জন্য একক ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা অনুসন্ধান, নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ের মাধ্যমে মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমাদেরও সে রকম প্রতিষ্ঠান তৈরি করা দরকার, যারা স্বাধীনভাবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে জবাবদিহির সঙ্গে কাজ করে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। টেকসই প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, ব্যবহৃত মশার ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রেখে ক্ষমতায়িত করতে পারলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে হয়তো ভালো ফল মিলবে। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় থাকবে এর শাখা-প্রশাখা, যারা সারা বছর ধরে এক ছাতার নিচে কাজ করবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়