স্মৃতি চক্রবর্তী ||
আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার পথ অনেক ক্ষেত্রেই মসৃণ নয়। নিম্নবিত্তের অবস্থা তো আরও কঠিন। এর মধ্যে দীর্ঘদিন চলমান করোনা-দুর্যোগ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টান পড়েছে মানুষের জীবন-জীবিকায়। দেখা যাচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের কাজ হারিয়ে কর্মহীনের সংখ্যাভুক্তের তালিকাও ইতোমধ্যে অনেক দীর্ঘ হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে জনজীবনে যে বৈরী ছায়া পড়েছে, তা কবে কাটবে এ এক অন্তহীন প্রশ্ন। আমরা জানি, প্রাণী মাত্রেরই বেঁচে থাকার জন্য প্রধান অবলম্বন খাদ্যদ্রব্য। মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষ কেবল প্রাণীমাত্রই নয়; মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট অবলম্বন থাকা জরুরি। মানুষ যে কোনো কিছুই খেতে পারে না। মানুষের খাদ্য তালিকায় সুষম কিংবা পুষ্টিকর অনেক কিছু না থাকলেও অন্তত ডাল-ভাতটুকু নিতান্ত প্রয়োজন। কিন্তু এই ডাল-ভাত জোগাড়ই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। দরিদ্র কিংবা হতদরিদ্রদের নাগালে নেই এই ডাল-ভাতও- এমনটিই বলা হয়েছে গত ১১ সেপ্টেম্বর আমাদের সময়ে প্রকাশিত অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে। ‘মধ্যবিত্তের পকেটে কুলাচ্ছে না বাজার খরচ’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে স্পষ্টতই বোঝা যায়, করোনা দুর্যোগের দীর্ঘ অভিঘাত মানুষের জীবনে কত রকম বিড়ম্বনারই সৃষ্টি করেছে। মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম উদ্বেগজনকভাবে ঊর্ধ্বমুখীসহ নানা কারণে জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতোমধ্যে কথাবার্তা কম হয়নি। নেতিবাচকতার দীর্ঘ ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে এই বাজার ব্যবস্থাপনা। আমাদের বাজারে দেখা যায়, পণ্যদ্রব্যের দামের ঊর্ধ্বগতির পেছনে কলকাঠি নাড়ে সংঘবদ্ধ অশুভ চক্র। তাদের বলা হয়, ‘সিন্ডিকেট’। সরকারের দায়িত্বশীলরাও ইতোমধ্যে অনেকবারই এই সিন্ডিকেটের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু বিস্ময়কর হলো- সিন্ডিকেটের হোতাদের নিবৃত্ত করা যায় না। তারা তাদের মতো করেই মানুষের পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভারী করছে। আমরা ইতোমধ্যে বহুবার দেখেছি- চাল-ডাল, চিনি, ভোজ্যতেলসহ অনেক নিত্যপণ্যের দামই সরকার নির্ধারণ করে দেয় বটে, কিন্তু এর কোনোই প্রতিফলন বাজারে দেখা যায় না। করোনা-দুর্যোগের মতো ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়েও অসাধু চক্র এর কোনো ব্যত্যয় ঘটায়নি। যথাযথ প্রতিকারহীনতার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি। এর পেছনে অনেক কারণ চিহ্নিত হওয়ার পরও কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। আমরা জানি, চাল আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্য। অথচ এই চাল নিয়ে প্রায় ধারাবাহিকভাবে চলছে চালবাজি। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে সরকার অনেকবার চাল আমদানি করেছে। আমদানি শুল্কও কমিয়েছে কিন্তু ভোক্তারা এর যথাযথ সুফল কখনই কাক্সিক্ষত মাত্রায় পাননি। সরকার আবারও আমদানি শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এর কোনো বিকল্পও ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- ভোক্তারা কি এবার এর সুফল পাবেন?
বাজার অস্থির। বাজারে অস্থিরতা মানেই সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনা, অন্তহীন ভোগান্তি, জীবনযাপনে ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। নিয়ন্ত্রণহীন বাজার পরিস্থিতি সঙ্গতই প্রশ্ন দাঁড় করায়- বাজার নিয়ন্ত্রণের লাগাম কার হাতে। পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত বিক্রেতাদের অজুহাতের কোনো শেষ নেই। খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের। পাইকারি ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করেন বড় আমদানিকারকদের। আর বড় আমদানিকারকরা প্রায়ই দোহাই দেন আন্তর্জাতিক বাজারের। অথচ অনেকবারই এ-ও দেখা গেছে, যেসব পণ্য আমদানি করতে হয় না কিংবা আমদানিকৃত যেসব পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়েনি বা বাড়ে না এসবের দামও আমাদের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায় ব্যাখ্যাহীনভাবে। আমন মৌসুমের এখনো অনেক বাকি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ধান-চালের মজুদ নিয়েও প্রশ্ন আছে। সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ, চাতাল মালিকদের গুদামে রয়েছে প্রচুর ধান-চাল। অনেক নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা উঠে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- এই বিপন্ন-বিপর্যস্ত সময়েও যারা মানুষের অসহায়ত্ব পুঁজি করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত, তাদের চিহ্নিত করে অন্যায়-স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিকার করা কি খুব দুরূহ? আমরা জানি, সরকার করোনা-দুর্যোগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা কিংবা সীমা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। নানা খাতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক প্রণোদনাও দিয়েছে।
সরকারের এতসব কল্যাণকর পদক্ষেপ সত্ত্বেও রাষ্ট্রের ভুক্তভোগী শ্রেণির মধ্যে অনেক বড় একটি অংশ স্তরে স্তরে অসাধু দায়িত্বশীলদের কারণে কাক্সিক্ষত সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গত ১৩ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিক পত্রিকায় উঠে এসেছে, সরকারের প্রদেয় নানারকম ভাতা নিয়ে ভুক্তভোগীদের ফাঁদে ফেলে অসাধু কিছু জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা কী রকম তুঘলকিকা- চালাচ্ছেন। যেখানে উল্লেখযোগ্য মানুষের জীবনযাপন মারাত্মকভাবে কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে বাজারে অসাধু বলবানদের আস্ফালন চলমান মানবিক দুর্যোগে ফের যে বিড়ম্বনার সৃষ্টি করেছে, এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া কি কঠিন? মূল কথা হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নসহ বাজারের ওপর সরকারের নজরদারি বৃদ্ধি ও কঠোর করার পাশাপাশি অসাধুদের মূলোৎপাটন করা। আরও কথা হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা কিংবা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে অঙ্গীকারের বাস্তবায়নে নির্মোহ পদক্ষেপ নেওয়াও অত্যন্ত জরুরি। সত্য বটে, কিছু পদক্ষেপ নেওয়াও হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মেলেনি সুফল। কেন? এই ‘কেন’র উত্তরটা অনুসন্ধান করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারি বিপন্ন সংস্থা টিসিবিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি এর কার্যক্রমের পরিধি বিস্তৃতকরণের জনদাবি নতুন না হলেও এরও তেমন অগ্রগতি নেই। অথচ ভোক্তার স্বার্থরক্ষা করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। ভোক্তাকে সুরক্ষা দিতে হলে অবশ্যই সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার কেন অস্থিতিশীল হয় এর পেছনের অনেক কারণই যেহেতু অজানা নয়, সেহেতু এর সুরাহাও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলদের কাছে কঠিন কিছু বিষয় হতে পারে না। যদি উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি গ-িমুক্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা জনকল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং জনপ্রত্যাশা পূরণে দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকারে নিষ্ট হতে না পারেন তা হলে প্রতিকারের আশা দুরাশাই মাত্র। বাজারের অস্থিতিশীলতায় দফায় দফায় সাধারণ মানুষের নাভিশ^াস ওঠে। বাজার নামক স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা কেন খুব জরুরি, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিশ্চয়ই নিষ্প্রয়োজন।
লেখক: প্রাবন্ধিক