তপন কুমার ঘোষ ||
পত্রিকার
পাতা ওল্টালেই চোখে পড়ে নারী নির্যাতনের খবর। ধর্ষণ-গণধর্ষণ প্রায় রোজকার
খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইদানীং ইন্টারনেটনির্ভরতা বেড়েছে। এতে দোষের কিছু নেই।
কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার সচেতন মানুষকে ভাবাচ্ছে। সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-মেসেঞ্জার-হোয়াটসঅ্যাপ-ইমো অনেকের জন্যই কাল হয়েছে।
ফেসবুকের
মাধ্যমে পরিচয়ের পর প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা ঘটছে অহরহ। অনেক ঘটনাই
গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না। আজকাল অবশ্য ভিকটিমের অনেকেই সাহস করে এগিয়ে
আসছেন। থানায় বা আদালতে মামলা করছেন। কেউ কেউ লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি
প্রকাশ্যে আনতে চান না। ফ্লাশব্যাকের মতো ফিরে আসছে একই ঘটনা। চেনা ছক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়। নিয়মিত চ্যাট। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা। এক
পর্যায়ে ভিডিও চ্যাট শুরু। মাঝেমধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ। গোপন ক্যামেরায়
অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ধারণ করে রাখা। সুযোগ বুঝে অসতর্ক
মুহূর্তের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ ও চাঁদা
আদায়। এভাবে প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে অনেক সহজ সরল
মেয়ে।
মিথ্যা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, মডেল বানানোর
আশ্বাস দিয়ে, চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার একজন
নারীর পক্ষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সহজ নয়। নানা অপবাদ ধেয়ে আসে তার
দিকে। তাই কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। প্রতারণার এতসব কাহিনি গণমাধ্যমে
প্রচারের পরও সচেতনতা বাড়ছে না কেন? কেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? এ
প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? ভেবেচিন্তে কাজ না করলে পরে পস্তাতে হয় এ তো জানা
কথা।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। ধর্ষণের
মতো জঘন্য অপরাধে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েছে। জানুয়ারির ঘটনা। বিকৃত যৌনাচারের
ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাজধানী ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এক
ছাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়। যৌনতা নিয়ে মানুষের বিকার কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে
পারে তার প্রমাণ এ ঘটনা।
সমাজবিদ ও মনোবিদরা নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।
শিশুকে শিষ্টাচার শেখাতে হবে। পারিবারিক পরিবেশ উত্তম না হলে সমূহ বিপদ।
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। যা দেখে তা-ই শেখে। শিশুদের সুস্থ বিনোদন নেই। সামাজিক
জীবন নেই। দিন দিন আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। সামাজিক সম্পর্কগুলো দুর্বল হয়ে
পড়ছে। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও সৃজনশীল চর্চার অভাবে
শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অতি আদর বা অনাদর কোনোটাই
শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পক্ষে সহায়ক নয়। পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমে
তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের প্রতি নজর রাখতে হবে। এসব নিয়ে বিস্তর
আলোচনা হচ্ছে আজকাল। সন্তানের অমঙ্গল কোনো মা-বাবা চান না। কিন্তু
পরিস্থিতির ফেরে অনেক ক্ষেত্রে তারা অসহায়।
যৌনতার বাইরে নারী-পুরুষের
সম্পর্ক ভাবতে পারেন না সমাজের বেশির ভাগ মানুষ। সুযোগ পেলেই
কুপ্রবৃত্তিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ
পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি। পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা উসকে দিচ্ছে
ধর্ষণ-প্রবণতা- এ অভিমত অনেক বিশিষ্টজনের। ধর্ষণের যত বেশি প্রচার হয়
প্রাদুর্ভাবও তত বাড়ে- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ অভিমত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে
হবে।
প্রতারণা নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ই-কমার্স। অভিযোগ,
ডজনখানেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার শিকার হয়ে পথে বসেছেন লাখ লাখ
গ্রাহক। লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের থেকে আগাম অর্থ নিয়ে এখন পণ্য সরবরাহ
বা গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে অপারগ ওই প্রতিষ্ঠানগুলো। বাজারমূল্যের চেয়ে
অনেক কম মূল্যে পণ্য বিক্রির অফার দেয় কিছু প্রতিষ্ঠান। এমন লোভনীয় অফার
যারা হাতছাড়া করতে চাননি তারা এখন প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। ‘ভাবিয়া করিও
কাজ, করিয়া ভাবিও না’- এ আপ্তবাক্য কি মূল্যহীন?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলে কানাডায় ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে
চাকরি-প্রত্যাশীদের থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র।
এভাবে সপ্তাহে ১২-১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওই
প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।
প্রচলিত ধারণা হচ্ছে শাস্তি বাড়লে অপরাধ কমবে।
এটা সত্য, শাস্তির ভয় না থাকলে অনেক সময় মানুষ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু
অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু কঠোর আইন করলেই অপরাধ কমে না। একসময় ধর্ষণের পর হত্যায়
মৃত্যুদন্ডের বিধান ছিল। পরে আইন কঠোর করা হয়েছে। এখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ
সাজা মৃত্যুদন্ড। বছরখানেক আগে নতুন আইন কার্যকর হয়েছে। কিন্তু সমাজ
ধর্ষণের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়নি। বিশিষ্টজনদের অভিমত, দ্রুত বিচার করে
অপরাধীদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
সব কথার শেষ কথা- নারীর প্রতি সামাজিক
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর
বিষয়ে কিছুতেই কিছু হবে না। আমরা মুখে যা-ই বলি না কেন, ভিতরে ভিতরে
আজন্মলালিত বিশ্বাস ধারণ করেই চলেছি। শুধু সমালোচনা নয়, দোষারোপ নয়, আমাদের
সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। আমরা
সে দায়িত্ব পালন করছি কি? প্রতারকদের স্বর্গরাজ্য নয় আমার বাংলাদেশ, এটা
প্রমাণ করতে হবে। সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। চাই সামাজিক আন্দোলন। নইলে
পরিস্থিতি আরও বেগতিক হবে। এভাবে চলতে পারে না। চলতে দেওয়া যায় কি?
লেখক : পরিচালক পরিচালনা পর্ষদ বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।