ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
পোলিওমুক্ত বিশ্ব গঠনে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল
Published : Sunday, 24 October, 2021 at 12:00 AM
পোলিওমুক্ত বিশ্ব গঠনে রোটারি ইন্টারন্যাশনালরোটারিয়ান প্রফেসর ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ ।।
২৪ অক্টোবর বিশ্ব পোলিও দিবস। আমরা এখন প্রায় পোলিওমুক্ত বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে। রোটারি ইন্টারন্যাশনাল তথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২২-২০২৬ সালের মধ্যে সারা পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারন করেছে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পোলিওমায়েলাইটিস (চড়ষরড়সুবষরঃরং) এক ধরণের ভাইরাস জনিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এটি সচরাচর পোলিও নামেই সর্বাধিক পরিচিত। এই রোগটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাসযুক্ত ড্রপলেট বা দুষিত পানির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। পোলিও ভাইরাস আন্ত্রিক ভাইরাস (ঊহঃবৎড়ারৎঁং) দলেরই অন্তর্ভূক্ত কারণ এটি শরীরের অন্ত্র পথেই দেহে প্রবেশ করে থাকে। দূষিত খাবার ও পানির সাথে প্রবেশ করার পর পোলিও ভাইরাস রক্ত কোষের মধ্যে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে রক্তে সংক্রমন ঘটায়। পরবর্তিতে ভাইরাস প্রান্তীয় স্নায়ু নিওরনের মায়েলিন সমূহকে ধ্বংস করে ফেলে এর ফলে মাংস পেশী অবশ হয়ে প্রক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে যায়। এই অবস্থাই সাধারণভাবে পোলিও বলে পরিচিত। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সাময়িক কিংবা স্থায়ীভাবে শারীরিক ক্ষতির সম্মূখীন হন। শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই এ রোগের কোন উপসর্গ দেখা যায় না। সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরাই পোলিও রোগে আক্রান্ত হয় বেশী। তবে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন  রুজভেল্ট ১৯২১ সালে তার ৩৯ বছর বয়সে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন। তবে প্রচন্ড মনোবলের কারনে তিনি এ রোগকে পরাজিত করেন। তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করতেন। এ রোগের কোন চিকিৎসা নেই তবে নিরাপদ ও কার্য্যকর ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদানের মাধ্যমে পোলিওমুক্ত হওয়া সম্ভব।
১৮৪০ সালে জার্মান অর্থোপেডিক সার্জন জ্যাকব হেইন সর্বপ্রথম পোলিওমায়েলাইটিস আবিষ্কার করেন। ১৮৯৪ সালে আমেরিক্রার ভারমন্ট শহরে ব্যাপকভাবে  পোলিও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে ১৮ জন মানুষ মারা যায় ১৩২ জন স্থায়ী ভাবে বিকলাঙ্গ হয়। ১৯০৮ সালে এর প্রধান উপাদান  পোলিওভাইরাস জীবাণুর উপস্থিতি চিহ্নিত করেন কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার ও এরউইন পপার। ১৯১৬ সালে আমেরিকা জুড়ে  পোলিও প্রায় ৬,০০০ মানুষের প্রাণ নিয়েছিল এবং আরও হাজারো পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। ১৯৫০ হিলারী কপরোভস্কি ২০ জন শিশুদের উপরে ওরাল  পোলিও ভ্যাকসিন এর পরীক্ষা করে সাফল্য পান। পরবর্তিতে ১৯৫৪ আমেরিকায় ২ মিলিয়ন শিশুর উপর এই টিকা প্রয়োগে ব্যাপক সুফল পাওয়া যায়। ১৯৬০ সালে ডা. আলবার্ট সাবিন উদ্ভাবিত ওরাল ভ্যাকসিনটিকে আমেরিকার সরকার লাইসেন্স প্রদান করে। টিকা আবিষ্কারের পূর্বে প্রতি বছর বিশে^ ১৫ থেকে ২০ হাজার শিশু পোলিও রোগে মৃত্যুবরণ করতো। ১৯৭৯ সালে রোটারি ইন্টান্যাশনাল ফিলিপাইনে ৬ লক্ষ শিশুকে টিকা প্রদানের কর্মসূচী গ্রহনের মাধ্যমে এই পোলিও কার্যক্রম শুরু করে। রোটারি এবং তার সহযোগী সংস্থা সমূহ মিলে প্রায় ২৫০ কোটি শিশুকে টিকাদান কর্মসূচীর আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।
রোটারির পোলিওপ্লাস কর্মসূচি
বিশ্ব থেকে পোলিওমায়েলাইটিস দূর করার জন্য পোলিওপ্লাস কর্মসূচী হল রোটারির একটি বিশাল ও দৃষ্টান্তমূলক প্রচেষ্টা। উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের পোলিওর বিরুদ্ধে টিকাদান কার্যক্রমের জন্য পাঁচ বছরের জন্য ১২০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৫ সালে এটা শুরু হয়েছিল। ১৯৮৮ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের বার্ষিক সভায় পৃথিবী থেকে বৈশি^ক পোলিও নির্মূল প্রকল্প (এষড়নধষ চড়ষরড় ঊৎধফরপধঃরড়হ ওহরঃরধঃরাব - এচঊও) হাতে নেয় এবং রোটারি ইন্টারন্যাশনালও এই কার্যক্রমে যোগ দেয়।
রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, বিল ও মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় সরকার একসাথে যুক্ত হয়ে বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূলে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রচেষ্টায় রোটারির ১২ লক্ষাধিক সদস্য তাদের সময়, শ্রম, মেধা, অর্থ ও দক্ষতা দিয়ে স্ব স্ব দেশের জাতীয় সরকারকে পোলিও নির্মূলে সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করছে।  
২০১৯ সালে পোলিও নির্মূলে ৫ বছর মেয়াদি যে বাজেট ঘোষনা করা হয়েছে তার পরিমান হরো ৪.২ বিলিয়ন ডলার।  যা এই প্রচেষ্টাকে বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পাবলিক-প্রাইভেট স্বাস্থ্য সংস্থা করে তুলেছে।
সারা পৃথিবী এখন প্রায় পোলিও মুক্ত। এখন মাত্র দুটি দেশ - পাকিস্তানে ৪ টি ও আফগানিস্তনে মাত্র একটি ওয়াইল্ড পোলিও ভাইরাস (ডচঠ) আক্রান্ত রোগী আছে।  তবে সম্প্রতি সার্কুলেটিং ভ্যাকসিন ডিরাইভড পোলিও ভাইরাস (পঠউচঠ) সংক্রমিত বেশ কিছু রোগী পৃথিবীর প্রায় ৩৪ টি দেশে সনাক্ত হয়েছে। এই পঠউচঠ সংক্রমনের মূল কারণ হলো টিকাদান কার্যক্রমের নিম্ন হার অথবা ধীর গতি।
পোলিও প্লাস কার্যক্রমের অর্থ হচ্ছে রোটারিয়ানরা  শুধু পোলিও নিমূল করেই শেষ করবে না তারা পোলিও পরবর্তি  অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধেও অবকাঠামো গড়ে তুলতে কাজ করবে। বর্তমান এই কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিরোধেও পোলিওপ্লাস কর্মসূচী তার কার্যক্রম শুরু করেছে।
আজ পর্যন্ত বিশ্ব যত মানবতবাদী পরিষেবা দেখেছে পোলিওপ্লাস কর্মসূচি তার মধ্যে বৃহত্তম বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রত্যেক রোটারিয়ান এর সাফল্যের জন্য গর্ব অনুভব করতে পারেন।
লেখক: সদস্য, রোটারি বাংলাদেশ ন্যাশনাল পোলিওপ্লাস কমিটি