বুবনের প্রশ্ন এবং উত্তর দ্বিবিধ
আনোয়ারুল হক ||
রাতের খাবার টেবিলে
খেতে বসে বুবন আজ খুব গম্ভীর। কিছুক্ষণ আগে ওর মা শায়লা বেগম তাকে তিনতলায়
ওর দাদু নিজামুল করিম সাহেবের ঘর থেকে ডেকে এনেছেন।
বুবনের স্বভাব এমন
নয়। সে সবসময়ই হাসিখুশি, কৌতূহলি ও ছটফটে। খাওয়ার টেবিলে ওর আজকের আচরণ
নিতান্তই বেমানান। একমাত্র বোন শিলা, বাবা-মা ওরা সবাই জানে, খাবার টেবিলে
বসে বুবন কোন ভুল করবে না, পানির গ্লাস অথবা খাবার প্লেট উল্টে ফেলবে না,
তা কী হয়! শিলা তার বড় বোন হলেও খাবার টেবিলের নিচ দিয়ে ওর বোনের পায়ে
খোঁচা দেবে না, এটা না হয়ে যায় কী করে! সেই বুবন- মা ডাক দেয়ার পর ডাইনিং
টেবিলে এসে কী যেন ভাবতে ভাবতে মাথা নিচু করে কোন কথা না বলে খাবার প্লেট
আস্তে করে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে! মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির
ছাত্র বুবনের এরকম চুপচাপ খেয়ে যাওয়ার ভান সহজে কোন সময়েই মানায় না।
ডিম্বাকৃতির
ছোট গড়নের চারটে চেয়ারের ডাইনিং টেবিলের যে দিকে বুবনের বাবা শামছুল করিম
বসেছে তার উল্টোদিকে ওর মা শায়লা বেগম, তার ডানে বুবনের বড় বোন শীলা,
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী, আর বাম দিকের চেয়ারে বুবন।
কাজের বুয়া, এই পরিবারের দীর্ঘদিনের সঙ্গী- যাকে ছেলেমেয়ে দুজনে খালা বলে
ডাকে, সে টেবিল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজনে এটা-ওটা এগিয়ে দেয়ার
জন্য।
এই বাড়ির দোতলায় তিনটি বেডরুম সঙ্গে এটাচড বাথ, ড্রইং- ডাইনিং
স্পেস, কিচেনসহ চৌদ্দশ স্কয়ার ফিটের মোটামুটি পরিচ্ছন্ন সুন্দর বাসগৃহের
মালিক শামছুল করিম। গুলশান শাখা এক্সিম ব্যাংকের একজন কর্মকতা। বসুন্ধরার
জি ব্লকের চার নম্বর রোডের ছ’তলা দালানের এ বাড়িটি বুবনের দাদার কেনা
সম্পত্তি। ডেভেলপার দিয়ে করা।
সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব সাজেদুল করিম
বাড়ি হয়ে যাওয়ার পর ভাগে যে কটা ফ্ল্যাট পেয়েছেন, তার থেকে একমাত্র ছেলে
শামছুল করিমকে দিয়েছেন দোতলার এই খাঁচাটি। ব্যাঙ্কার পুত্র রসিকতা করে এই
জাতের বাসগৃহগুলোকে খাঁচা কিংবা মেচবাক্স বলেন।
আজকাল ফ্ল্যাট বাড়িগুলোকে করিমের এমনই মনে হয়। সে দিলখোলা হাসিখুশি মানুষ।
খাবার
টেবিলে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী সবাইকে ও একসঙ্গে পেতে চায়। দিনের বেলা সকালে
অথবা দুপুরে যে যার কাজের তাগিদে একত্রে বসা হয় না বলে রাতের এ সময়টা তার
খুব প্রিয় সময়। তাই শিলা, বুবনকে সে নিয়ম করে দিয়েছে, যার যত কাজই থাক ওদের
মা শায়লা বেগমের ডাক পড়লে খাবার টেবিলে ছেলেমেয়ের হাজির হওয়া চাই।
প্রতিদিনের মতোই আজও সবাই খেতে বসেছে।
হররোজ
যা হয়, খেতে বসে চারজনের সংসারে টুকটাক সারাদিনের জমানো যার যার গল্প হবে,
ভাইবোন শিলা-বুবন এ ওর কথায় খুনসুটি করবে, বড় বোনের সঙ্গে বেশি বাড়াবাড়ি
হয়ে গেলে শায়লা মৃদু ধমক দিয়ে শুধরে দেবে ছেলেকে, আর অপরদিকে শামছুল করিম
আপত্য স্নেহে ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে মধুর করে হাসবে।
কিন্তু আজ সেরকম
কিছুরই লক্ষণ নেই। বুবনের গোমড়া, গৌতম গম্ভীর চেহারা খাবার টেবিলের পুরো
পরিবেশটাই যেন গুমোট করে রেখেছে। শামছুল করিম খেতে খেতে বুবনের আচরণ লক্ষ্য
করছেন। মেয়ে শিলার সঙ্গে একবার দৃষ্টি বিনিময় করে ইশারায় জানতে চাইলেন, সে
কিছু জানে কি-না! শিলা ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে সাদামাটা চাহনি দিয়ে জানান
দিল, সে কিছু জানে না।
ওদিকে বুবনের মা শায়লা বেগম সবার খাবার তদারকিতে
ব্যস্ত। বুবনের হাবভাব জননী খেয়াল করলেও অতশত বুঝার চেষ্টা করছে না। শামছুল
করিম অপেক্ষা করছেন। ছেলে কখন একসময় সরব হবে। কিন্তু না, বুবন আগের মতোই
আনমনা, খেতে বসার পর থেকেই পাতের ভাত নাড়াচাড়া করছে, খাচ্ছে না। কী ভাবছে
সে? শামছুল করিম অবাক কণ্ঠে একসময় প্রশ্ন করলেন,
-বুবন, খেতে বসে খাচ্ছিস না ঠিকমতো, কোন সমস্যা?
প্রশ্ন শুনে বুবন মুখ তুলে বাবা শামছুল করিমের মুখের ওপর চোখ রাখল।
ভারি
লেন্সের চশমার কাচের ভিতর দিয়ে বুবনের চোখের কালো মণি দুটো ওর বাপের চোখের
মণিতে ছায়া ফেলল। কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে বুবন বলল,
-তুমিতো আমাদের কাছে কখনও মিথ্যা বলো না বাবা, কিন্তু-
পুত্রের কথার ঢংয়ে ভীষণ অবাক হল শামছুল করিম। প্রশ্ন করলেন,-কিন্তু?
বুবন
মুখ নিচু করে ভাত নাড়ল, গ্লাসে পানি ঢেলে সময় নিয়ে খেল, তারপর
বলল,-মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতে গিয়ে তুমি তো বলেছিলে, মুক্তিযুদ্ধের পুরো
সময়টা দাদু তার বাবা-মায়ের সঙ্গে, মানে তোমার দাদা-দাদির সঙ্গে লন্ডনে
মামার কাছে ছিলেন। তিনি যুদ্ধে যাননি। দাদু সেখানে থেকে ও লেভেল পাস করার
পর যুদ্ধ শেষে তোমার দাদা-দাদির সঙ্গে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন।
তাহলে যুদ্ধে না গিয়ে থাকলে আমার দাদুর কাছে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট এল কি করে?
শামছুল
করিম, শিলা, শায়লা বেগম সবাই খাওয়া বন্ধ করে বুবনের মুখের দিকে তাকিয়ে
আছে। এই বুবন যেন তাদের চেনা পরিচিত বুবন নয়। হঠাৎ যেন ওর বয়স অনেক অনেক
বেড়ে গেছে। কোন জবাবের অপেক্ষা না করে বুবন আবার বলল,
-আজ সন্ধ্যার পর
আমি দাদুর ঘরে গিয়েছিলাম। দাদু আমাকে ডেকেছিলেন। এখন বিজয়ের মাস বলে আমার
স্কুলে ‘মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান’ রচনা লিখতে দিয়েছে। এই
বিষয়ে দাদুর কাছে কিছু জানতে চাইলে দাদু আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনালেন।
ব্রিফকেস থেকে বের করে তার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দেখালেন। বললেন,
-তোমার তো তখন জন্মই হয়নি, দাদু যে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তুমি তা জানবে কী করে, তাই না বাবা?
বুবনের মুখ যেন আগ্নেয়জ্বালামুখ।
হঠাৎ করে গরল উদগীরণ হচ্ছে দফায় দফায়।
শামছুল করিমের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তার সাজানো-গোছানো শান্ত পৃথিবীটা যেন হঠাৎ দুলে উঠল। কী শুনছে সে এসব!
তার
বাবা সাজেদুল করিম মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? ওর ভাত মাখানো হাতটা কাপঁছে। কাঁপা
হাতেই গ্লাস নিয়ে জল খেতে গিয়ে বিষম খেলেন। দেখলেন, আসামির কাঠগড়ায়
অপরাধীর দিকে বিচারকের তাকিয়ে থাকার মতো বুবন তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে তার
দিকে।
বিষম খাওয়ায় শিলা উঠে এসে বাবার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। এই সময় শায়লার দিকে এক পলক দৃষ্টি বিনিময় করে শামছুল করিম জিজ্ঞাসা করলেন,
-তোর দাদু তোকে এসব বললেন?
বুবন যেন এবার উৎসাহের সঙ্গেই বলল,
-হ্যাঁ
আরও বললেন, এই সার্টিফিকেট আছে বলেই দাদুর চাকরির বয়স বেড়ে গেছে। আর তার
ছেলে হিসেবে তুমি, নাতি-নাতনি বলে আমি, শিলা, আমরা সবাই এখন থেকে সরকারি
চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, সরকারি জায়গা-জমি পেতে অনেক সুবিধা পাব। তাই
কী বাবা?
মিথ্যা অর্জনের লাভ এবং লোভের ফিরিস্তি শুনে শামছুল করিমের মুখ
দিয়ে আহ ! বলে কাতর ধ্বনি বেরিয়ে এল। বুবন চমকে ওঠে বাবার মুখের দিকে
তাকিয়ে রইল।
শিলা আবার তাড়াতাড়ি ওঠে গিয়ে বাবাকে এঁটো হাতে জড়িয়ে ধরল। শায়লা বেগম দ্রুত চেয়ার ঠেলে উঠতে উঠতে বুবনকে ধমকে দিলেন,
-থাম এবার! তোমার সবকিছুতেই বেশি বেশি। এত কৌতূহল কেন? বড়দের কথা না জানলে চলে না তোমার?
পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে বুবন কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করল। বলল,
-বারে,আমার কী দোষ? দাদুই তো নিজে থেকে সবকিছু...
বুবনের
ইতস্তত কৈফিয়তের মাঝপথেই খাওয়া ছেড়ে উঠে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতেই
মাঝপথে হরহর করে পেটের ভাতগুলো বমি করে দিলেন শামছুল করিম।
দুই.
অসম্ভব
বিরক্তি, অস্বস্থি আর হতাশায় নিমজ্জিত হতে হতে শামছুল করিম ডাইনিং টেবিলের
চেয়ার ছেড়ে কোনমতে ওয়াশ রুমে এলেন। বেসিনের কলটা ছেড়ে দিয়ে আবার ওয়াক ওয়াক
শব্দ তুলে বমি করলেন। রাতের খাবার পেটে যা ছিল তার সবই তেতো স্বাদ নিয়ে
গলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তাতে অস্বস্থির ভাবটা কিছুটা হালকা হলো।
কিন্তু হঠাৎ ধরে যাওয়া মাথার যন্ত্রণাটা মগজের মাঝখানে রয়ে গেল স্থির।
বেসিনে উপুর হয়ে শামছুল করিম ভাবতে চেষ্টা করলেন,
-তার কী হল হঠাৎ? বুঝলেন, শরীরটা এই মুহূর্তে তার আয়ত্তে নেই।
ধাতস্থ
হতে কিছুটা সময় লাগল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের মুখটা দেখলেন এস করিম।
অফিসের সংক্ষিপ্ত নাম। সামনের কাচে চোখে চোখ রেখে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন,
-এস’
মানে কী? মানে গাধা! গাধা করিম! গাধা না হলে কি কেউ বাপের কৃতিত্বে এমন
প্রতিক্রিয়া দেখায়! হোক না তা মিথ্যা। এখন তো চারদিকে মিথ্যারই জয়জয়কার।
কিন্তু শামছুল করিম যে অন্য ধাতের মানুষ।
কথাটা ভাবতেই তার রুচিতে, ব্যক্তিত্বে বাধছিল, কেন এই মিথ্যা অর্জনের বাহাদুরী? কেন?
বেসিনের
ওপরে ঝকঝকে পাতাবাহারের আয়নায় নিজের মুখটাকে করিমের অচেনা মনে হলো। এই মুখ
যেন তার প্রতিদিনের চেনা মুখ নয়। বিকাল, সন্ধ্যার কিংবা খাওয়ার টেবিলে
বসার আগমুহূর্তের হাসিখুশি চেনা মানুষের মুখটি আর নেই।
এখন সে রাগান্বিত ও ক্ষুব্ধ। তার চোখ লাল। তার কোন প্রেসার নেই, তবুও শরীরটা মৃদু মৃদু কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।
আধিভৌতিক কিছু দেখার মতো আয়নায় দেখলো,
নিজের
মুখের ওপর ওটা কার মুখ ? জন্মদাতা মিথ্যাচারি পিতার মুখের আদল না! এবং
এরকম মনে হলে পর শামছুল করিম ওহ, নো নো’ বলে বেসিনের ওপর কান্নায় ভেঙ্গে
পড়ে। বাইরে ওরা কেউ জানল না, ওয়াশ রুমের দরজার সিটকিনি লাগানো থাকায়
ছেলেমেয়ে, স্ত্রী কেউ করিমের এই যন্ত্রণার নাগাল পেলো না। ঝিমধরা শব্দ তুলে
এয়ারকুলার বাথরুমের ভিতরে একটানা চলছে। কান্না চেপে সে জোরে জোরে শ্বাস
নিল। বারবার গলনালি হয়ে মুখ অথবা নাক দিয়ে বের হতে যাওয়া বাতাস বুকের ওপর
থমকে দাঁড়াল। তাই বুক ভরে শ্বাস নিয়ে, পাকস্থলিতে বাতাসটাকে জমতে দিয়ে এই
ফাঁকে নিজেকে আবার দেখে নিল আয়নায়।
তারপর মনে মনে নিজেকে শোনাল,
-
শামছুল করিম,শুনে রাখো, তোমাকে সামনের দিনগুলোতে তোমার ভণ্ড, মিথ্যাচারি
জন্মদাতার পরিচয় দেওয়াটা খুব জরুরি কি-না- ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
আরও
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াশ রুম থেকে শামছুল করিম বেরিয়ে এসে
আর ডাইনিং টেবিলের দিকে গেল না। পানি খাওয়ার দরকার ছিল খুব। বেডরুমে ঢুকে
খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে রইল সে। শায়লা ঘরে ঢুকে ফ্যানটা
চালু করে দিয়ে স্বামীর কপালে হাত রাখলো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-খুব খারাপ লাগছে তোমার?
কথাটা
যেন বলার জন্যই বলা। শায়লা সবই জানে,বুঝে। ছোট্ট এই সংসারে যে কটি প্রাণ
আছে তাদের প্রত্যেকেরই নাড়ির গতি তার নখদর্পণে। তাই করিমের কষ্টের কারণটা
সে জানে। ওর কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে এনে সহমর্মিতায় পাশে বসে থাকে চুপচাপ।
কপালের ওপর থেকে শায়লার নরম ভেজা হাতটা সরে গেলে চোখ খুলে করিম তাকে ব্যাকুল প্রশ্ন করে,
-
তুমিও তো জান, বলতে পারো কেন আমার এই নিষ্পাপ শিশুটির কাছে এসব মিথ্যা
অর্জনের গালগল্প? বাহাদুরি আর ভণ্ডামীর আত্মতৃপ্তি? বুবনের দাদার কী এও
দ্বিধা হল না মিথ্যা বলতে? বুক কাঁপল না? তাহলে কে মিথ্যাবাদী?
আমার প্রয়াত দাদা-দাদি, না তাদের পুত্র সাজেদুল করিম ?
ওহ, ডিসগাষ্টিং!
তিন.
অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল শামছুল করিমের।
মাথার যন্ত্রণা নিয়ে শোয়ার পর থেকেই তার ঘুম হয়নি মোটেই।
মনের
মধ্যে ক্ষোভ টগবগ করে ফুটতে থাকলে ঘুম হয় কী করে! পাশে শোয়া শায়লা টের
পেয়েছে, ঘুমায়নি সেও। দেখেছে, কেবল এপাশ-ওপাশ করেছে মানুষটা। একবার শুনলো,
ঘুমের ভিতর বোবা ধরার মতো গোঙানির শব্দ। পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিতে
গিয়েও কী মনে করে পিঠের দিক থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে শায়লা।
শামছুল করিমের
নিঃশ্বাস নেয়ার বাতাসের অভাব হচ্ছিল যেন। গলার ভেতর থেকে গড় গড় আওয়াজটা
ভালো শোনাচ্ছিল না। শায়লা বুঝতে পারে, একটা অসহায় কষ্টের অতল অন্ধকার তার
এই বোবা কান্নার উৎস।
এ অবস্থায় এপাশ-ওপাশ করতে গিয়ে এক সময় গোঙানিটা থামল।
তারপর
আচমকা শোয়া থেকে উঠে বসল করিম, যেন দুঃস্বপ্ন দেখেছে। শায়লা দেখল, মশারি
তুলে খাট থেকে নেমে গিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকল স্বামী। দরজাটা খোলা রেখেই ঘাড়ে,
মুখে জল লাগিয়ে ঘরের মাঝখানে এসে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
এই কক্ষে তার বিছানায় যে আরও একটি মানুষ শুয়ে আছে সেই খেয়ালই যেন নেই!
ভূতের মানুষের ছায়ার মতো সে নীল আলোর ঘরটার মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। হাত দুটো পেছনে বাঁধা। কী যেন ভাবছে।
একবার এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়ে দক্ষিণের জানালাটা খুলে গ্রিলে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।
মানুষটার
এই যন্ত্রণাবোধ শায়লাকেও পোড়াচ্ছিল খুবই। মশারির ভিতর থেকে সে শামছুল
করিমকে নীরবে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। হেমন্তের এই সময়ে সিলিং ফ্যানটা শোয়ার সময়
মিনিমাম স্পিডে চলে। মৃদু বাতাস কাটার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
করিমের
বিছানায় ফিরে আসার কোন লক্ষণ নেই দেখে শায়লা খাট থেকে নেমে গিয়ে মানুষটার
পেছনে দাঁড়াল। টের পেয়ে করিম গ্রিল থেকে সরে এসে শায়লাকে নিবিড় করে কাছে
টেনে নেয়। এই সময় তারা দুজনেই তাদের পরস্পরের হৃদস্পন্দন অনুভব করে। শামছুল
করিমের অনুচ্চারিত কষ্ট শায়লার বুকের গভীরে নাড়া দেয়। ওর নিজের বাবার কথা
মনে পড়ে।
আলমডাঙ্গা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কন্যা সে। তার বাবাও
একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরে শিক্ষকতা পেশা নিয়েছেন। আজও তাই
করেছেন। সার্টিফিকেট নামক ছাপমারা কাগজের মূল্যে তিনি নিজেকে দলবাজির কাছে
বিকিয়ে দেননি। কোন বিনিময়ও কখনও গ্রহণ করেন নি। শায়লা তার বাবাকে বলতে
শুনেছে,
-স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী কিছু রাজাকার, আলবদর, আলশামস,
মুসলিম লীগার- এরা বাদে ভিতরে নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী বাঙালি আর বাইরে
সশস্ত্র বাঙালি সবাই ছিলো মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের আবার সার্টিফিকেট
কিসের? ভিতর থেকে সাহায্য না পেলে সেদিন মুক্তিবাহিনীর পক্ষে টিকে থাকা
কখনোই সম্ভব ছিল না। যে কারণে পাক বাহিনী এত শক্তিশালী হয়েও পর্যুদস্ত
হয়েছে। রাজাকাররা বাদে এদেশের কোন বাঙালি তাদের পক্ষে ছিল না। প্রকৃত
মুক্তিযোদ্ধাদের সনদের প্রয়োজন হয় না।
যুদ্ধের আগে পরে তারা সবসময়ই যোদ্ধা।
তাই সনদ দেখিয়ে কিছু পাওয়ার চেয়ে আমি দেশকে কী দিতে পেরেছি সেটাই বড় কথা।
আজকাল
বিভেদ, দলাদলি আর লোভের রাজনীতিতে নীতি ও আদর্শ পদদলিত হতে দেখে শায়লার ওর
বাবার নির্মোহ কথাগুলো প্রায় মনে হয়। বুবনের বাবাকে তার সততার জন্য তিনি
ভীষণ পছন্দ করেন। শায়লা ওর বাবার কথা ভাবছিল আর পরম আদরে শামছুল করিমকে
শান্ত হওয়ার জন্য প্রবোধ দিতে চেষ্টা করছিল। করিমও গড়িয়ে যাওয়া রাতের
নিস্তব্ধতায় নিজের ভেতরের ধুকপুক স্পন্দন শুনতে পায়। নিজেকে পরখ করতে করতে
একসময় ফয়সালার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। শায়লাকে বলল,
-শায়লা, তুমি
কষ্ট পেয়ো না। আমার বাবা সাজেদুল করিমের মিথ্যা গৌরবের কালো দাগ আমার কিংবা
আমার সন্তানের গায়ে আমি লাগতে দেব না। আমরা তার ছায়া থেকে যোজন যোজন
দূরত্বে চলে যাবো।
চার.
পরদিন সন্ধ্যার মুখে শেষ বাক্সটা ট্রাকের
পাটাতনে জায়গা নেয়ার পর শামছুল করিম গেটের বাইরে পাঁচটনি ট্রাকটার সামনে
দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো নিজেদের, মানে পিতৃদেব, পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত
সচিব সাজেদুল করিমের বাড়িটার দিকে তাকালো।
ট্রাকটার পাশে থেমে থাকা সাদা
রঙের একটা টয়োটাতে বুবন, শিলা ও শায়লা অপেক্ষা করছে। শামছুল করিমের রাতের
সিদ্ধান্তের কোন হেরফের নেই। নীতির প্রশ্নে সে ভীষণ জেদি। শায়লারা অনুগামী
মাত্র। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরের উদ্গত আবেগটাকে দমন করে গাড়িতে উঠে
ড্রাইভারকে গাড়ি ছেড়ে দেয়ার ইঙ্গিত দিল সে।
এর আগে অবশ্য বাড়িটা থেকে
বের হয়ে আসার সময় দোতলার ফ্লাটের চাবিটা শামছুল করিম নিজেই দিয়ে এসেছে তার
বাবার হাতে। পিতার সঙ্গে পুত্রের এ সময় বাক্যবিনিময় হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
বাক্য হলো কিন্তু বিনিময় হল না।
পিতার প্রশ্নে ক্ষুব্ধ পুত্র কোন জবাব
দিল না। বিপত্নিক সাজেদুল করিমও শক্ত ধাতের মানুষ। ছেলেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে
নেমে যেতে দেখলেন। বুবন, শিলা, বৌমা শায়লা-এরা কেউ যে উপরে বিদায় নিতে এলো
না তাতে মানুষটা অবাক হলো বটে। তবে হঠাৎ কারণটা ভেবে পেলেন না।
এক রাতের মধ্যে তাসের ঘর ভেঙ্গে এলোমেলো হয়ে গেলো।
ওরা
চলে যাওয়ার পর একটা শূন্যতা সাজেদুল করিমের মনের ভিতরটাতে নড়াচড়া করতে
লাগলো। অস্থিরতা কাটানোর জন্য সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় নেমে এলেন। চাবি দিয়ে
তালা খুলে দোতলার ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। ঘন্টাখানেক আগেও এখানে দুটো ছেলেমেয়ের
কোলাহল ছিল। ভরপুর সংসার ছিল, এখন কেউ নেই। বন্ধ ঘরের বাতাসে ধুলোর গন্ধ।
অন্যমনস্কভাবে দরজার মুখেই ড্রইং রুমের দিকে গেলেন। দেয়ালের দিকে তাকিয়েই
বুকের ভিতরটা ধক্ করে উঠল তার। এ কী দেখছেন তিনি!
অফ হোয়াইটের সাড়া দেয়াল জুড়ে তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা,
-‘তুমি
আমাকে সততার শিক্ষা দিয়েছ অথচ তুমি নিজেই অসৎ, ভণ্ড, মিথ্যাচারি! শাস্ত্রে
খারাপ পুত্রকে যদি ত্যাজ্য করার বিধান থাকে তাহলে মিথ্যাচারি পিতাকে নয়
কেন?