প্রস্রাবের
সংক্রমণে আক্রান্ত ভাতিজার চিকিৎসায় ২১ দিন ধরে এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল
ঘুরেছেন কুষ্টিয়ার দিলারা খাতুন। এর মধ্যে আটদিন থাকতে হয়েছে মগবাজারের
হেলথকেয়ার হাসপাতালে। শুক্রবার সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ির পথ
ধরতে গিয়েই তাদের ভোগান্তির শুরু; গাবতলীর যানবাহন খুঁজতে গিয়ে শুনলেন
গুলিস্তান থেকে বিআরটিসির বাস যায়।
ভাইয়ের স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে
অটোরিকশায় গুলিস্তান গিয়ে বাস না পেয়ে আবার অটোতে করেই ধরলেন গাবতলীর পথ।
কিন্তু তাকে ২০০ টাকার রাস্তায় ভাড়া গুণতে হয়েছে ৩৮০ টাকা।
এতো পয়সা খরচ করে গাবতলী পৌঁছে দেখেন, কুষ্টিয়া যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যাগ-বোচকা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষার শুরু হলো তাদের।
ফটো সাংবাদিকদের ছবি তুলতে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না গৃহিনী দিলারা, ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করলেন তিনি।
তিনি বললেন, “এই কষ্টের মানেই হয় না। আমরা এখন কীভাবে যাব, কী করব? এভাবে একের পর এক ভোগান্তি কেন?”
অন্যদের
অনুসরণ করে বাড়তি ভাড়ায় প্রাইভেটকারে পাটুরিয়ার পথ ধরবেন কি-না, তা নিয়ে
সন্দিহান ছিলেন ছোট শিশুকে সঙ্গী করে আসা এই দুই নারী।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জেরে পরিবহন ধর্মঘটে দিলারাদের মতো এভাবে ভোগান্তিতে পড়তে হয় বাড়িমুখী অনেক মানুষকে।
ঢাকার ভেতরে বাড়তি ভাড়া গুণে ব্যক্তিগত যানে টার্মিনালে পৌঁছতে পারলেও পরবর্তী পথ পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা তাদের অজানা।
পরিবহন
মালিক ও টিকেট কাউন্টারের ব্যবস্থাপকরা বলছেন, তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে
সঙ্গে ভাড়া না বাড়ানো পর্যন্ত তাদের ধর্মঘট চলবে। কেউ কেউ ইচ্ছামতো ভাড়া
বাড়ালেও ধর্মঘটের কারণে পরিবহন রাস্তায় নামাননি।
অনেকে টার্মিনালে এসে বাস না পেয়ে আবার বাসায় ফিরে গেলেও দিলারার ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা না থাকায় তাকে বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষা করতেই হয়।
শুক্রবার সকালে গাবতলী ও সায়েদাবাসের বাস টার্মিনাল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অলস সময় কাটাচ্ছেন কাউন্টারের কর্মীরা; কোনো হাঁকডাক নেই।
অন্যদিকে
বাইরের সড়কের চিত্র ছিল ভিন্ন। ভাড়ায়চালিত প্রাইভেট কারে চড়ে কিংবা
দুয়েকটা ট্রাক বা বাসে চড়ে গন্তব্যের পথ ধরছিলেন কেউ কেউ। উপায়ন্তর না পেয়ে
বাড়তি ভাড়া দেওয়ার কথাই জানিয়েছেন যাত্রীরা। গাবতলী থেকে পাটুরিয়া যেতে
প্রাইভেট কারে নেওয়া হচ্ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
অন্য রুটের দুয়েকটি বাস
যাত্রীদের নিয়ে পাটুরিয়া ঘাটের পথ ধরলেও ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল তিনগুণ। একশ
টাকার জায়গায় মৌমিতা ট্রান্সপোর্টে তিনশ টাকা ভাড়া নিতে দেখা যায়।
দুর্ভোগের
মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী বাস
টার্মিনালে আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মনিরুজ্জামান মুন্না।
ভাড়া
করা মটরসাইকেলে চেপে এই পর্যন্ত পৌঁছালেও পরবর্তী যাত্রা অজানা থাকার কথা
জানান তিনি। সরাসরি বাস না থাকায় ট্রাক করে যাওয়ার চিন্তা করলেও সেই যানও
সেই ব্যবস্থাও নেই তার সামনে।
বাস কিংবা প্রাইভেট কারে পাটুরিয়া গেলেও
পরে পথ কীভাবে পাড়ি দেবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তার। আরেকবার তিনি ভাবছেন,
যদি কমলাপুর গিয়ে রাতের ট্রেনে বাড়ির পথ ধরা যায়।
তিনি বলেন, “অনেক দিন পর বাড়ি যাচ্ছি। এসে দেখি এই অবস্থা। চিন্তা করতেছি, এভাবে যাব, নাকি আবার বাসায় চলে যাব।”
শাশুড়িকে
ফরিদপুরের বাস ধরে দিতে রাজধানীর পলাশী এলাকা থেকে গাবতলী আসেন একটি
সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। স্বামী অসুস্থ থাকার কারণে ষাটোর্ধ্ব এই নারীর
বাড়ি যাওয়া জরুরি।
কিন্তু গাবতলী পৌঁছে কোনো যানবাহন না পেয়ে নিরুপায়
অবস্থায় পড়ার কথা জানান ইমাম। একা শ্বাশুড়িকে প্রাইভেট কারে উঠিয়ে দিলে
পরবর্তীতে পাটুরিয়া ঘাটে গিয়ে কী অবস্থার মুখোমুখি হবেন, তা নিয়ে দুর্ভাবনা
তার।
বাসার পথ ধরার কথা জানিয়ে ইমাম হোসেন বলেন, “এখন বাসায় চলে যাব
ভাবতেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে যদি যাওয়া যায়” গাবতলীতে হানিফ
পরিবরহনের দক্ষিণবঙ্গ রুট কাউন্টারের মাস্টার কাউছার আহমেদ সাগর বলেন,
মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতাদের ডাকা ধর্মঘটের সমর্থনে তারা টিকেট বিক্রি করছেন
না। সকাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি।
“আমরা মালিকদের নির্দেশ মেনে চলছি, তারা সিদ্ধান্ত দিলে হয়ত বিকাল কিংবা তারপরে বাস চলতে পারে।”
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালেও নেই বাসকর্মীদের চেনা হাঁকডাক আর ব্যাগ নিয়ে যাত্রীদের গাড়িতে উঠানামার তাড়া।
ধর্মঘটের আগের রাতে মেহেরপুর থেকে ঢাকার সায়েদাবাসে এসে পৌঁছালেও ভৈরবে যাওয়ার কোনো উপায় করতে পারছিলেন না শিক্ষার্থী আজমল হোসেন।
অনেকক্ষণ
অপেক্ষা করে আর কাউন্টার থেকে কাউন্টারে ঘুরেও বিড়ম্বনায় থাকার কথা জানিয়ে
তিনি বলেন, “ভাবছিলাম কোনোমতে চলে যেতে পারব। কিন্তু কিছুইতো পাচ্ছি না।”
ঢাকা থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জ রুটে চলা মিতালী পরিবহনের সুপারভাইজার সাদেকুর রহমান বলেন, রাত থেকে তাদের গাড়ি চলছে না।
“ঢাকা থেকে সিলেটে যেতে ও আসতে ১৫০ লিটার ডিজেল লাগে। যার বর্তমান ১০ হাজার টাকার কাছাকাছি আর বর্ধিত মূল্যে লাগবে ১২ হাজার টাকা।”
৪৫
আসনের বাস হলেও গড়ে ৩০ জনের বেশি যাত্রী না পাওয়ার দাবি করে তিনি বলেন,
“জনপ্রতি সিলেটের ভাড়া ৩৫০ টাকা কিন্তু যাওয়া আসার এক খেপে ২০ হাজার টাকার
বেশি পাওয়া যায় না।
“সুতরাং চালক হেলপার আর আমার বেতন এবং পথে ঘাটে টাকা দিয়ে এমনিতেই মালিককে তেমন কিছু দিতে পারি না। আর বর্ধিত দামে কী দিতে পারব?”
শুক্রবার বাস না চললেও তেলের দাম বাড়ানোর পরপরই কোনো কোনো বাস কোম্পানি ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে।
কল্যাণপুরে
এসআর ট্রাভেলসের কাউন্টার মাস্টার আবদুল মোমিন বলেন, “রংপুরে ননএসি ভাড়া
৩৫০ থেকে ৩৮০ এবং এসি এক হাজার থেকে একশ বাড়ানো হয়েছে। শুক্রবার কোনো বাস
চলেনি।
“যারা আগে টিকেট কেটেছে, তাদের টাকা ফেরত দিচ্ছি আমরা বা একই টিকিটে পরে ভ্রমণের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।”