মো. হাবিবুর রহমান, মুরাদনগর ||
কুমিল্লার মুরাদনগরে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে চলছে মাটি কাটার মহোৎসব। এতে বিলীন হচ্ছে উপজেলার তিন ফসলি জমি। উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক ড্রেজার দিয়ে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন করছে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী চক্র। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় অর্ধ-শতাধিক জমির মালিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর অভিযোগ করেও কোন ফল হচ্ছে না। উল্টো ড্রেজার ব্যবসায়ী চক্রের কাছে জিম্মি জমির মালিকরা।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযানে বের হলে ঘটনাস্থলে পৌছাঁর আগেই টের পেয়ে যায় ড্রেজার ব্যবসায়ীরা। যার ফলে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদেরকে পাওয়া যায়না। অভিযান শেষে ফিরে আসার ঘন্টা পার না হতেই আবারো পুরো দমে চলে মাটি উত্তোলন। ফলে স্থানীয়দের মুখে এখন একটাই শব্দ অভিযান কি শুধু লোক দেখানো?
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ৩১২টি গ্রামের মধ্যে প্রায় দু’শতাধিক গ্রামের কোন না কোন স্থানে ড্রেজার মেশিন চলে। মাইলের পর মাইল পাইপ সংযোগ দিয়ে ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে কোথাও ফসলি জমি আবার কোথাওবা পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। বর্তমানে অবৈধ ড্রেজিংয়ের কারণে ৫০/৬০ ফুট গভীর থেকে মাটি ও বালি উত্তোলনের ফলে আশ-পাশের তিন ফসলের জমিগুলো পরিনত হচ্ছে কূপে।
উপজেলার মুরাদনগর সদর ইউনিয়নের ইউসুফনগর গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, প্রশাসনের লোকজন আসার আগেই কিভাবে যেন তারা টের পায়। পরে মেশিনপত্র বন্ধ করে চলে যায়। পরক্ষণে প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে তারা আবারো মাটি কাটার উৎসবে মেতে ওঠে। হুনছি সবাই নাকি থানা ও ভূমি অফিসের লোকজনেরে টাকা দিয়া ড্রেজার চালায়। গণমাধ্যম কর্মীদের নিকট তাদের দু:খের কথা বলতে গিয়ে অনেক কৃষক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
তারা আরো বলেন, এই ইউনিয়নের মধ্যেই প্রায় ২০টি ড্রেজার বসিয়ে গভীর ভাবে মাটি কাটার কারনে তাদের তিন ফসলী জমি ড্রেজিং গর্তে বিলীন হয়ে গেছে। কেউ ইচ্ছা করে জমি দিতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত ড্রেজার মালিকদের নিকট কমমূল্যে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সাধারণ কৃষক। ড্রেজার সিন্ডিকেটরা জমির মালিকদের বিভিন্ন ভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখে এবং রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভংগায়।
ড্রেজার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, সবাই মনে করে আমরা ড্রেজার চালাইয়া কতটাকা জানি কামাইতাছি। আসলে প্রতি মাসে ড্রেজার প্রতি থানায় দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। অপর দিকে ভূমি অফিসের লোকজন আসলেই তাদের কে দিতে হয় টাকা সব মিলিয়ে নানান জায়গায় টাকা দিয়ে আমাদের বেশি একটা লাভ হয় না।
সচেতন মহলের লোকজন বলছে, পুলিশ চাইলে ড্রেজার ব্যবসায়ীদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করতে পারে। যেহেতু এটি একটি ফৌজদারী অপরাধ। কিন্তু ড্রেজার ব্যবসায়ী ও পুলিশের মধ্যে চোর-পুলিশ খেলাটা সকলের মধ্যে এখন সন্দেহের কারণ। কেননা পুলিশ আসার আগেই ড্রেজার ব্যবসায়ীরা খবর পেয়ে যায়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমান ২৪ হাজার ২৯৩ হেক্টর। এর মধ্যে বেশীর ভাগই দুই থেকে তিন ফসলী জমি। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অনাবাদী রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহম্মেদ সোহাগ দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে বলেন, আমি উদ্ধিগ্ন ও আতংকিত। কেননা তিন ফসলি জমির টপসয়েল্ট (উর্ভর মাটির উপরের অংশ) ব্যাপক হারে কেটে নিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে চাষাবাদের জন্য একখন্ড জমি থাকবে না। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কড়া ভাবে নিষেধাজ্ঞা আছে জমির মাটি কেটে নিয়ে অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
মুরাদনগর থানার ওসি আবুল হাসিম দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে বলেন, আমি এই থানায় এসেছি মাত্র কয়েকদিন হয়। ড্রেজার থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি আসার পূর্বে যদি কেউ নিয়ে থাকে আমি তারও খোজ খবর নিচ্ছি। যদি প্রমান পাই তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এসব অবৈধ ড্রেজার বন্ধে খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুমাইয়া মমিন দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে বলেন, ভূমি অফিসের কোন কর্মকর্তা ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এ বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কারও বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ পাই, তাহলে অবশ্যই ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমি আসার পরে এখন পর্যন্ত যেখান থেকেই ড্রেজারের অভিযোগ এসেছে সেখানেই অভিযান পরিচালনা করেছি। এটি বন্ধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। আর অবৈধ ড্রেজার বন্ধে আমাদের অভিযান সবসময় অব্যাহত আছে।