জুলফিকার নিউটন ।।
৫
পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার আত্মপ্রকাশের ভাষা আছে। মানুষ অর্থবহ ধ্বনি উচ্চারণ করে এবং আপন অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থায় এই সমস্ত ধ্বনির অর্থ চিহ্নিত হয়েছে এবং যুগ যুগ ধরে তা মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্মাণে সহায়তা করেছে। মানুষ যে শব্দ উচ্চারণ করে তার মধ্যে ইঙ্গিতময়তা আছে, বিশ্বাস আছে, অঙ্গীকার আছে, অহমিকা আছে এবং নিজেকে প্রকাশ করবার আবেদন আছে। প্রথম মানুষ হযরত আদমকে আল্লাহতায়ালা নির্মাণ করেছিলেন, তাঁকে তিনি ভাষা দিয়ে, পূর্ণ জ্ঞান দিয়ে নির্মাণ করেছিলেন। তাঁকে আল্লাহতায়ালা সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বস্তুর নাম শিখিয়েছিলেন। এই সমস্ত নামের অধিকারে সম্পূর্ণ মানব হয়ে আল্লাহতায়ালার হাতে তিনি যখন গঠিত হলেন তখন আল্লাহতায়ালা সকল ফেরেশতাকে তার সামনে প্রণত হতে বললেন। সকল ফেরেশতা প্রণত হলো, একমাত্র ইবলিশ ছাড়া। ইবলিশ গর্ব করে বলল যে, সে হচ্ছে আগুনের তৈরি এবং আদম হচ্ছেন মাটির তৈরি, সুতরাং মাটিতে প্রস্তুত কোনো পদার্থের কাছে অগ্নি কখনও নতি স্বীকার করতে পারে না। কিন্তু ইবলিশ আদমের সৃষ্টি-রহস্যের মূল তত্ত্বটি অনুধাবন করতে পারেনি। আদম সকল নামের অধিকারী হয়েছিলেন। অর্থাৎ জ্ঞাত-অজ্ঞাত সকল ভাষার সারাৎসার তিনি লাভ করেছিলেন। আদমের এই ভাষাজ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে আমরা মাতৃভাষার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি।
মাতৃভাষার সাহায্যে মানুষ সকল বস্তুর নাম উচ্চারণ করে, পার্থিব সকল বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে এবং অপার্থিব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে। একটি পাখি তার চঞ্চুতে তার উচ্চারণকে ধরে রাখে, তেমনি একটি মানুষ তার ওষ্ঠে শব্দকে ধারণ করে। তাই এজরা পাউন্ড বলেছেন, “ভাষা হচ্ছে ওষ্ঠলালিত জীবনের কাকলী।” ভাষার কোনো অপচয় নেই, ভাষা কখনও নিঃশেষ হয় না, ভাষা চিরকাল জাগ্রত থাকে। পাখির কলকাকলী যেমন রুদ্ধ করা যায় না, ভাষার কলকণ্ঠও তেমনি অবিনশ্বর। সময়েঅসময়ে, আঘাতে-প্রতিঘাতে, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ভাষা প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ ভাষা হচ্ছে। মানুষের অস্তিত্বের স্মারক; মানুষের অস্তিত্বকে ধারণ করে রাখে ভাষা। সে যে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত, চিত্রিত এবং বিকশিত তার প্রমাণ আমরা পাই তার ভাষার মধ্য দিয়ে। অন্য প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য এখানে যে, মানুষের প্রশ্ন আছে, এবং আপন অস্তিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা আছে। এই জিজ্ঞাসাটি ভাষার সাহায্যে রূপ লাভ করে। একটি প্রস্তর খণ্ডের অবস্থান আছে, যে অবস্থানকে বিশ্লেষণ করা যায়, একটি বৃক্ষের বিকাশ আছে যা আবিষ্কার করা যায়, একটি প্রাণীর বোধ আছে যে বোধের প্রতাপে সে জীবন্ত থাকে। কিন্তু একজন মানুষের এ সমস্ত কিছুর অতিরিক্ত একটি জিজ্ঞাসা আছে যা কখনই বিশ্লেষণ করা যায় না। এই জিজ্ঞাসা একমাত্র রূপ লাভ করে ভাষার সাহায্যে। এই জিজ্ঞাসাই মানুষকে তার অস্তিত্বের তাৎপর্য দিয়েছে, বিশ্বাসের অনুভূতি দিয়েছে এবং আনন্দের অভিজ্ঞান দিয়েছে।
আল্লাহতায়ালা যখন পয়গম্বরের কাছে তার বাণী প্রেরণ করেছেন তখন সে বাণী প্রেরিত হয়েছে তার মাতৃভাষায়। মহান প্রভু একটি বিশেষ ধরনের অলৌকিক বাণী নির্মাণ করে পয়গম্বরদের কাছে পাঠাননি। যে ভাষার মধ্যে একজন পয়গম্বরের জন্ম, সেই ভাষার মাধ্যমেই তার কাছে আল্লাহর নির্দেশ এসে পৌঁছেছে। হযরত মুসা (আ:) যখন তুর পাহাড়ে আল্লাহর দীদার লাভের উদ্দেশ্যে গেলেন, তখন আল্লাহতায়ালা মুসার ভাষাতেই মুসার সাথে কথা বলেছিলেন। রাসূলে খোদা (স:) যখন হেরা গুহায় তপস্যারত ছিলেন তখন আল্লাহর যে বাণী ফেরেশতা নিয়ে এসেছিলেন, সে বাণী এসেছিল রাসূলে খোদার নিজস্ব ভাষায়। ফেরেশতা তাঁকে বলেছিলেন তুমি পাঠ কর।' রাসূল (স:) উত্তরে বলেছিলেন, 'আমি তো পাঠ করতে পারি না। অবশেষে ফেরেশতা তাঁকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন, তখন তিনি পাঠ করলেন মহান প্রভু আল্লাহর নামে। রাসূলে খোদার নিজস্ব ভাষার পরিশুদ্ধ উচ্চারণে আল্লাহর বাণী তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছিল এবং তিনি বিশ্ব মানবের জন্য চিরকালের সাক্ষ্যস্বরূপ এই বাণীকে রেখে গেছেন। অর্থাৎ বিশ্ব প্রভুর মহত্তম বাণী রাসূলের মাতৃভাষায় রাসূলের কাছে নাজিল হয়েছিল। তাঁর মাতৃভাষা এই শুদ্ধতম বাণীকে বহন করেছিল এবং অনন্তকাল ধরে বহন করে চলেছে। একথার তাৎপর্য এই যে, মাতৃভাষা হচ্ছে মানুষের পবিত্রতম এবং শ্রেষ্ঠতম অবলম্বন। এই ভাষার মধ্যে আমরা অঙ্কুরিত হই, এই ভাষার মধ্যে আমরা সর্বদা প্রবাহিত থাকি, এই ভাষায় আমাদের অস্তিত্ব স্বাক্ষরিত হয়।
বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষা আমাদের জাগ্রত চৈতন্যের ভাষা, আমাদের অতীতের ইতিহাসের ভাষা, আমাদের ভবিষ্যতের আনন্দ, অনুজ্ঞা এবং প্রত্যয়ের ভাষা। এ ভাষার বিরুদ্ধে যখন আঘাত এসেছিল তখন সংঘবদ্ধ হয়ে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।
আমাদের প্রতিবাদটা ছিল অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিবাদ। একটি জাতি তার ভাষাকে হারিয়ে ফেললে সে অস্তিত্বহীন হয়। এই অস্তিত্বহীনতা থেকে মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম করেছিলাম। এদেশের মানুষ ফারসি ভাষা শিখেছে, আরবি শিখেছে, ইংরেজি শিখেছে। কিন্তু এদেশের মানুষ আপন অস্তিত্বের সর্বস্ব নিয়ে বাংলা ভাষার মধ্যে বর্ধিত হয়েছে। এই ইতিহাসটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এক সময় লিখেছিলাম, শব্দের অর্থ কবিরা নির্মাণ করেন না, আবিষ্কার করেন ভাষাকে আমি আমার জাতির চৈতন্যোদয়ের কুশল সম্ভাষণ বলে মনে করি। যেমন আমাদের ত্বক, শরীরের সঙ্গে স্বাস্থ্য, জীবন ও স্পর্শের অনুভূতি নিয়ে সংলগ্ন, তেমনি আমাদের ভাষা আমাদের, জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে বিজড়িত। জার্মান ভাষায় যাকে বলা হয়, তার চঞ্চুর মধ্যে যেভাবে গড়ে উঠেছে, ভাষা সেভাবেই জাতির ওষ্ঠ লালিত জীবনের কাকলী। শব্দ তার শিকড় নিয়ে, পারিপার্শ্বিক পরিচয় নিয়ে এবং সর্বযুগের ব্যবহারের স্মৃতি নিয়ে একজন কবি’র কাছে অনবরত আবিষ্কার হতে থাকে।
শব্দ হচ্ছে দাবা খেলার গুটি। একটি বিশেষ মুহূর্তে জাতির স্মৃতিতে যতগুলো শব্দ আছে তা নিয়ে তার বহু বিচিত্র কথার খেলা। নতুন শব্দ যোগ করা চলে না, পুরাতন শব্দকে অস্বীকার করা যায় না। আমরা আয়ত্তগত শব্দের সামগ্রীকে অনবরত নব নব বিন্যাসে নতুন নতুন উপলব্ধির স্মারক করে তুলি।
কোনো একটা বস্তুর নাম যখন আমাদের জাগে, তখন সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো বিশ্লেষণ নিয়ে নামটি উদ্ভাসিত হয়। এভাবে শব্দার্থের ব্যপ্তি এবং পরিমাপ সংবেদনশীল মনের কাছে সর্বমুহূর্তেই ধরা পড়েছে। এ ব্যপ্তি এবং পরিমাপের মধ্যে দুটি বিপরীতধর্মী বিশ্লেষণ অর্থ প্রসারের দুই প্রান্ত নির্ধারিত করে। যখন আমি রমণী’ শব্দটি উচ্চারণ করি তখন সে নামটিকে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ করি। শব্দার্থের কৌশল নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেছেন তারা বলেন প্রতিটি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাতটি পর্যায়ক্রম আছে। যেমন অত্যন্ত সুন্দরী রমণী, সুন্দরীও নয় অসুন্দরীও নয় এমন রমণী, কুৎসিত রমণী, বেশ কুৎসিৎ রমণী, অত্যন্ত কুৎসিৎ রমণী। এভাবে অন্যান্য বিশ্লেষণ দিয়েও মোটামুটি সাতটি পর্যায়ক্রমের মধ্যে নামটিকে আলোড়িত করা যায়।
আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি সে পৃথিবী হচ্ছে বিজ্ঞানের এবং পর্যাপ্ত সামগ্রীর। আমাদের সমস্ত কর্ম ও উপলক্ষ এ পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েই মূল্যবান হয়। অজস্র ইচ্ছা এবং প্রয়োজনের যে সম্ভারে আমরা প্রতিদিন বেঁচে থাকি আমাদের দৃষ্টির দ্বারা তারা সর্বদাই চিহ্নিত হচ্ছে। তাই আমরা যখন শব্দে আমাদের সকল ইচ্ছা এবং প্রয়োজনকে তুলে ধরবার চেষ্টা করি তখন বোধকে দৃষ্টির সীমায় টেনে আনি। দৃশ্যগোচর হয়ে কোনো বস্তুই উপলব্ধির সম্পদ হতে পারে না। তাই দৃশ্যগোচরকেই আমরা দেখি না, অদৃশ্যকেও আমরা দেখি, শ্রুতিগ্রাহ্যকেও আমরা নয়নে নির্ণয় করি।
সমাজ হচ্ছে শব্দ-বৈচিত্র্যের লীলাভূমি। মানুষের অনবরত সংলাপ, জিজ্ঞাসা, ইচ্ছা, অহমিকা, বেদনা প্রতিদিন উচ্চারিত ধ্বনিকে ইঙ্গিতবহ করছে। আমরা যদি কখনই আমাদের কর্মে ও ইচ্ছায় সমাজবিমুখ হই, তাহলেও সমাজ আমাদের অনুসরণ করবে ভাষা হয়ে; কখনও জাগরণে কখনও স্বপ্নে। শব্দ চিরকাল সমাজ ও সভ্যতার স্মৃতিকে ধারণ করে আছে, শব্দ হচ্ছে একটি জাতির ইতিহাস এবং বিবেকের সাড়া। যিনি চিরকাল আকাশে শব্দ ছড়াতে চান তিনিও তার শব্দকে মানব সমাজের চেতনার আড়ালে নিতে পারেন না। প্রতিদিনের গতিবিধিতে যতটা অঞ্চল আমরা পরিক্রমণ করি শব্দরূপে আমাদের ইচ্ছাগুলো তার চেয়েও অধিক অঞ্চল পরিক্রমণ করে। কিন্তু যেহেতু তা শব্দরূপে এবং যেহেতু শব্দ সকল মুহূর্তেই সমাজের অনুভূতির উত্তাপ, তাই আমাদের সকল ইচ্ছা, কল্পনা ও স্বপ্ন আমাদের সমাজ এবং সভ্যতার উৎপ্রেক্ষা মাত্র। আমরা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমাদের আপনাপন ভাষায় কথা বলি, সর্ব প্রকার মনোভাব প্রকাশ করি। কখনও উষ্ণ কখনও স্থিরতাকে শব্দে নির্ণয় করি। কিন্তু এ সমস্ত কিছুই সাধারণভাবে ঘটে, শব্দ ব্যবহারটি আমাদের পরীক্ষা অথবা বিচার-বিবেচনার আয়ত্তে আসে না। এ কারণেই এজরা পাউন্ড বলেছিলেন, একটি পাখির চঞ্চুতে তার নিজস্ব ধ্বনি যেভাবে গড়ে ওঠে, একজন মানুষের ওষ্ঠে তেমনি তার মাতৃভাষার শব্দ গড়ে ওঠে। পাউন্ডের ভাষায় ‘মাতৃভাষা হচ্ছে ওষ্ঠলালিত জীবনের কাকলী।' কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমরা বড় হয়ে ক্রমান্বয়ে ভাষাকে বিবেচনার আয়ত্তে আনি এবং পরীক্ষা করে জানতে চাই। কখন কিভাবে ভাষাকে আমরা প্রয়োগ করি। এভাবেই ব্যাকরণ সৃষ্টি হয়েছে, ভাষার রীতিনীতি বিধিবদ্ধ হয়েছে।
যে ভাষাকে আমরা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ব্যবহার করি, স্বপ্নে যে ভাষার সাহায্যে আমাদের চিত্তলোক জাগ্রত হয় এবং প্রার্থনায় স্বস্তি পাবার জন্য যে মাতৃভাষাই আমাদের যথার্থ অবলম্বন, সেই ভাষাকে বিশুদ্ধ এবং সুন্দরভাবে প্রয়োগ করার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। প্রতিদিনের দৃশ্যমান বস্তু দৃশ্যে যেমন ধরা পড়ে না তেমনি প্রতি * মুহূর্তের উচ্চারণ নিয়ে আমরা বড় একটি ভাবি না। কিন্তু ভাবতে হয় কেননা তা না হলে জীবনকে অর্ঘ্যদান করা যায় না। মানুষ যখন সাহিত্য সৃষ্টি করে, যখন কবিতা লেখে বা গল্প লেখে, তখন ভাষাকে সে আবিষ্কার করতে চায়। এই ভাষাকে আবিষ্কার করতে গিয়ে । আমরা একদিন আমাদের স্বদেশকে পেয়েছি, এখন আমাদের চেষ্টা হবে এ ভাষার মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয়কে পেতে। আমরা আমাদের ভাষার সৌন্দর্যের মধ্যে আমাদের হৃদয়কে আবিষ্কার করবো।