ব্যাংকের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। একইভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের ঋণও দিচ্ছে। তবে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আগের মতো ঋণ দিতে পারছে না। শুধু তাই নয়, দেশের নয়টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মাত্র পৌনে তিন বছরেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করার কারণে প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে সংকটে পড়ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মোটা অঙ্কের অর্থ আটকে রয়েছে। এগুলোর বিপরীতে কোনও আয় হচ্ছে না। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের রাখা আমানত সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। এ কারণে আগের মতো আর আমানতও আসছে না।
কমছে আমানত
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাখা সরকারি ও বেসরকারি সব খাতের আমানত কমেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৪৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে আমানত কমেছে ৫৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শুধু তাই নয়, ৩৪টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আর্থিক সংকটে পড়েছে ১১টি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতকারীদের অর্থ সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। এ কারণে গ্রাহকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অনাস্থা। বিভিন্ন সূচকেও দেখা দিয়েছে নেতিবাচক অবস্থা ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন খাতে আটকে গেছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। ওইসব অর্থ থেকে কোনও আয় হচ্ছে না। যদিও বেড়েছে ব্যয়।
সার্বিক ঋণ পরিস্থিতি:
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সেপ্টেম্বরে ঋণ বিতরণের স্থিতি ছিল ৫৫ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুন থেকে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে ১৫ দশমিক ০১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেতিবাচক হয়েছে ১৫ দশমিক ০৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর খেলাপি ঋণ বেড়ে ১০ হাজার ২৫০ কোটি দাঁড়ায়, যা মোট ঋণের সাড়ে ১৫ শতাংশ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা আরও বেড়ে ১০ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা হয়েছে, যা মোট ঋণের প্রায় ১৬ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহকদের বিনিয়োগ হিসাবও কমেছে। গত মার্চে ঋণ হিসাব ছিল ১ লাখ ৯২ হাজারটি। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪০০তে দাঁড়িয়েছে।
সবচেয়ে বেশি খেলাপি যেসব প্রতিষ্ঠানে:
৭টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের ৮২ শতাংশই রয়েছে ৭ প্রতিষ্ঠানে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৫ শতাংশ।
এফএএস ফিন্যান্সের ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্সের ৮০০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৬ শতাংশ।
প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬২ শতাংশ।
ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ৪৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫০ শতাংশ।
ফার্স্ট ফিন্যান্সের ২৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩২ শতাংশ।
পিপলস লিজিংয়ের ৭৮৮ কোটি টাক, যা মোট ঋণের ৬৮ শতাংশ।
এছাড়া বাকি ২৬টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা । অর্থাৎ বাকি ১৮ শতাংশ ২৬ প্রতিষ্ঠানে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেশ কয়েকটি নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসনের অভাব আছে। নজিরবিহীন দুর্নীতির মাধ্যমে আমানতকারীদের অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। এখন গ্রাহকদের রাখা আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এ কারণে গ্রাহকরা নতুন আমানত রাখা কমিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতি ও উদাসীনতাকেও দায়ী করেন তিনি।