ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
গুণগত মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিকল্প নেই
Published : Tuesday, 18 January, 2022 at 12:00 AM
প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী ||
সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুতায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করা আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে ছিল মাত্র পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর বিপরীতে সাত হাজার ৫০০ থেকে আট হাজার মেগাওয়াট সরবরাহের বিরাট ঘাটতির চ্যালেঞ্জ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা, সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং পাওয়ার সেক্টরের দক্ষ প্রকৌশলীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাস্তবায়িত হয়েছে। উপরন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, শিল্পায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বিদ্যুেকন্দ্রের সংখ্যা এবং উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আর্থিক সংস্থান বিষয়টি ছিল সরকারের জন্য অতীব কঠিন বিষয়।
ঠিক ১১ বছর পর বর্তমানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছে। ২০২২ সালে জনসংখ্যা এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে মাথায় রেখে আমরা আমাদের চাহিদার (১২ হাজার মেগাওয়াট) প্রায় দ্বিগুণ (২২ হাজার মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছি, যা নিঃসন্দেহে গোটা জাতির জন্য গর্বের। ১.০২৫ কোটি থেকে বর্তমানে গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪.১৫ কোটিতে। প্রত্যন্ত চরাঞ্চল, বিরান বনভূমি থেকে শুরু করে প্রতিটি পার্বত্য জেলায় পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ, যা একসময় চিন্তাও করা যেত না। এত আয়োজনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার এখনই সময়। সেটা হচ্ছে ‘গুণগত মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ’ (ঝঁঢ়ঢ়ষু ড়ভ ছঁধষরঃু ঊষবপঃৎরপরঃু)। যার ভোল্টেজ, ফ্রিকোয়েন্সি, ওয়েভফর্ম, ফেস সিকোয়েন্স সেই বিদ্যুতের জন্য অনুমোদিত মাত্রা অনুযায়ী সঠিক থাকবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিদ্যুেকন্দ্রে যে উচ্চ গুণগত মান এবং স্পেসিফিকেশনে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, গ্রাহকের কাছে সেই মানের বিদ্যুৎ পৌঁছাচ্ছে না। জাতীয় গ্রিড এবং ট্রান্সমিশন লাইনে নানা রকম  উরংঃড়ৎঃরড়হ ঋধপঃড়ৎ (ংধয়, ংবিষষ, ড়াবৎাড়ষঃধমব, ঁহফবৎ াড়ষঃধমব, ঋৎবয়ঁবহপু ঠধৎরধঃরড়হ, ঐধৎসড়হরপ উরংঃড়ৎঃরড়হ)
-এর প্রভাবে যেই উবারধঃবফ ঢ়ড়বিৎ আমরা ব্যবহার করছি, এতে বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। খরচ বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহের প্রতিটি ধাপে ব্যবহৃত ইকুইপমেন্টগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে আগামী ২০২৪ সাল নাগাদ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে। পারমাণবিক উৎস থেকে তৈরি বিদ্যুৎ স্পেসিফিকেশন ও আদর্শ গুণগত মানসম্পন্ন। ওই ব্যবস্থাপনাকে গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হলে আমাদের গ্রিডকে এবং সংযুক্ত উপকেন্দ্রগুলোকেও পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের আউটপুটের সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করতে হবে। গুণগত মানসম্পন্ন বিদ্যুতের কার্যকারিতা অনেক। যেমন—১. গুণগত মানসমপন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রত্যেক একক গ্রাহক অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হবে। ২. এই বিদ্যুৎ সর্বোচ্চ নিরাপদ। ট্রান্সমিশন, ডিস্ট্রিবিউশন, রিসেপশন প্রতিটি পর্যায়ে প্রযুক্তি এই বিদ্যুৎ ব্যবহারের কারণে যেকোনো ধরনের কারেন্ট ও ভোল্টেজ সম্পর্কিত দুর্ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, ফলে প্রতিটি মেশিনের স্থায়িত্বকাল আরো দীর্ঘায়িত হবে। ৩. মেশিনের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক কমে আসবে। ৪. সর্বোপরি দেশের কলকারখানায় ব্যবহৃত ক্যাপটিভ পাওয়ার তথা জেনারেটরের প্রয়োজন থাকবে না। ক্যাপটিভ পাওয়ার বা জেনারেটরের ওপর নির্ভরতা বিপুল হারে হ্রাস করে এই বিদ্যুৎ এবং একই সঙ্গে ডিজেল ও গ্যাসের চাহিদাকেও ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে আনবে।

বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রসার ঘটছে। ট্রান্সফরমেশন, ট্রান্সমিশন, ডিস্ট্রিবিউশন (সঞ্চালন), প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ডিজাইন স্পেসিফিক প্যারামিটারের সামঞ্জস্য রেখে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট পাওয়ার সেক্টরের ওপরই দায়িত্ব বর্তায়। উৎপাদিত বিদ্যুতের মান উন্নয়নে আমরা যেসব প্রযুক্তির সাহায্য নিতে পারি সেগুলোর মধ্যে ডাইনামিক ভোল্টেজ রিস্টোরার (উঠজ), ফ্লাইহুইল মোটর-জেনারেটর, কন্ট্রাক্টর কয়েল, ফেরোরেজোনেন্ট ট্রান্সফরমার, স্ট্যাটিক ভার (ঠঅজ-াড়ষঃ ধসঢ় ৎবধপঃরাব) কমপেনসেটর, স্ট্যাটিক ট্রান্সফার সুইচ (ঝঞঝ), ফ্রিকোয়েন্সি স্টেবিলাইজার-স্মার্ট গ্রিড, স্ট্যাটিক সিনক্রোনাস কম্পেনসেটর  (ঝঞঅঞঈঙগ), থাইরিস্টোর কন্ট্রোল্ড সিরিজ কম্পেনসেটর  (ঞঈঝঈ) বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এসব প্রযুক্তির যেগুলো আমাদের গ্রিডে এরই মধ্যে চালু সেগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, ক্যালিব্রেশন এবং আপডেট করতে হবে। যেসব প্রযুক্তি আমাদের নেই, অতিদ্রুত সেগুলো পর্যাপ্ত পর্যালোচনা করে অপারেশনে নিয়োজিত করতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়নের শিখরে অবস্থান করছে, যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত প্রতিটি সেক্টরে উন্নতির ধারা ক্রমবর্ধমান। মেট্রো রেল, পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, ইকোনমিক জোনসমূহ, বঙ্গবন্ধু টানেল—এসব এখন বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে, যেগুলো একসময় আমরা কল্পনা করতেও সাহস পেতাম না। উন্নয়নশীল বাংলাদেশ থেকে উন্নত বাংলাদেশে আরোহণের অনেক ধাপ বাংলাদেশ অতিক্রম করে যাবে এই প্রকল্পগুলোর হাত ধরে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে, যদি আমরা দেশের প্রতিটি কোনায় পৌঁছে দিতে পারি মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ। হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, যদি আমরা এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করি এখনই।

লেখক : চেয়ারম্যান, টাস্কফোর্স অন পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সেক্টর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) সড়যধসসধফধষর.পরঃরুবহ@মসধরষ.পড়স