অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
দেশে
করোনার প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ২০২০ সালের ৮ই মার্চ। গত বছর ৩১ আগস্ট
পর্যন্ত তা ১৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে
২০২১ সালের ২৮ জুলাই দেশে রেকর্ড পরিমাণ ১৬ হাজার ২৩০ জন নতুন রোগী সনাক্ত
হয়। প্রথম সনাক্তের ১০দিন পর ২০২০ সালের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য
নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত বছর ৮ ডিসেম্বর করোনায় মোট মৃত্যু ২৮
হাজার ছাড়িয়ে যায়। তার আগে ৫ ও ১০ আগস্ট ২৬৪ জন করে মৃত্যুর খবর আসে। যা
মহামারির মধ্যে একদিনের সর্বোচ্চ সংখ্যা। বিশ্বে করোনা ভাইরাসে মৃতের
সংখ্যা ইতিমধ্যে ৫৫ লক্ষ ৫৫ হাজার ছাড়িয়েছে। আর সনাক্ত হয়েছে ৩০ কোটি ৭২
লক্ষেরও বেশি রোগী।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন “আমরা ঢাকায়
করোনা সনাক্তে যে নমুনা পরীক্ষা করেছি, তার জিনোম সিকুয়েন্স করেছি, তাতে
দেখা গেছে ওমিক্রন আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৬৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যেটা আগে
১৩ শতাংশ ছিল। আমরা গত ১০ দিনের মধ্যে এই তথ্য পেয়েছি। আমরা মনে করি ঢাকার
বাইরেও একই হার হবে।” এর আগে গত ১২.০১.২২ইং এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী
বলেছিলেন, করোনা আক্রান্তদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশই করোনা ভাইরাসের নতুন
ভেরিয়েন্ট আক্রান্ত। ঐদিনই ঢাকার বাইরে প্রথম ওমিক্রন আক্রান্তের খবর দেয়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১৭ জানুয়ারি সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সচিবালয়ে বলেন,
“আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ায় সরকার চিন্তিত। এ কারণে সবাইকে
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ডেল্টা ও ওমিক্রনের সংক্রমণের মাত্রা
উর্ধমুখী। এনিয়ে আমরা কিছুটা হলেও চিন্তিত, আতঙ্কিত। গত ১৫ দিনে ১৮ শতাংশে
চলে এসেছে সনাক্তের হার। যেভাবে বাড়ছে তাতে সনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়াতে
বেশি সময় লাগবে না।” হাসপাতালে রোগীর চাপ আবার বেড়ে যাচ্ছে। এপ্রসঙ্গে
মন্ত্রীমহোদয় বলেন, “এখন যেভাবে বাড়ছে, তাতে এক দেড় মাসের মধ্যে হাসপাতালে
কোন জায়গা থাকবে না, তখন চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ কারণে জনগণকে
আহ্বান করছি, অনুরোধ করছি তারা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। সামাজিক
দূরত্ব বজায় রাখেন।” এর আগে গত ১১ ডিসেম্বর জিম্বাবুয়ে ফেরত দুই নারী
ক্রিকেটারের মধ্যে ওমিক্রনের আক্রান্ত হওয়ার খবর সরকারিভাবে জানানো হয়েছিল।
আক্রান্তের নমুনা থেকে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এ
পর্যন্ত মোট ৫৫ জনের দেহে ওমিক্রনের সংক্রমণের দেখা পাওয়া গেছে। তবে সবার
ক্ষেত্রে জিনোম সিকোয়েন্স হচ্ছে না বলে সঠিক সংখ্যাও বলা সম্ভব নয়। করোনা
ভাইরাসের এ নতুন ধরন ঢাকার বাসাবো এলাকায় প্রথম সনাক্ত হয়। পরে বনানী ও
মহাখালীতে রোগী পাওয়া যায়। ঢাকার বাইরে যশোরে ওমিক্রন সনাক্তের পর ঢাকার
চাঁনখারপুলে ও উত্তরায় মিলেছে এ নতুন ভ্যারিয়েন্ট। দেশে ওমিক্রনের সামাজিক
সংক্রমণও শুরু হয়েছে।
এ পর্যন্ত ওমিক্রন মোকাবেলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে
চলা এবং টীকা নেয়া ছাড়া আর কোন ব্যবস্থাদি নিতে দেখা যায় নাই। সম্প্রতি
করোনা টিকার বুস্টার ডোজ নেয়ার ক্ষেত্রে সময়সীমা ৬০ বছর থেকে কমানো হয়েছে
বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখন বুষ্টার নেয়ার সময়সীমা কমিয়ে ৫০ বছর
নির্ধারণ করা হয়েছে। যারা করোনা ফ্রন্টলাইনার ছিলেন তাদের জন্য বয়স কোন
বাধা ছিল না। জনগণের জন্য সেটা কমিয়ে ৫০ বা তদুর্ধ করা হয়েছে। সোমবার
১৭.০১.২২ইং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে মহাপরিচালক
অধ্যাপক ডা: এবিএম খোরশেদ আলম এ তথ্য জানিয়েছেন।
মহাপরিচালক
বলেন, দেশে ওমিক্রনের সংক্রমণ আগের তুলনায় বাড়লেও এখন ডেল্টা ভেরিয়েন্টে
আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। মহাপরিচালক আরও বলেন, রাজধানী ঢাকায় ওমিক্রন
আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশী। সেতুলনায় অন্যান্য বিভাগে কম। ফলে কঠোরভাবে
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ সরকারি ১১ দফা নির্দেশনা মানতে হবে। অন্যথায়
পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, এখন যারা করোনায় আক্রান্ত
হচ্ছেন তাদের অধিকাংশই টিকা নেননি। এছাড়া কোমর্বিডিটির (ক্যান্সার, হৃদরোগ ও
উচ্চ রক্ত চাপ জনিত) কারণেও মারা যাচ্ছে। দেশে এ পর্যন্ত ওমিক্রনে মোট
কতজন মারা গেছে, এ সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নাই।
ওয়াল্ডওমিটারের
তথ্যানুযায়ী রবিবার ১৬.০১.২২ইং ২৪ ঘন্টায় বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত
হয়েছেন ১৯ লক্ষ ৪২ হাজার ১০৬ জন। এর মধ্যে ইউরোপের দেশগুলোয় ৭ লাখ ৯৩ হাজার
রোগী সনাক্ত হয়েছে। আমেরিকা মহাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ, এশিয়ায় পাঁচ
লাখ ২৪ হাজার, আফ্রিকায় ৮৭ হাজার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে বিশ্বে
মোট করোনায় আক্রান্ত ৩২ কোটি ৯০ লক্ষের মত। মোট মৃত্যু ৫৫ লক্ষ ৫৯ হাজার
জনের। রোববার ১৬.০১.২২ইং বিশ্বে সবচে বেশি রোগী সনাক্ত হয়েছে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে ঐদিন ২ লক্ষ ৮৭ হাজার মানুষের করোনা সনাক্ত হয় এবং
মারা গেছেন ৩৪৬ জন। ফ্রান্সে একদিনে ২ লাখ ৭৮ হাজার রোগী সনাক্ত হয়েছে এবং
মারা গেছেন ৯১ জন। এছাড়া যুক্তরাজ্যে ৭০ হাজার, জার্মানেিত ৪৫ হাজার এবং
ইতালীতে ১ লক্ষ ৪৯ হাজার করোনা সনাক্ত হয়েছে। এছাড়া ভারতে একদিনে ২ লক্ষ ৫৮
হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছেন ৩৮৮ জন। কাউকে জোর করে
টিকা দেয়া যাবে না বলে ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছেন দেশটির
সুপ্রীমকোর্ট। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার শীর্ষ আদালতে হলফনামা দিয়ে বলেছে,
নাগরিকদের টিকা কার্ড দেখানো বাধ্যতামূলক বলে কোন নির্দেশিকা জারি করা হয়
নাই। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, জনগণকে টিকা দিতে বিভিন্ন প্রিন্ট
এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যথাযথভাবে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ভারতে তান্ডব
চলছে করোনার ওমিক্রন ধরনের । ওমিক্রন ঠেকাতে মেসেঞ্জার আরএনএ টিকাতেই বেশি
ভরসা রাখা হচ্ছে। ভারতে প্রথম জেনোভা বায়ো ফার্মাসিউটিক্যালস আবএনএ
প্রযুক্তিতে টিকা বানিয়েছে। ওমিক্রন শুধু নয়, করোনা ভাইরাসের যে কোন
সংক্রামক প্রজাতিকেই এ টিকা নিষ্ক্রিয় করতে পারবে বলে দাবি করা হচ্ছে।
মহামারীতে
বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর সম্পদ বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে
জানিয়েছে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে করোনা মহামারি নতুন
করে আরও ১৬০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্রের মুখোমুখি করেছে। মহামারিতে বিশ্বের
সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরা আরও ধনী হয়েছে। কিন্তু দরিদ্রের অবস্থার পরিবর্তন
হয়নি। বিশ্বের বেশিরভাগ স্থানে ধনী গরীবের এ ব্যবধান বেড়েছে। গরীবরা হয়েছে
আরও গরীব। ধনী গরীবের মধ্যে বেড়েছে বৈষম্য। অক্সফাম দাবি করেছে বিশ্বের
সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তিদের নিম্ন আয় প্রতিদিন অন্তত: ২১ হাজার মানুষের
মৃত্যুর জন্য দায়ী। অথচ ২০২০ এর মার্চ থেকে এ পর্যন্ত মহামারি হলেও বিশ্বের
১০ ধনীর সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুনেরও বেশী। গ্রেট ব্রিটেনের প্রধান নির্বাহী
কর্মকর্তা ড্যানি শ্রীষ্কন্দরাজাহ বলেন, মহামারি চলাকালীন প্রায়
প্রতিদিনই একজন করে নতুন বিলিয়নিয়ার তৈরি হয়েছে। লকডাউন, নিম্নগামী
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পর্যটনের কারনে বিশ্বের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষেরই
আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এর ফলে বিশ্বে আরও ১৬০ মিলিয়ন লোক নতুন করে
দারিদ্রের মুখোমুখি হয়েছেন। ফোবর্স এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ১০
ধনী ব্যক্তি হলেন, জেফ বেজোজ, বার্নার্ড আর্নল্ট, বিল গেটস, ইলন মাস্ক,
ল্যারি এলিসা, ল্যারি পেজ, সের্গেই ব্রিন, মার্ক জুকারবার্গ ষ্টিভ বলমার ও
ওয়ারেন্ট বাফেট। সামষ্টিকভাবে তাদের সম্পদ ৭০০ বিলিয়ন থেকে ১.৫ ট্রিলিয়ন
ডলার বৃদ্ধি পেলেও এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। মহামারির সময় ইলন
মাস্কের সম্পদ ১০০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে বিল গেটসের বেড়েছে
মাত্র ৩০ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবার অভাব, ক্ষুধা,
লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাবে প্রতি চার সেকেন্ডে
একজনের মৃত্যু হয় পৃথিবীতে। মহামারির কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ঋণ নেয়ার
পরিমান বাড়ছে। সমাজে ফিরে এসেছে লিঙ্গ অসমতা। ২০১৯ সালের তুলনায় এখন
কর্মক্ষেত্রে অন্তত: ১৩ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৩০ লক্ষ নারী কমেছে। ২ কোটিরও
বেশি মেয়ে শিশু আর কখনো স্কুলে ফিরতে পারবে কিনা তা অনিশ্চিত। প্রতিবেদনে
বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু
জাতিগোষ্ঠী করোনায় কঠিন সময় পার করছে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল