ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
ঐতিহ্যের শহরের একি পরিনতি?
Published : Saturday, 22 January, 2022 at 12:00 AM
ঐতিহ্যের শহরের একি পরিনতি?আহসানুল কবীর ||
ঐতিহ্যের শহর কুমিল্লা,পথিকৃৎ শহর কুমিল্লা,সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন নিরিবিলি ছিমছাম শহর কুমিল্লা। একথাগুলো শুনেই আমরা বড় হয়েছি।কথাগুলো অতিরন্জিত তাও কিন্তুু নয়।বরং ঐতিহাসিক সত্য।হাজার বছর আগে কুমিল্লা সমতট আর খড়গ বংশের রাজধানী,আমাদের রয়েছে বৌদ্ধ সভ্যতার অপূর্ব সব নিদর্শন।আমাদের শীল ভদ্র জগৎময় নমস্য।আমাদের টাইগার গণি বাঙ্গালী  সৈনিকদের নিজস্ব পরিচয় তৈরী করেছেন।আমাদের জিলা স্কুল,ফয়জুন্নেসা স্কুল,ভিক্টোরিয়া কলেজ গোটা বাংলাদেশের বাতিঘর।তারও আগে এখানে গিরিধারী স্কুল নামে একটি স্কুল ছিলো।নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ই দেবীদ্বারে রাজবিহার ও আশ্রম বিহার নামে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো।কুমিল্লার বার্ড দেশের বাইরেও পাঠ্য বিষয়।কুমিল্লার টাউন হল শত বছর আগেই বাংলাদেশের নান্দনিক মিলনায়তন সমুহের একটি।রামমালা গ্রন্থাগার আর টাউন হল গ্রন্থাগার সে আমলের সবচেয়ে  জ্ঞানগর্ভ সমৃদ্ধ  পাঠাগারের অন্যতম।আমাদের ফয়জুন্নেসার সুনাম ব্রিটিশ রাণীর দরবার পর্যন্ত পৌছেঁছিলো।এই শহর কাজী নজরুল ইসলাম কে বারবার টেনে এনেছে।ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ,ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ,ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু,শচীন কর্তা, হিমাংশু দত্ত,সন্জয় ভট্বাচার্য,ওস্তাদ জানে আলম চৌধুরীর স্মৃতির শহর কুমিল্লা।বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠাকারী মোহীনি মোহন বর্ধন,ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত,অজিত কুমার গুহ,আর অতীন্দ্রমোহন রায় আর রফিকুল ইসলামের শহর কুমিল্লা।আখতার হামিদ খান,আসহাব উদ্দিন আহমেদ,সেলিনা বানু ডাঃ যোবায়দা হান্নান কবে যে কুমিল্লার একজন হয়ে গেছেন তারা নিজেরাও তা জানেননা।১৩০০ বছর আগের চন্ডীমুড়া,সাতশত বছর আগের সতর রত্ন মন্দির,৫৬৪ বছর আগের ধর্ম সাগর,নানুয়াদিঘী এখনো সগৌরবে বয়ে যাচ্ছে।
সেই কুমিল্লার এখনকার অবস্থা দেখলে উপরের কথাগুলোকে গালগল্পই মনে হবে।বিমান বন্দর তৈরীর সময় অনেক পুরাতন স্থাপত্য কীর্তি বিনষ্ট করা হয়েছে।পাঁচথুবীর পঞ্চস্তুুপ খুঁজে পাবার আর কোন সুযোগ নেই,আনন্দ চন্দ্র রায়ের আনন্দ সাগর পাকিস্তান আমলের শুরুতেই ভরাট হয়ে গেছে।শাসনগাছা ডাকবাংলোর দিঘী ভরাট করে সেখানে এখন বাস টার্মিনাল।চোখের সামনে ভরাট হয়ে গেলো মোগলটুলীর লালা পুস্করনী,ঠাকুর পাড়ার জোড় পুকুর, তাল পুকুর এলাকার দুটি পুকুর,রায় বাড়ীর পুকুর,ব্যঙ সাগর,সারদাপাল মাঠের পুকুর সহ অনেক পুকুর।আজ থেকে একশ দেড়শো বছর আগে শহরে প্রায় সব বাসাতেই ছোট বড় পুকুর ছিলো।মানুষ ছিলো কম,জায়গা ছিলো বেশী।মানুষ বেড়েছে, চাপ বেড়েছে সেই বাস্তবতাও মানতে হবে এটাও সত্য।কিন্তু এখনতো দিঘীগুলোও ঝুঁকির মুখে।পত্রিকায় দেখলাম, শুনতে পেলাম তিনশত বছরের পুরাতন উজীর দিঘী,সারে তিনশত বছরের পুরানো আমীর দিঘীর প্রতিও নাকি লোভাতুর চোখে তাকাচ্ছেন অনেকে।ঘিলাতলীর জমিদার সুফি আমীর মোহাম্মদ চৌধুরী কতৃক নির্মিত চকবাজারে শহরের অন্যতম প্রাচীন মসজিদটিও আধুনিকায়নের নামে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে দুই মাস আগে।যেকোন বিবেচনায় এটি এন্টিকস।মসজিদটির পুরাতন আদলটি রেখেওতো আধুনিকায়ন, বর্ধিতকরণ সম্ভব ছিলো।আমরা শুধু নির্বাক হয়ে অবলোকন করেছি।বছর দুই তিনেক আগে জগন্নাথপুরে শাহজালালের মসজিদটির ও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে।জনশ্রুতি মতে এটি শহরের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ।মসজিদটি কবে নির্মিত হয়েছিল এবিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।তথ্য অনুযায়ী ১৬৫০ সালে ঘিলাতলীতে নির্মিত সুফী আমীর মোহাম্মদ জামে মসজিদ শহরের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ।কিন্তু হযরত শাহজালালের আগমনের সময় হিসেব করলে সেটি প্রাচীন হবার কথা।সুরসাগর হিমাংশু দত্তের বাড়ীটি এখন মসজিদে রুপান্তরিত হয়েছে।সংস্কৃতিজন আর শিক্ষিত মানুষের শহরে এখন সত্যিকার অর্থে কোন সিভিল সোসাইটি নেই।এই শহরে রাসমোহন চক্রবর্তীর মতো কোন পন্ডিত আর কবে জন্ম নিবে বিধাতা জানে!যানজট বেড়েই চলেছে,শ্রম ঘন্টা নষ্ট হয়েই যাচ্ছে কিন্তু কারো কোন মাথাব্যাথা নেই।এই শহরে একশত জন হকার দশলক্ষ মানুষের চেয়ে শক্তিশালী।
দেখে শুনে মনে হচ্ছে আমরা যেমন আমাদের অতীত নিয়ে গর্ব করি, পূর্বসুরীদের নিয়ে শ্লাঘা অনুভব করি ৫০ বছর পরের প্রজন্ম আমাদের কে নিয়ে উপহাস করবে।তারা আমাদের অযোগ্য আর অথর্ব বলেই চিহ্নিত করবে।ইতিহাসের দায় এড়ানোর সুযোগ আমাদের কারোর নাই।সামনে শুধুই নিকষ অন্ধকার।ঐতিহ্যের শহর ক্রমশই বর্বরদের শহর হবার পথে হাটছে।