প্রভাষ আমিন ।।
বুধবার
রাতে হঠাৎ বিষণ্নতার চাদরে ছেয়ে যায় চারপাশ। আবু মহসিন খান নামে এক
ব্যবসায়ী ফেসবুক লাইভে এসে বঞ্চনার কথা, নিঃসঙ্গতার কথা, প্রতারিত হওয়ার
কথা বলে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। বীভৎস এই
দৃশ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, তোলপাড় গণমাধ্যমেও। ঘটনার
যে নাটকীয়তা, নির্মমতা তা যেকোনও মানুষকে নাড়া দেবে। ৫৮ বছর বয়সী ব্যবসায়ী
আবু মহসিন খান সামাজিক পরিসরে পরিচিত কেউ নন। তবে তার একমাত্র কন্যা তিনা
চিত্রনায়ক রিয়াজের স্ত্রী। তাই সব জায়গায় আলোড়ন, ‘চিত্রনায়ক রিয়াজের
শ্বশুরের আত্মহত্যা’।
তবে এখানে রিয়াজ বা তার স্ত্রীর কোনও দায় নেই। তবু
সামাজিকভাবে রিয়াজকেই হেয় হতে হয়েছে। মহসিন খান লাইভের শুরুতে তার
অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে শেয়ার করার আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছিলেন, যাতে সবাই শিখতে
পারেন। কিন্তু শেষে যে শিক্ষা তিনি দিয়েছেন, তা যেন কেউ গ্রহণ না করেন।
মানুষ কেন নিজেকে হত্যা করে তার নির্দিষ্ট কোনও কারণ নেই। জীবনানন্দ দাস তার ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় লিখেছেন-
‘জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে’
অন্তর্গত
রক্তের ভেতর খেলা করা এই বিপন্ন বিস্ময়ের খবর আমরা অনেকেই জানি না। আবু
মহসিন খান অবশ্য আত্মহত্যার আগে তার কারণ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। মহসিন
খান ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কথা, ব্যবসা খারাপ হওয়ার কথা, প্রিয়জনদের
কাছে প্রতারিত হওয়ার কথা বলেছেন বটে; তবে বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায়
তাকে ঠিক ব্যর্থ বলা যাবে না। ব্যবসা খারাপ হলেও তিনি ধানমন্ডিতে নিজের
ফ্ল্যাটে থাকতেন। তার ছেলে নিশান অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, কন্যা তিনাও
সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তিগত বেদনা তো ছিলই, তবু নিঃসঙ্গতাই তাকে
কুরে কুরে খাচ্ছিল। এটাই শেষ পর্যন্ত তাকে আত্মহত্যার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
এক খালার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছেন, সেই খালার ছেলে
যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, মায়ের মৃত্যুর পরও যিনি আসতে পারেননি। তার আশঙ্কা,
তিনি মরে পড়ে থাকলে সাত দিনেও কেউ টের পাবেন না। তার আশঙ্কা অমূলক নয়। এমন
ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে।
মহসিন খানের আত্মহত্যা আমাদের কিছু শেখায়নি, তবে
অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বাবা-মাকে দেখে না, এমন
সাধারণ প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। কিন্তু বাস্তবতা সবসময় এমন নয়। তবে এটা ঠিক,
আমরা পরিবারগুলোকে অণু-পরমাণুতে ভাগ করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে যাই,
নিঃসঙ্গতা আমাদের গ্রাস করে নেয়। আবার একা থাকলেই যে মানুষ নিঃসঙ্গ হয়, তাও
সবসময় সত্যি নয়; অনেক মানুষের মাঝেও মানুষ একা হতে পারে। ইদানীং আমি
ফেসবুকে অনেকের পোস্ট দেখি, তাদের সন্তান বিদেশে পড়তে যাচ্ছে। এটা আনন্দের
খবর। আমি তাদের অভিনন্দন জানাই, শুভকামনা জানাই। কিন্তু এই আনন্দের সংবাদের
পাশে লুকিয়ে আছে এক গভীর বেদনাও। আমি জানি, অনেকের এই যাওয়া একেবারেই
যাওয়া। সেই সন্তান যদি উন্নত বিশ্বে ভালো পড়াশোনা করে ভালো সুযোগ পায়, সে
হয়তো সেখানেই থেকে যাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা-ই ঘটে। উন্নত বিশ্বে থেকে
গেলে সেই সন্তান হয়তো বাবা-মাকে দেখতে প্রথমে বছরে একবার, পরে দুই বছরে
একবার দেশে আসতে পারবে। হয়তো বাবা-মা মৃত্যুশয্যায় শুনলে ছুটে আসবে। কেউ
এসে বাবা-মাকে দেখতে পাবে, কেউ পাবে না; কেউ জানাজা পাবে, কেউ পাবে না।
এটাই বাস্তবতা। এখানে সন্তানকে দোষারোপ করার কোনও মানে হয় না।
আমাদের
একমাত্র সন্তান প্রসূন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার
বন্ধুদের অনেকেই দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চলে গেছে।
সেদিন শুনলাম এক বন্ধু কানাডা থেকে ছুটিতে এসে ফিরে যাওয়ার সময় মা বিলাপ
করে কাঁদছিলেন, তিনি কিছুতেই তার ছেলেকে কানাডায় যেতে দিতে চাইছিলেন না।
তার বেদনাটা আমি বুঝি। তিনি টের পেয়ে গেছেন, তার সন্তান ছুটে গেছে। আর কোলে
ফিরে পাবেন না। সে এখন বিশ্বের সন্তান। শেষ বয়সে আমাদের দেখবে, সেই আশায়
সন্তানের ক্যারিয়ার, তার ভবিষ্যৎ আটকে রাখার কোনও অধিকার তো আমাদের নেই।
আনিসুল হকের অনুবাদে কাহলিল জিবরানের কবিতা ‘সন্তানদের নিয়ে’ পড়ে সান্ত্বনা
খুঁজতে পারেন-
তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু
তাদের তোমার মতো বানানোর চেষ্টা করো না।
কারণ জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না।
তোমরা হচ্ছ ধনুক, আর তোমাদের সন্তানেরা হচ্ছে ছুটে যাওয়া তীর।’
আসলেই
সন্তান হলো ছুটে যাওয়া তীর। তাকে আটকে রাখা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়।
বাবা-মায়ের দায়িত্ব হলো সন্তানকে ভালো ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
সন্তান বড় হয়েও বাবা-মার প্রতি অবশ্যই তার দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু সারা
জীবন একসঙ্গে থাকবে, এমন বিনিময় প্রত্যাশা করা সবসময় ঠিক নয়।
প্রত্যেক
মানুষের জীবন তার মতো। প্রত্যেকেরই উচিত তার জীবনের আনন্দ তার মতো খুঁজে
বের করা। কেউ হয়তো বই পড়ে আনন্দ পাবে, কেউ সিনেমা দেখে, কেউ বাগান করে, কেউ
বেড়িয়ে। জীবন অমূল্য, তার প্রতিটি পল উপভোগ করতে হবে।
‘মরিতে চাহি
না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ এই আকুতি চিরন্তন, এই
আকুতি সবার। আবু মহসিন খান যে ঠান্ডামাথায় নিজেকে হত্যা করলেন, তার কণ্ঠেও
শেষবেলায় সেই আকুতি, ‘পৃথিবীটা খুব সুন্দর। সবাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে
চায়। কেউ পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় না।’
মহসিন খান হয়তো এই সুন্দর পৃথিবীতে
মানিয়ে নিতে পারেননি। কিন্তু মহসিন খানের মৃত্যুপূর্ব লাইভ থেকে যেন আমরা
এই শিক্ষাটাই নিই, পৃথিবীটা খুব সুন্দর। সেই সৌন্দর্য যেন আমরা প্রতিদিন
আবিষ্কার করতে পারি। নিজেদের অণু-পরমাণুতে ভাগ না করে, ভার্চুয়াল জগতে
আবদ্ধ না রেখে আমরা যেন চারপাশের মানুষকে সঙ্গী করে নিই।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ