Published : Monday, 7 February, 2022 at 12:00 AM, Update: 07.02.2022 12:50:13 AM
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের
প্রশ্নে পাক সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু জাতীয়
পত্রিকা। বাঙালীর মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার ন্যায্য দাবি অযৌক্তিকভাবে
উপস্থাপিত হয়েছে সে সব পত্রিকায়। বেছে নেয়া হয়েছিল অপসাংবাদিকতার কৌশল।
মিথ্যার আশ্রয় নেয়া সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল
ছাত্রসমাজ। ভ্রান্ত সাংবাদিকতার নজির গড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষার
আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িকতা ও দেশদ্রোহিতা হিসবে প্রমাণ করতে চেয়েছে পশ্চিম
পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি করাচির ‘ডন’ পত্রিকায়
‘প্রাদেশিকতা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের সব থেকে বড় শত্রুরূপে
প্রাদেশিকতাকে আখ্যায়িত করে লেখা হয়, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম
রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা যে আন্দোলন করছেন- তা
আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রদোহিতা। ভাষার বিষয়ে যুবকদের কাছে একটা আবেগময় আবেদন
আছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এটি খুব শক্তিশালী হাতিয়ার
হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে সব মানুষ কায়েদে আজমের জীবদ্দশায় কোন দিন
মাথা তোলার সাহস করেনি, তাদেরকেই প্ররোচিত করা হচ্ছে জাতির পিতার উপদেশ
অগ্রাহ্য করতে।’ এমনকি পক্ষপাতদুষ্ট ওই সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘যারা
প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রাদেশিকতার ওকালতি করেন, তাদেরকে রাষ্ট্রের
শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা এবং কোন প্রকার প্রশ্রয় না দেয়া উচিত।’ এই
সম্পাদকীয়র প্রেক্ষাপটে ১৯৫২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্ররা প্রতিবাদ করেন। ছাত্রদের ওই সভায় এই সম্পাদকীয়র নিন্দা প্রস্তাব
গৃহীত হয়। ছাত্ররা ঘোষণা দেয়, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার
আন্দোলনের সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বা প্রাদেশিকতার কোন সংশ্রব নেই।
‘ডন’
ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য পত্রিকাগুলোও পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনকে
প্রাদেশিকতা বলে উল্লেখ করে। মওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানী সেই অপপ্রচারের
বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘উর্দুর মতো একটি নূতন
ভাষা পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর জোর করিয়াই চাপাইয়া দিতে চাহিলে নিশ্চয় এই
আশঙ্কাই জনগণের মনে উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে, চাকরি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে
তাহাদিগকে কোণঠাসা করিবার জন্যই ইহা করা হইতেছে। একতার বুলি আওড়াইয়া যারা
পাকিস্তানে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষার পক্ষে ওকালতি করিতেছেন, আমি তাহাদিগকে
দুনিয়ার প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড ও কানাডার
দিকে তাকাইতে বলিতেছি। তথায় একের অধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এবং ইহাতে দেশের
একতা শিথিল করা তো দূরের কথা, দেশবাসীর আর্থিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ
সাধনে প্রচুর সহায়তা করিয়াছে।’ তৎকালীন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদও
‘ডন’ পত্রিকার সম্পাদকীয়র বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন।
৬ ফেব্রুয়ারি
পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে নির্বাচিত সংবিধান সভার সদস্য চৌধুরী নাজির আহমেদ খান
ভাষা প্রশ্নে নাজিমুদ্দীনের একটি উক্তির প্রতিবাদ করে সংবাদপত্রে বিবৃতির
মাধ্যমে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে- সে বিষয়ে সংবিধান সভাই
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। উর্দু যে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষারূপে
প্রত্যেক সরকারী মুখপাত্র এবং দায়িত্বশীল নেতার দ্বারা পাকিস্তানের প্রথম
থেকেই স্বীকৃত হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
এই সময় পূর্ববাংলা
সরকার কর্তৃক ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এর প্রকাশনা নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়।
অভিযোগ ছিল, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শান্তিবিরোধী এবং রাষ্ট্রবিরোধী
কার্যকলাপ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত আনুগত্য। ১২ ফেব্রুয়ারি এই ইংরেজী দৈনিকে
‘ছদ্ম ফ্যাসিজম’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে খাজা নাজিমুদ্দিনের সমালোচনা করা
হয়।
সংবাদপত্র বন্ধের সরকারী আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থার
বিরুদ্ধে চারদিকে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্ররা সভা করে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা করেন। বক্তারা বলেন, ভাষা
আন্দোলনকে ব্যাহত করার জন্যই আন্দোলনের সমর্থক একমাত্র দৈনিক পত্রিকাকে
বন্ধ করে দেয়া হলো।