বিডিনিউজ : চির নবীন বসন্তের প্রথম দিন আর চিরায়ত সুন্দরের প্রতীক ভালোবাসার বিশেষ দিবসটি উৎসবের রঙ ছড়িয়ে হাতে হাত ধরে মিলেমিশেই এসেছে আরও একবার।
মহামারীর কারণে গত দুবছর উৎসব খানিকটা ফিকে হয়ে গেলেও প্রকৃতিতে রঙিন শাসনের অভিষেকে সবুজ গ্রাম থেকে শুরু করে ইট, পাথরের নগরী- সবখানেই লেগেছে বসন্তের ছোঁয়া।
ফাগুনের প্রথম দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে নিজেদের রাঙিয়ে নৃত্েয, বাদ্েয, ছন্দে-গীতে বসন্তকে বরণ করে নিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব সংগঠন সক্রিয় না হলেও রাজধানীতে থাকছে মূল আয়োজন।
করোনাভাইরাসের কারণে গতবারের মতো এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত বরণ উৎসব না থাকলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজন করেছে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ।
সোমবার সকাল সোয়া ৭টায় উদ্যানের মুক্ত মঞ্চে ‘বেঙ্গল মিউজিক’ এর বাদ্য পরিবেশনার মাধ্যমে শুরু হবে বসন্ত উৎসব। সকাল ১০টা পর্যন্ত সেখানে চলবে বসন্তের আবাহন ।
কবিতা আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য, লোকগীতি, পল্লীগীতি, আদিবাসীদের পরিবেশনাসহ ‘বসন্তের কথন’ নামে থাকবে আলোচনাসভা। নাট্য ব্যক্তিত্ব সারা যাকের সেখানে উপস্থিত থাকার কথা।
বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর সভাপতি স্থপতি শফিউদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনা পরিস্থিতির জন্য আমাদের মূল অনুষ্ঠানটাও এবার সংক্ষিপ্ত হচ্ছে।
“আগে তো সারাদিনই বকুল তলায় বসন্তবরণ উৎসব হত। এছাড়া রবীন্দ্র সরোবর, বাহাদুর শাহ পার্ক, উত্তরায় এ আয়োজন করা হত। এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কেন্দ্রীয়ভাবে এ আয়োজন করা হচ্ছে।”
প্রকৃতিজুড়েও চলবে নিজস্ব উদযাপন। প্রকৃতির দখিনা দুয়ারে ফাগুনের হাওয়া, কোকিলের কণ্ঠে কুহুতান, অশোক-পলাশ-শিমুলের রক্তিম আভা, ফুলে ফুলে ভ্রমরের খেলা জানান দেবে বসন্ত এসে গেছে।
শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বসন্ত উৎসবকে নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রচুর আগ্রহ রয়েছে। তাদের উৎসাহের জন্যই মূলত মহামারীতেও আমরা এটি কন্টিনিউ করছি। এটি পহেলা বৈশাখের মতো একটি সার্বজনীন উৎসব।
“এবার দিনটিতে আরেকটি বিশেষত্ব হল ভালোবাসা দিবস। গত দুবছর ধরে ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন একই দিনে হচ্ছে। দেখা যায়, সকাল বেলা হলুদ শাড়ি, বিকেল বেলা লাল শাড়ি। এটা আমরা বলি, ভালোবাসার বসন্ত।”
এবারের বসন্ত উৎসব নিয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, আমাদের সমস্ত উৎসব মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করার জন্য, আরও কাছে আনার জন্য।
“মানুষ থেকে মানুষ দূরে সরে গেলে আমরা বলতাম সে অসামাজিক। কোভিড এমন একটা রোগ, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। পুরোটাই আইরনি।
“আগে আমরা যেভাবে বসন্ত উৎসব থেকে শুরু করে সমস্ত উৎসব উদযপান করতাম, আরও পরস্পর কাছে যেতে পারতাম, ওই রকম একটা দিনের অপেক্ষায় আছি।”
১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রতি বছর ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে অন্যতম বসন্ত উৎসব।
১৯০৭ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে যাত্রা শুরু করে বসন্ত উৎসব, যা ‘ঋতুরঙ্গ উৎসব’ নামেই পরিচিত।
স্বাধীন বাংলাদেশে এর গোড়াপত্তন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ছোট্ট পরিসরে শুরু হয় বসন্ত উৎসব।
এ আন্দোলনের বিজয় উদযাপনের জন্য বানিয়ে রাখা রঙিন কাগজের ফুল, প্রজাপতি আর পাখির অবয়ব নিয়ে চারুকলা অনুষদের ৮৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করেন।
পরে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সালে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় শুরু হয় বসন্ত উৎসব।
এবারের উৎসব নিয়ে পরিষদ সদস্য সঙ্গীতা ইমাম বলেন, “চারিদিকে অতিমারীর প্রকোপ, স্বজন হারানো বেদনার সুর। তবু প্রকৃতি চলে আপন নিয়মে, ঋতু পরিক্রমায় বসন্ত সমাগত। বসন্ত আমাদের জীবনে ফাগুয়ার রঙিন আনন্দ আনবেই।
“বসন্ত এ ভূখণ্ডের মানুষের আনন্দ আর আন্দোলনের ঋতু। এ বসন্তেই ভাষার দাবিতে রাজপথে রক্ত ঝরেছে। এই বসন্তেই বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সূচনা। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন ও সাফল্যও বসন্তেই সূচিত হয়।”
তিনি জানান, জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ গত ২৮ বছর ধরে নাগরিক জীবনে বাসন্তি আনন্দ আর ফাগুনের আবীর ছড়িয়ে আসছে। এখন কাউকে আর ডেকে বলতে হয় না বাসন্তি বসনে সাজবার কথা।
“বলতে হয় না, ফাগুন এসেছে, খোঁপায় গাঁদার মালা পরো। পথে বের হলেই বুঝতে পারা যায়, দিনটা পহেলা ফাল্গুন,” বলেন তিনি।
প্রতি বছর পহেলা ফাল্গুনে ঢাকার রমনায় মাধবী বরণ উৎসব করত প্রকৃতিপ্রেমীদের সংগঠন ‘তরুপল্লব’। মহামারীর বিধি-নিষিধের কারণে এবারও হচ্ছে না সে উৎসব।
‘তরুপল্লব’ এর সাধারণ সম্পাদক মোকারম হোসেন বলেন, “কোভিডের কারণে সেটি আমরা করতে পারছি না। কোভিডে অনুষ্ঠান করলে আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা আসতে পারেন না। তাছাড়া একটা নিষেধাজ্ঞা কিন্তু আছেই।”
কোকিল যেমন বসন্তের আগমন বার্তা ছড়িয়ে দেয় তেমনি মাধবী ফুলের হাত ধরেই আসে ফাগুন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা-কবিতা-গানে মাধবীলতাকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেও ফুলটি চেনেন না অনেকেই।
মোকারম হোসেন বলেন, “মাধবী বা মধুমঞ্জুরিকে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে আমরা মাধবী বরণ উৎসবটা করতাম। রমনায় যেখানে এই মাধবী ফুটত, সেখানেই প্রকৃতিপ্রেমীরা মিলিত হতেন।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বসন্ত ঋতুর ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে উল্লেখ করে এই নিসর্গবিদ বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। শীতের যে তীব্রতা ছিল, তা এখন তেমন নেই।
এমনকি শীতের কোনো ধারাবাহিকতাও নেই। এবার আমরা দেখেছি বসন্তের ফুলগুলো কোথাও কোথাও ১৫-২০ দিন আগে ফুটেছে। আবার অসময়ে বৃষ্টিতে ফুল নষ্টও হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট বলা যায়।”