ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...
Published : Thursday, 17 February, 2022 at 12:00 AM, Update: 17.02.2022 1:44:30 AM
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের আগে থেকেই মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় সচেতন ছিলেন পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক নেতারা। তাই পাঁচ বছর পর ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপ নিলেও পটভূমিটা তৈরি হয়েছিল পাঁচ বছর আগেই। আর ঢাকাকেন্দ্রিক সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব বাংলার নানা প্রান্তে। ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষা আন্দোলনের স্রোতধারা গড়িয়েছিল পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদ-শহর থেকে গ্রামে। মূলত ১৯৪৮ থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২ সাল অবধি জেলা থেকে মহকুমা শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম। আর ঢাকার বাইরে একুশের সেই সংগ্রামে ছাত্রদের সঙ্গে শামিল হয়েছিল রাজনৈতিক নেতারা, সাহিত্যিক, চিকিৎসক থেকে মেহনতি মানুষ। নারী থেকে পুরুষ কিংবা তরুণ থেকে পরিণত বয়সের মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছিলেন মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে। তাদের মধ্যে অনেকেই নেতৃত্ব দিয়ে অব্যাহত রেখেছিলেন ভাষার লড়াইকে।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের মতোই বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল মহকুমা শহর নারায়ণগঞ্জ। হয়ে উঠেছিল মিছিলের শহর। ভাষা আন্দোলনে ঢাকার চেয়ে নারায়ণগঞ্জে ছাত্রী ও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি। এমনকি গৃহিণীরা অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে বেগবান করেছেন ভাষার লড়াইকে। আর নারীদের ভাষা সংগ্রামে সম্পৃক্তকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা রেখেছিলেন মমতাজ বেগম। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল শ্রমজীবী মানুষ। এই শিল্পাঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমিক যোগ দিয়েছে জনসভায় কিংবা মিছিলে। সেসব কর্মসূচী বাস্তবায়নে রাজনৈতিক নেতা শামসুজ্জোহার সমান্তরালে ভূমিকা রেখেছেন শ্রমিক নেতা আলমাস আলী, ফয়েজ আহমদ ও শফি হোসেন।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ব্যাপক রূপ নিয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ভাষার দাবিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে শহরজুড়ে। মিছিলে-স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে শহর। লালদিঘী ময়দানের জনসভায় সমবেত হয়েছিল ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। সম্পৃক্ত হয়েছিলেন ছাত্র থেকে শুরু করে সাহিত্যকর্মী কিংবা বুদ্ধিজীবী। চট্টগ্রামের আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রেলওয়ে শ্রমিক লীগের নেতা চৌধুরী হারুণ-উর-রশীদ, সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, আওয়ামী মুসলিম লীগের এম এ আজিজ, বিপ্লবী বিনোদ দাশগুপ্ত, জহুর আহমেদ চৌধুরী থেকে তমদ্দুন মজলিশের আজিজুর রহমান সাহিত্যিক গোপাল বিশ্বাস প্রমুখ।
১৯৪৮ সালের মার্চেই ভাষার দাবিতে বিক্ষুব্ধ ওঠে ময়মনসিংহ। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তৃতার সূত্র ধরে ছড়িয়ে পড়ে উত্তাপ। ছাত্র-জনতার সম্মিলনে অনুষ্ঠিত হয় সভা-সমাবেশ ও মিছিল হয়। রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে বিপিন পার্কে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি এখানকার পুলিশ লাইনের সদস্যরাও অর্থ সহায়তা দিয়েছিল আন্দোলনে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও বিধ্বংসী। বন্ধ হয়ে যায় স্কু-কলেজ, হাট-বাজার, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মহকুমা শহর জামালপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে।
ভাষা আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়েছিল রাজশাহী শহরেও। ১৯৪৮ থেকে ধারাবাহিকভাবে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই শহরে আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল সেখানকার স্কুল-কলেজগুলো। বায়ান্নর ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহীতেও পালিত হয়েছে প্রতিবাদী কর্মসূচী। সেদিনের সভায় বক্তৃতা করেছিলেন পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া আনোয়ারুল আজিম, মোহসেনা বেগম, মমতাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ও ধর্মঘট পালিত হয়েছে এই শহরে। পুলিশি বাঁধাকে উপেক্ষা করে সকালের মিছিল শেষে বিকেলে ভুবনমোহন পার্কে হয়েছে জনসভা। প্রগতিশীল চিন্তার এম এল এ মাদারবক্স কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা সেই জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে মাদারবক্স আইনসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এছাড়াও আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন পর্যন্ত রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন আতাউর রহমান, গোলাম আরিফ, একরামুল হক, মোহাম্মদ সুলতান, আবুল কাশেম চৌধুরী ও তোফাজ্জল হোসেন।
১৯৪৮ সাালের মার্চে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় বগুড়ায়। হয়েছে প্রতিবাদ সভা থেকে বিক্ষোভ মিছিল। কবি আতাউর রহমানকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল ভাষা সংগ্রাম কমিটি। ১১ মার্চের একটি জনসভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আটচল্লিশের পথ ধরে বায়ান্নতে এই শহরে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে গঠিত সেই কমিটিতে মজিরউদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও গোলাম মহিউদ্দিন সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বগুড়া। শহরের আশপাশ থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয় আন্দোলন। ১৯৫৩ সালে শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল বগুড়ায়।
১৯৪৮ সালের মার্চে এডওয়ার্ড কলেজ থেকে পাবনায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। বায়ান্নর আন্দোলনেও এই কলেজের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করেছিল তারা। সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। সেই আন্দোলনে সুফিয়া বেগম, জাহানারা প্রধান, নূরজাহান বেগম ও হালিমা খাতুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া পাবনার ভাষা আন্দোলনে মাহবুবুর রহমান খান ও আমিনুর ইসলাম বাদশাকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ছাত্র ফেডারেশন, কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র কংগ্রেসের বিশেষ ভূমিকার এখানকার আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে নির্মিত হয়েছিল শহীদ মিনার।
রংপুরেও ভাষা আন্দোলন দানা বেঁধেছিল ১৯৪৮ সালের মার্চে। কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মুখ্য ভূমিকা ছিল সে আন্দোলনে। মতিউর রহমান, ইদ্রিস লোহানী, ইউনুস লোহানী, ভিখু চৌধুরীদের নেতৃত্বে বিস্তৃত হয় আন্দোলন। এই শহরের বায়ান্নর আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুফি মোতাহার হোসেন, শাহ তোফাজ্জল হোসেন। ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের মধ্যে প্রতিবাদী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন মাসুদা চৌধুরী, ডলি এবং একাত্তরের শহীদ হওয়া মিলি চৌধুরী।
বায়ান্নতে ভাষার দাবিতে বিক্ষুব্ধ হয়েছিল দিনাজপুরের ছাত্রসমাজ। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো ঘটনার প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি বেরিয়েছিল বিশাল এক বিক্ষোভ মিছিল। সেই প্রতিবাাদী সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন মির্জা নুরুল হুদা, গণতান্ত্রিক যুবলীগের দবিরুল ইসলাম ও আবদুল হাফিজ।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যশোরে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদের নেতৃত্বে আটচল্লিশের ১১ মার্চের কর্মসূচীকে ঘিরে ১৪৪ ধারা জারি থাকলেও তা ভঙ্গ করা হয়। বের করা হয় মিছিল। এক মাইল লম্বা সেই সেই মিছিলের হামিদা রহমানের নেতৃত্ব অংশ নিয়েছিলেন অসংখ্য ছাত্রী। পুলিশ গুলি ছুড়লেও ঘটনাক্রমে সেই মিছিলের কেউ হতাহত হননি। যশোরের মহকুমা শহর নড়াইল, মাগুরাও ঝিনাইদহে বিস্তৃতি হয়েছিল সেই আন্দোলনের উত্তাপ।
পাকিস্তানে জন্মের মাত্র তিন মাস পর ১৯৪৭ সালের নবেম্বরে সিলেটে এক ভাষাভিত্তিক বিতর্কে বক্তব্য দিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। মুসলিম লীগের পান্ডারা আক্রমণ করেছিল সেই সভায়। এরপর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সিলেটে এলে তাকে বাংলা ভাষার পক্ষে স্মারকলিপি পেশ আবদুস সামাদ। ১৯৫২ সালে পীর হাবীবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পুনঃগঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা কমিটি। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন হয়েছিলেন সিলেটে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন হাজেরা মাহমুদ, যোবেদা খাতুন, নজিবুন্নেছা, শাহেরা বানু, লতিফুন্নেছা, রাবেয়া খাতুনসহ অনেক নারী।
ভাষা আন্দোলনের ঢেউয়ে বায়ান্নতে ফুঁসে উঠেছিল বরিশালও। বজ্রমোহন কলেজকে কেন্দ্র বিস্তৃত হয়েছিল এখানকার ভাষার সংগ্রাম। তাতে শামিল হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ, ছাত্র ফেডারেশন। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন শামসুল হক। মহিলা এবং ছাত্রীরাও সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই শহরের ভাষার সংগ্রামে। তাদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন মিসেস হামিদউদ্দিন, হোসনে আরা নীরু, মঞ্জুশ্রী, মাহে নূর বেগম ও রানী ভট্টাচার্য।
এভাবেই আটচল্লিশে থেকে বায়ান্ন পর্যন্ত চলমান ভাষা আন্দোলনের ঢেউ আঁছড়ে পড়েছিল খুলনা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চৌমুহনী, মাইজদী, কুমিল্লাসহ পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদে।