রেজাউল করিম শামিম ।।
‘৭১
সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়টিতে পাকিস্তানিদের নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ,
নির্যাতনের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে অবরুদ্ধ দেশবাসী। এর কিছু সচিত্র
খবরাখবর উঠে এসছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব গণহত্যা
হয়েছে লোকালয় থেকে দূরে। বিশেষ করে নদী বা জলাশয়ের পাশে। যেসব স্থানে ঐসময়
সাধারণত লোকজনের যাতায়ত ছিলো কম কিংবা ছিলোই না। তেমনি স্থানগুলোই বেছে
নেয়া হয়েছিলো অসহায়-নিরিহ, আবার দেশের প্রতি নিবেদিত নারীপুরুষ। তাদের
হত্যা করে পৌচাশক উল্লাশে নিজের আত্নতৃপ্তি লাভ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর
গণহত্যার সেই সব বধ্যভূমিগুলো চিহিৃত এবং সংরক্ষণের কাজ শুরু করা হয়। কারণ
এগুলো আমাদের মহান স্বাধীনতার ইতিহাসের একটি বিশাল অধ্যায়। তেমনি একটি
প্রতিষ্ঠান‘গণহত্য-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র‘।
প্রতিষ্ঠানটি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এমনি দূরহ কাজে জড়িত রয়েছে দীর্ঘদিন।
একেন্দ্রের উদ্যোগে সেইসব বধ্যভূমির ন্যপথ্যের নির্মম ঘটনাবলি তুলে ধরার
কাজ চলছে। আর তা ‘নির্ঘন্ট গ্রন্থমালা‘র মাধ্যমে প্রকাশের কাজও করছে।
সংগঠদের মতে দেশে বধ্যভূমির সংখ্যা সহস্রাধিক।
তেমনি একটি
নির্মম-নিষ্ঠুর গণহত্যার চিহ্ন বহন করে চলেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার
সড়াইলের‘ ধর্মতীর্থ বধ্যভূমি‘। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় সেখানে একদিনেই
গণহত্যার শিকার হন শতাধিক অসহায় গ্রামবাসী। দিনটি ছিলো,‘৭১এর ১৮ অক্টোবর।
এমনি আরো লাল কালির দাগ রয়েছে সেখানকার মানুষজনের মনে। দিনের পর দিন সেখানে
এলাকার লোকজন ধরে এনে নির্যাতন এবং গুলি করে হত্যা করা হয়। সেখানকার
লোকজনের কাছ থেকে এমন কথাও শোনা যায় যে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী
স্থানীয় রাজাকার-আলবদরেরা লোকজনকে বেঁধে এনে নির্যাত করে পরে হত্যা করতো।
তাদেরই একজন কালীকচ্ছ গ্রামের আনন্দ দাস। তাকে গুলি করে ফেলে রাখা হয়েছিলো
মৃতবলে। কিন্তু তিনি মারা যাননি। তার কোমরের সাথে অন্য একজন হতভাগ্যের লাশ
বাঁধা ছিলো বলে তিনি জীবিত থেকেও সেখান থেকে পালাতেও পারেননি। পরে সকালে
নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার গোঙানি শুনে সেখানকার মকসুদ আলী, তাকে উদ্ধার
করে নৌকা করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলো। কিন্তু তারপরও তিনি তার জীবন রক্ষা
করতে পারেননি। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাকিস্তান বাহিনীর
সৈনিকরা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে তাকে।
এমনি আরো অনেক
নির্মমতার সাক্ষী হয়ে এখনো জীবিত আছেন সেখানকার অনেকেই। অথচ, স্বাধীনতার
পঞ্চাশ বছর পরও সেই ‘ধর্মতীর্থ বধ্যভূমি‘টি ঘিরে গড়ে তোলা যায়নি কোন ধরনের
স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মারক চিহ্ন। জাতির জন্য এটিকে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা
যায়।
ধর্মতীর্থ নামের বধ্যভূমিটি সরাইল উপজেলা সদরের কাছে।
সরাইল-নাছিরনগর সড়কের পাশেই বলা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে প্রায়
১৫ কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান। বর্তমানে বেশ কোলাহলপূর্ণ হলেও, পঞ্চাশ
বছর আগে মোটেও এমনটি ছিলোনা। ছিলো পুরনোখাল পাড়ের একটি নির্জন নৌঘাট। এর
মাত্র এক কিলোমিটার মতো দূরে কালীকচ্ছ ইউনিয়ন। আছে শাহাপুর, সিদ্ধেশ্বরী
একটু দূরে চুন্টা, নরসিংহপুর, পানিশ্বর, নোয়াগাঁও ইত্যাদি গ্রাম। এখানে
হিন্দু ধর্মাবলম্বিরা পুজাঅর্চনা করতে আসতো। এস্থানটি কালিদহ নামে সাগর বা
বিশাল জলধারা থেকে পলিমাটির পড়ে ভেসে উঠা চর থেকে উৎপত্তি। সেকারণে এখানে
পূর্ণস্নানও করা হতো ধর্মরীতি মেনে। আর এভাবেই তীর্থস্থানের মর্যাদা ও
পরিচিতি লাভ করে স্থানটি। আর ক্রমান্নয়ে কালীতীর্থ এবং শেষমেশ ধর্মতীর্থ
হিসাবেই পরিচিতি স্থিত হয়।
‘ধর্মতীর্থ নামের অবহেলিত এই বধ্যভূমিটি নাম
অনেক শুনেছি। বিশেষ করে কুমিল্লার বিদগ্ধ পাঠক, পরিচিত মুখ, ঠাকুর জিয়া
উদ্দিন ভাইয়ের কাছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানকার পাকিস্তান বাহিনী ও
তাদের স্থানীয় দালারদের নির্মমতার অনেক কাহিনী শুনেছি। ওনার বাড়িও কালীকচ্ছ
এলাকার বড় দেওয়ান পাড়াতে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি নিয়ে পড়া এবং লেখালেখিতে
আমার বিশেষ আগ্রহের কারণেই হয়তো তিনি এ বধ্যভূমিটি দেখতে যাওয়ার কথা বলতেন।
বলেছেন অনেকবার। আগে সুযোগ না হলেও এবার একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে হয়েছিলো। ফলে ঐতিহাসিক স্থানটি দেখার সুযোগ হয়েছিলো।
ফেরার পথে ‘ধর্মতীর্থ বধ্যভূমি‘ দেখার জন্য, আমাদের সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন
জিয়া ভাই।
দেখলাম একটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মূল্যবান স্বাক্ষরের
চুড়ান্ত অবহেলার চিহ্ন। বিস্তৃর্ণ একটি মাঠ। তার অদূরেই ক্ষীণজলধারা এখনো
বহমান। এরপরেও দিগন্তবিস্তৃত নিচুভূমি। তারপরই তিতাস আর মেঘনা নদীর বহে চল।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়,বর্ষার সময় চারদিক অথৈ পানি আর পানি। বিরাট
হাওরের মতোই রূপধারন করে। দূরদূরান্ত থেকে নৌপথেই তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া,
আশুগঞ্জসহ বিভিন্ন বানিজ্যিক এলাকার সাথে নৌ চলাচল বৃদ্ধিপায়। তবে আগে এই
এলাকাটি ছিলো নির্জন, গা ছমছম করা ভয়ঙ্কর একটি জায়গা। আর একারণেই পাকিস্থান
বাহিনী ও তাদের দাললরা এই স্থানটিকে বেছে নিয়েছিলো নির্যাতন ও গণহত্যার
জন্য। সেসময় কত শত লোককে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে অথবা ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে
পাশের খালের পানিতে তার সঠিক হিসাব নেই। তখন রক্ত আর লাশ পঁচাগন্ধে আশপাশ
এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠতো। এসবের প্রত্যক্ষদর্শির অনেকেই এখনো জীবিত
আছেন।
এই এলাকার অদূরেইতো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ফলে এখানকার লোকজন
অধিক সংখ্যায় সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়।
সেখানে যুদ্ধকালীন সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ দুই নম্বার সেক্টরের অধিন তারা
প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশ নেয়। ফলে এ এলাকার উপর পাকিস্তান বাহিনীর আক্রশ
ছিলো সবচাইতে বেশি। কালীকচ্ছ এলাকার ঘাঁটিবাড়ি নামক স্থানে বর্তমান
বিজিবি‘র ব্রিগেড হেডকোয়াটার যেখানে গড়ে উঠেছে, যুদ্ধের সময় তা ছিলো বনেদী
হিন্দু বাড়ি। স্থানীয় রাজাকার-আলবদর তথা পাকিস্তানিদের সেহযোগীদের
আত্যচার-নির্যাতনে তারা দেশত্যগে বাধ্য হয়। আর সে সুযোগে সেখানে পাকিস্তান
বাহিনী ও রজাকারদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিলো। ফলে এসব ক্যাম্প
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এসব কারণেই ঐ এলাকার
সাধারণ মানুষও হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিহিংসার নির্মম শিকারে পরিণত
হয় সবচাইতে বেশি।
দূরদুরান্ত থেকে লোকজনকে ধরে এনে এখানে নির্যাতন ও
হত্যা করা হতো। ফলে,গণহত্যার শিকার মুসলমান-হিন্দু শত শত মানুষজনের পরিচয়
পাওয়া না গেলেও স্থানীয় কালীকচ্ছ ও চুন্টা গ্রামের ৪৯ জনের নাম ঠিকানা
পাওয়া যায়। একটা সময় প্রশাসনের উদ্যোগে একটি বিরাট সাইনবোর্ডে নির্মম
হত্যার শিকার, এইসব হতভাগ্যদের নামঠিকানা লিখে টানানো হয়েছিলো।
কিন্তু,সরকারি জায়গা দখলে ওৎপেতে থাকা ভূমি খেকোরা সাইনবোর্ডটি সরিয়ে ফেলে।
তারা প্রত্যক্ষ সমর্থনও পায় তাদের, যারা পাকিস্তানীদের অপকর্মের,
বোঙালিদের উপর তাদের আক্রশচিহ্ন মুছে দিতে চায়। পরবর্তীতে অবশ্য অনেক আবদার
আবেদনের পর আবারো অপেক্ষাকৃত দূর্বল ডিজিটাল ব্যানার বাঁশের খুটির সাথে
টানানো হয়। সেটির করুণদশা আমাদের নজরে আসে। স্থানটি পরিত্যক্ত একটি স্থান
হিসাবে পারে আছে,অনাদরে-অযত্নে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র
প্রকাশিত ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘন্ট গ্রন্থমালা‘য় বিশিষ্ট
কবি,গবেষক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি জয়দুল হোসেনের লেখায়
ধর্মতীর্থ গণহত্যা বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তারপরও স্থানী কর্তৃপক্ষে
টনক নড়েনি।
পাকিস্তান শাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের
মধ্যদিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের চরম রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের
অভ্যন্তরের অত্যাচার-নির্যাতন-ধর্ষণ, খুন, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ইত্যাদি
লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানব সন্তান। তাঁদের
আত্নত্যাগের মধ্যদিয়েই আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা ও তার
ইতিহাস। অথচ তাঁদের নামগুলো স্মরণরাখা তথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মর কাছে
দেশের স্মাধীনতা ইতিহাসের এই নির্মম চিহ্নগুলো দৃশ্যমান করে রাখার নৈতিক
দায়িত্বটুকু পালন করা হচ্ছেনা। স্বাধীনতা স্বপক্ষের সরকার, স্বাধীনতা
আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানকারি দল ক্ষমতায়, তা স্বত্বেও গণহত্যার চিহ্নিত
স্থান ‘ধর্মতীর্থ‘ চরম অবহেলিত, অমর্যাদা, অবজ্ঞ-উপেক্ষার বিষয় হবে বছরের
পর বছর এটা কি মেনে নেয়া যায়। স্থানীয় ও জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ,
বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর এদিকে নজর দিবে কবে এটাই
এলাকাবাসীর কাছে বিরাট প্রশ্ন।