ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রবিবাসরীয়......
Published : Sunday, 27 February, 2022 at 12:00 AM, Update: 27.02.2022 12:50:56 AM
রবিবাসরীয়......















গল্প ও গল্পকথন


রবিবাসরীয়......হাসিব উল ইসলাম||
১.
"অহ, হ্যাঁ, উপন্যাস একটা গল্প বলে। "
- ই এম ফর্স্টার
গল্প ও গল্পকথন দুটো পৃথক বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে সমার্থক মনে হলেও, ইংরেজি ংঃড়ৎু (গল্প) এবং  হধৎৎধঃরাব (গল্পকথন) শব্দ দুটোর অর্থের পার্থক্য  রয়েছে । সহজভাবে বললে, গল্প আমাদের মনোযোগকে নিয়ে যায় কি বলা হচ্ছে সেদিকে; আর গল্পকথন কিভাবে গল্পটা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ  গল্প বলার কলাকৌশলের দিকে, বিষয়বস্তুর দিকে নয়।
একটা গল্প বলার কায়দা কানুন কেমন হবে, কিভাবে গল্পটা বলা উচিৎ — এরকম প্রশ্ন নিয়ে ঔপন্যাসিকেরা সবসময়  বিভোর থাকেন। ইংরেজি উপন্যাসের দুজন স্থপতি হচ্ছেন স্যামুয়েল রিচার্ডসন এবং হেনরি ফিল্ডিং।  ইংরেজ  মুদ্রাকর  স্যামুয়েল রিচার্ডসন (১৬৮৯-১৭৬১) পত্রোপন্যাসের জন্য বিখ্যাত। তিনি চরিত্রের পত্র মারফত গল্প বলতেন।  অন্যদিকে  তাঁর সমসাময়িক হেনরি ফিল্ডিং (১৭০৭-১৭৫৪) এর গল্প বলার ধরণ  ছিল হাস্যরসাত্মক, উপন্যাসের আয়তনও হতো মহাকাব্যিক। তিনি বিচিত্র চরিত্র নির্মাণ, ব্যঙ্গ -বিদ্রুপ- বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে হাস্যরস তৈরি করতেন। অষ্টাদশ শতকে রিচার্ডসনের গল্প বলার কৌশল কার্যকরী নাকি ফিল্ডিংয়ের, এই নিয়ে তুমুল বিতর্ক ছিল।
ইংরেজি উপন্যাসের পুরোধা চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) তাঁর ব্লিক হাউজ উপন্যাসে গল্প বলার জন্য দুই ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছেন। দুই ভাগে বিভক্ত স্টোরিলাইনের এক অংশে একজন সর্বজ্ঞ কথক  গল্প বলেন, অপর অংশে গল্পেরই একটা চরিত্র নিজের আত্মজীবনী লেখার মাধ্যমে। ডিকেন্স খুব সম্ভবত মন স্থির করতে পারেননি কিভাবে গল্পটি বলবেন, তাই হয়তো তিনি  দুটো কৌশলই অবলম্বন করার চেষ্টা করেছেন। ব্যাপারটা অনেকটা জুতার দোকানে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের জুতা পরে দেখার মতো- কোনটা বেশি মানানসই।
আসলে,   উপন্যাস  "নির্মিতি" বা "গল্পকথন" বিষয়ে পুরোপুরি আত্মসচেতন হয় হেনরি জেমসের আর্ট ও ফিকশন গ্রন্থটি প্রকাশের পর। সুনির্দিষ্ট করে বললে, পুস্তকটির ১৯০৮ সালের নিউ ইয়র্ক এডিশনের সংযুক্ত ভূমিকা প্রকাশের পর। জেমসের তত্ত্বের মুখ্য বিষয় ছিল সহজ :  'কিভাবে ' গল্প বলা উচিৎ।
২.
"গল্প বিশ্বাস করুন, গল্পকারকে নয়। "
-ডি এইচ লরেন্স
জেমসীয় তত্ত্বের সবচেয়ে ভালো উদাহরন হতে পারে তাঁর লেখা আলোচিত উপন্যাস দ্যা টার্ণ অভ দ্যা স্ক্র।  এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন গল্পকথন কেমন হওয়া উচিৎ। ক্রিসমাস ইভের এক লোমহর্ষক ভূতের গল্প হিসেবে উপন্যাসটিকে নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে গল্পের ভেতরেও রয়েছে আরেকটা গল্প। ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে গল্পকথক আগত অতিথিদেরকে ভয়ংকর এই গল্পটি শোনান। আমরাও তাদের সাথে গল্পটা শুনি। তিনি গল্পটি শুরু করেন এভাবে :
“....পুরোনো, ঝাপসা কালিতে, সবচেয়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে। ' তিনি আগুন উস্কে দেন। 'একজন মহিলার হাতের লেখা। বছর কুড়ি হলো তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে পাতাগুলো পাঠিয়েছিলেন ...মহিলা ছিলেন আমার বোনের আয়া,' তিনি শান্তভাবে বললেন। ' আমার জানামতে আয়া হিসেবে সবচেয়ে অমায়িক মানুষ; তিনি  যেকোনো কিছুর জন্যই যোগ্য ছিলেন । অনেক দিনের কথা, আর এই ঘটনারও অনেক আগের।”
গল্পকথক তারপর আয়ার আখ্যান পড়া শুরু করেন। গ্রামের এক অলক্ষুনে বাড়িতে দুটো অদ্ভুত বাচ্চাকে দেখভালের কথা পাওয়া যায় তার গল্পে। বাড়িটা কি ভৌতিক ছিল? বাচ্চাগুলোর ওপর কি ভূতের আছর ছিল? নাকি ঐ মহিলা নিজের অলীক কল্পনায় ভ্রমগ্রস্থ ছিলেন?
গল্পটি একটা ভয়ংকর হিংস্র ক্লাইম্যাক্স তৈরি করে। এবং  উত্তেজনার এই চরম অবস্থাটি তৈরি করা হয় আস্তে আস্তে-ক্রমশ। এটা একটা নিরন্তর, পুরোপুরি প্রহেলিকাময় প্রক্রিয়া যা পাঠককে আঁকড়ে ধরে রাখে এবং ভয় পাইয়ে দেয়। জেমসের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে,  আপনার কাক্সিক্ষত প্রভাবিত পেতে (এ ক্ষেত্রে রক্ত হিম করা ভয়ের গল্প), আপনাকে অবশ্যই গল্পটিকে ক্রমশ  স্ক্রুর মতো করে ঘোরাতে হবে, হাতুড়ি দিয়ে পেরেক পোতার মতো করে নয়।
সাহিত্যের নিপুনতা, হেনরি জেমস আমাদেরকে বলেন, গল্প বলায় ,গল্প কথনে নিহিত, কি বলা হচ্ছে তার ওপর নয়।  গল্পের কাঁচামাল হচ্ছে  যা গল্পে বলা হয় সেসব। কিন্তু  কাঁচামাল সবসময়ই   কাঁচা— শৈল্পিকভাবে স্থুল। গল্পকথনের মনোযোগ একটা সমালোচনামূলক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এখানে গোঁড়ামি আছে,   পাঠকেরা আছেন, লেখকেরা আছেন, আরো আছেন অনির্ভরযোগ্য গল্পকথক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উদারিং হাইটস এ নেলি ডেন লকউডকে যা কিছু বলে তার সব কি আমরা বিশ্বাস করি? লকউডের সবকথা কি আমরা বাস্তব বলে মেনে নিই?
তা সত্ত্বেও, সমস্ত জটিলতাসহ, গল্পের সমর্থনে  একটা যুক্তি থাকে: গল্পে অতি-কথন সম্ভব। উপন্যাসে পেরেক ঠোকার মতো  স্পষ্ট করে কিছু   বলার চেষ্টায়, ডি এইচ লরেন্স মত দেন, আপনি হয় উপন্যাসটাকে হত্যা করেন, নয়তো উপন্যাসটি উঠে দাঁড়ায় এবং পেরেক নিয়ে হাঁটা দেয়।
৩.
 'গল্পের ' চেয়ে 'গল্পকথনের ' ওপর জোর দিলে মালিকানার সৃষ্টি করা হয়- অর্থাৎ গল্পকারের গল্পের ওপর মালিকানার অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। জেমস তাঁর গল্পে জেমসীয় কলাকৌশল প্রয়োগের জন্য দ্যা টার্ণ অভ দ্যা স্ক্র  তার নিজস্ব। বিপরীতভাবে, সিন্ড্রেলা রূপকথার গল্পটি কারো নিজস্ব নয়। গ্রিম ব্রাদার্স কিংবা ওয়াল্ট ডিজনি নিজেদের মতো করে গল্পটি বলতে পারেন। একইভাবে, ইডিপাসের কিংবদন্তি জনগণের, কিন্তু ইডিপাস রেক্স সফোক্লিসের।
মার্ক্সিস্ট সমালোচক ওয়াল্টার বেনজামিনকে সাহিত্যের ব্যক্তি মালিকানা এবং সর্বজনীন মালিকানার পার্থক্যের ভেতর ধনতান্ত্রিক নিহিতার্থ বিষয়ে আকৃষ্ট হন। উপন্যাস (যা আধুনিক পুঁজিবাদের অধীনে উৎপাদিত), বেনজামিন দাবি করেন, গল্প কথনের মৃত্যু কে সুস্পষ্ট করে। এই চমকপ্রদ আপার্তবৈপরীতার বিষয়টি একটা সাদামাটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখা করা যাক। ধরেন, পাড়ার টঙে বসে চা খেতে খেতে  আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে এমন একটা  অশ্লীল রসালো গল্প শোনালেন যা আপনি কখনো কোথাও লিখতে পারবেন না। আপনার বন্ধু তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে শোনালো। সে শোনালো তার বন্ধুকে। এভাবে চলতে থাকলো ব্যাপারটা। লক্ষ্যনীয় যে, গল্পটা বলার সময় প্রত্যেকে  সুক্ষ্মভাবে গল্পটিকে পরিবর্তন করে ফেলবে।
চাইনিজ হুইসপার ইফেক্টের ফলে এক সপ্তাহ কিংবা একমাস সময়ের মধ্যে আপনার বন্ধুকে বলা গল্পটি আপনার কাছে পাড়ার ঐ টঙ দোকানেই ফেরত আসবে। কিন্তু গল্পটিকে  আপনার কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে। একজন আরেকজনকে ক্রমাগত  বলার ফলে গল্পের অনেক বর্নণা হারিয়ে গেছে, আবার অনেক জায়গায় বিশদে  যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু । গল্পটা এখন কার? আপনার? উত্তর হচ্ছে,  গল্পটা সবার, আবার কারোরই না। এখানে গল্পকথন/গল্পকথক বন্দোবস্ত অনির্দিষ্ট। প্রত্যেকে তার নিজের মতো করে আরেকজনের কাছে গল্পটি বলেছে।
সংবাদপত্রগুলো এমন খেলাই খেলে। উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পী লতা মুঙ্গেশকরের মৃত্যুর খবরের কথাই ধরা যাক। প্রতিটি সংবাদপত্র ভিন্ন ভিন্ন সংবাদ ছেপেছে। প্রথম আলো, কালের কন্ঠ, কিংবা ডেইলি স্টারের নিউজ স্টোরি কি একই রকম ছিল?
ঔপন্যাসিকেরা গল্পকথন বিষয়ে সাধারণ শক্ত অবস্থান নেন। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান লেখক জে ডি স্যানিঞ্জারের (১৯১৯-২০১০) কথা বলা যেতে পারে। ২০০৯ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দ্যা ক্যাচার ইন দ্যা রাই এর অননুমোদিত সিক্যুয়েল সিক্সটি ইয়ার্স লেটার: কামিং থ্রু দ্যা রাই এর প্রকাশ ও প্রচার বন্ধের জন্য মামলা করেছিলেন। কেন করেছিলেন? উত্তর: তাঁর নিজস্ব গল্পকথন শৈলীর জন্য।
[হাসিব উল ইসলাম পেশায় শিক্ষক। পড়ান কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।]


অহিউল্লাহর আঁকা শেষ ছবি


রবিবাসরীয়......আরিফুল হাসান ||
খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নয় বছরের একটি বালক। তার মনটি আপাত বিক্ষিপ্ত। জন্মের পরে এমন ঘনঘোর আর কখনো দেখেনি। মানুষেরা কি এক আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। মাঝে মাঝে দুয়েকটা গাড়ি ভয়ে ভয়ে যেনো ছুটে যাচ্ছে। যেনো ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে দেশটার উপর দিয়ে। কিন্তু দেশটা বলতে সে কতটুকু চেনে? বালক বয়েসে মায়ের কোল ছেড়ে সবে পড়াশোনা আরম্ভ করেছে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এই পড়াশোনা, এই আসা যাওয়ার মাঝে সে টের পায়, ঢাকায় একটা বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কী ঘটতে যাচ্ছে তা তার অবুঝ জ্ঞানে ধরতে পারে না। তবু পিতার শুকনো মুখ, মায়ের আতঙ্কিত মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে, কোনো ভালোকিছু ঘটতে যাচ্ছে না ঢাকায়।
স্কুল বেশ ক’দিন ধরে বন্ধ। কিন্তু এ বন্ধের মধ্যেও একদল ছেলেমেয়ে গোপনে স্কুলে যায়। অহিউল্লাহরও যেতে মন চায়। কিন্তু বাবা মা দেয় না। বাইরে নাকি গণ্ডগোল, আর এই গণ্ডগোলের সময় স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই; পিতা সাফ সাফ জানিয়েছেন। মা-ও কোলছাড়া করতে চায় না। একটু নজরের আড়াল হলেই ভয়ে মায়ের কলিজায় পানি থাকে না। কিন্তু সভাব যার প্রজাপতির মতো, তাকে কি বেঁধে রাখা যায়? অহিউল্লাহ কথা শোনে না। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ফুল, পাখি, প্রজাপতি, চলন্ত রিক্সা, রিক্সাওয়ালার ঘর্মাক্ত দেহ আঁকে সে। কোনো নতুন একটি গাড়ি আসলে সেটি সে কাগজে পেন্সিলে ধরে রাখার চেষ্টা করে।
এই আঁকাআঁকির অভ্যেসটা তার মগজে গেঁথে গেছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল নিয়ে সারাদিন শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো আর যেখানে চোখ আটকে যাবে সেটিরই দৃশ্যপট এঁকে ফেলা অহিউল্লার কাজ। পিতা দরিদ্র মানুষ; গা-খাঁটা রাজমিত্রি, যেখানে যেদিকে কাজ পায় সেখানেই যেতে হয়। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত মো. হাবিবুর রহমান। ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে বড় মানুষ করতে চায়। ছেলেও পড়াশোনায় বেশ ভালো। আগ্রহীও বটে। তবে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তার ছবি আঁকায়। ফলে বাবা-মা-ও ছেলের এ স্বভাব সম্পর্কে জানে এবং রীতিমতো প্রশ্রয়ও দেয়। হাবিবুর রহমান বলেছে, আর কিছু দিন পরে অহিউল্লাহকে রং পেন্সিল কিনে দেবে। রঙিন একটি খোয়াব অহিউল্লাহর মাথার ভেতর খেলে। ঢেউ তুলে তার বালক মনে। মনের অজান্তে সে কতকিছু এঁকে ফেলে! আবার সেগুলোকে মুছেও ফেলে মনে মনে। সকালের সূর্য, পূর্ণিমার চাঁদ, হাসের হলদে ঠোঁট, রংধনুর সাতরং সে আঁকে। আঁকে একটি ভোর, একটি টগবগে দুপুর।

সেদিনও সকাল বেলা মা তাকে বাইরে যেতে দেয় না। পিতা হাবিবুর রহমান নিজেও আজ কাজে যায়নি। সকালে ঘরে নাস্তা বানানোর মতো পর্যাপ্ত আটা না থাকা স্বত্বেও ঘর থেকে বের হয়ে ১৫২ লুৎফর রহমান লেনের গলির মুখে মুদি দোকান থেকে আটা আনতে যায় না তার বাবা। অজানা এক আতংকে ঘরের মধ্যেই কুঁকড়ে থাকে সবাই। অহিউল্লার এই অবরুদ্ধতায় দমবন্ধ হয়ে আসে। সে শোনে, গলির মোড়ে দোতালা বিল্ডিংটার বারান্দার টবে ফোটা ফুলগুলো তাকে ডাকছে। ফুলে ফুলে উড়ে চলা প্রজাপতিগুলো তাকে ডাকছে। গলির মুখে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো তিনচারটি পথকুকুর তাকে ডাকছে। এসবের ডাক সে অবজ্ঞা করে কীভাবে? কিন্তু কীভাবে সে ঘর থেকে বের হবে। পিতার শাসন, মায়ের সুতীক্ষè দৃষ্টি, এসবকে ফাঁকি দিয়ে সে বেরিয়ে পড়তে সুযোগ পায় না।
বেলা বাড়ে। আস্তে আস্তে দুয়েকজন বের হতে থাকে। রাস্তায় একটা দুটো গাড়ি ভয়ে ভয়ে চাকা ঘুরায়। মিলিটারিরা রাস্তা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে নাকি। গতকাল নাকি মেডিকেলের সামনে গোলাগুলি হয়েছে। অনেক ছাত্ররা নাকি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে অসংখ্য। ভাষার দাবিতে এ মিছিল। বালক অহিউল্লাহ ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। ভাষার আবার  দাবি কী? কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় কে এল জুবিলি স্কুলের শিক্ষক কামরুজ্জামান যখন এলাকায় এসে কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রের সাথে কথা বলছিলো, তখন অহিউল্লাহও সেখানে ছিলো। সেখানে ছিলো বলতে একটু দূরে একটা আমগাছের নিচে কয়েকটা পথকুকুরের সাথে খেলা করছিলো সে।  পশ্চিমের লাল আকাশ বুকে নিয়ে কামরুজ্জামান স্যার ছাত্রদের বলছেন, মিছিলে গুলি হয়েছে। স্পট ডেথ সাতজন। হয়তো আরও বেশি। পুলিশ অনেকের লাশ গুম করে ফেলেছে। আহত হয়েছে অনেকে। এবারে আন্দোলনে যেতে হবে। অলিগলি সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে বিদ্রোহের আগুন।
অহিউল্লাহ আন্দোলনের আগুন দেখে, দেখে চকচক করে কামরুজ্জামান স্যারের চোখ এই ছায়া ছায়া অন্ধকারেও। সে শোনে, মায়ের ভাষায় কথা বলতে দেবে না ওরা। সে শোনে, তার পাখির ভাষা, তার ফুলের ভাষা সব মুক হয়ে যাবে। সে ভয় পায়। আবার মনে মনে জ্বলেও উঠে। শোনে, মিছিলে যাবে ছেলেরা আগামিকাল সকালে। রাতটা তার কোনোরকম কাটে। কিন্তু এই সকালে রাস্তাভর্তি পুলিশ, পাকিস্তানি সৈনিক, জলপাই রঙের ট্যাঙ্কের ভয়ে বাইরে যাবার ব্যাপারে বাবা মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা তার মনখারাপ করে দেয়। সামান্য নাস্তা করে মুখ ভার করে সে বসে থাকে। ক্রমশ লোকজন বেরুতে থাকলে, এক ফাঁকে সেও বেরিয়ে পড়ে বাবা মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে।

রাস্তাটা এতো সুনসান! কেমন যেনো হাহাকার করে উঠে বুকের ভেতরটা। তার পরিচিত তিনচারটি কুকুর পথের একপাশে আমগাছটার গোড়ায় শুয়ে আছে। তাকে দেখে একটা কুকুর মাথা উঁচু করে একবার হাই তুলে, তারপর আবার মাথা নামিয়ে শুয়ে যায়। অহিউল্লাহ এক পলক থামে। পকেট থেকে কাগজ পেন্সিল বের করে এঁকে ফেলে তিনটা কুকুরের শুয়ে থাকা। তারপর তার চোখ যায় দোতলা বাড়িটির ঝুল বারান্দার দিকে। সারি সারি টবে বাহারি রকমের ফুল ফুটে আছে। একটি বড় রক্তজবা ঝুঁকে আছে বারান্দা থেকে নিচের দিকে। তাতে এসে একটি প্রজাপতি পাখা মেলে বসে। ফুলের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু হয়তো বলছে সে। অহিউল্লার ভালো লাগে বিষয়টি। সে ফুল ও প্রজাপতির ছবি আঁকে।
তারপর সে ১৫২ লুৎফর রহমান লেন ছেড়ে উঠে যায় নবাবপুর রোডে। থমথমে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো রাস্তাজুড়ে। লোকজন উৎকণ্ঠা নিয়েও বাইরে বেরিয়ে এসেছে এবং কি যেনো একটা ঘটতে যাচ্ছে এমন একটা নিভৃত চাঞ্চল্য বিরাজ করছে সবখানে। তার বালক মনে এতোকিছুর ব্যাখ্যা মেলে না। তবে কামরুজ্জামান স্যারের কথাটা তার মনে আছে। আজ সকালে মিছিল বের হবে। ভাই হত্যার প্রতিবাদে মিছিল। অহিউল্লাহর একান্ত ইচ্ছে সেও মিছিলে যোগ দেবে। সে এগুতে থাকে। কিন্তু খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। রাস্তা জুড়ে জলপাই রঙের ট্যাংক নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে। শিশু অহিউল্লাহর চোখে এরকম উর্দি পড়া মানুষ এই প্রথম দেখা। তাদেরকে তার মানুষ বলে মনে হয় না। তার মনে হয়, একদল জন্তু জানোয়ার হিংস্র নখর আর থাবা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে পেন্সিল ও কাগজ বের করে সে আঁকতে থাকে ওই অদ্ভুতদর্শন প্রাণিদের। এমন সময় পেছনদিক থেকে অতর্কিতে একটি মিছিল উঠে আসে নবাবপুর রোডে। অহিউল্লাহর ছবি আঁকা থেমে যায়। কাগজের টুকরোটি মুখে পুড়ে চিবুতে চিবুতে দৌঁড়ে গিয়ে যোগ দেয় মিছিলে। হাত উর্ধ্বে তোলে স্লোগান ধরে। কয়েক কদম সামনে বাড়ে তারা। এমন সময় ঠা ঠা করে উঠে পাকিস্তানি সৈন্যদের রাইফেল। চোখের পলকে অন্য অনেকের সাথে উড়ে যায় অহিউল্লার মাথার খুলি। শুধু তার চোয়ালের ভেতর শক্ত করে আটকে থাকে একটুকরো কাগজ, রক্তের অক্ষরে যাতে একটি ভোর আঁকার স্বপ্ন ছিলো।
 লেখক ঃ কবি  কথা সাহিত্যিক কলেজ শিক্ষক